বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুব কম শক্তিই মুসলিম বিশ্বকে মার্কিন হস্তক্ষেপের মতো গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পেরেছে। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার বাগাড়ম্বরের নেপথ্যে একটি গভীর ভূ-রাজনৈতিক যুক্তি লুকিয়ে আছে– সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা। তবুও এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে অস্থিতিশীল শক্তিগুলোর একটি ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলতে সহায়তা করেছে।

বিপজ্জনক জোটের জন্ম

স্নায়ুযুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনের সবচেয়ে বড় ভয় ছিল চরমপন্থা নয় বরং সমাজতন্ত্র। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে উপনিবেশ-পরবর্তী প্রজন্ম মোসাদ্দেকের ইরান থেকে নাসেরের মিসর এবং ইরাক ও সিরিয়ার বাথপন্থিদের ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিল। যদিও এই সরকারগুলো ত্রুটিহীন ছিল না, কিন্তু তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সম্পদের ওপর জনসাধারণের মালিকানা এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে মুক্ত ভবিষ্যৎ চেয়েছিল।

এই আন্দোলনগুলো মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র রক্ষণশীল রাজতন্ত্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র খুঁজে পেয়েছিল। সৌদি আরবে আমেরিকান তেল স্বার্থ ও সৌদ পরিবারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, সেটার বৈধতা ইসলামের কঠোর ওয়াহাবি ব্যাখ্যার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এই জোট কেবল তেল নয়, বরং মতাদর্শও রপ্তানি করত; মাদ্রাসা, ধর্মীয় প্রচারক ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে অর্থায়নের মাধ্যমে যা ধর্মীয় বিশুদ্ধতার নামে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করেছিল।

আফগানিস্তান উদাহরণ

সবচেয়ে আকর্ষণীয় উদাহরণটি দেখা যায় গত শতকের আশির দশকে আফগানিস্তানে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় তখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিকাশ করার সুযোগ দেখতে পায়। ‘অপারেশন সাইক্লোন’ পরিচালনার মাধ্যমে সিআইএ মুজাহিদীনদের কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়, যাদের অনেকেই সৌদি আরব ও পাকিস্তানের অর্থায়নে পরিচালিত ওহাবি স্কুলে দীক্ষিত হয়েছিল।

আফগান যুদ্ধকালে বিশ্বব্যাপী একটি জিহাদি নেটওয়ার্কের জন্ম হয়। আমেরিকা সেই সময় মুজাহিদীনদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ বলে আখ্যায়িত করত। সেই যোদ্ধারা যখন পরিত্যক্ত হলো, তখন তারা তালেবান ও আল-কায়দায় পরিণত হলো। কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তৈরি চরমপন্থার আদর্শিক অবকাঠামো শীতল যুদ্ধের পরও টিকে থাকে এবং হতাশ সমাজে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

ইরান ও ইরাকে ক্ষমতা বনাম অন্তর্ঘাত

ইরানে ১৯৫৩ সালে সিআইএ সমর্থিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে উৎখাতের ঘটনাটি এক দীর্ঘ ছায়ার সূচনা করেছিল। মোসাদ্দেকের ‘অপরাধ’ ছিল ইরানের তেলসম্পদ জাতীয়করণ, যা ব্রিটিশ ও আমেরিকান আধিপত্য উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাঁকে উৎখাত করার পর শাহর একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ধর্মনিরপেক্ষ হলেও নৃশংস দমনপীড়ন এবং পশ্চিমা মদদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এই পরিস্থিতিই ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের ক্ষেত্র তৈরি করে।

ইরাকেও মার্কিননীতি সমর্থন ও ধ্বংসের মধ্যে দোদুল্যমানতা ছিল। আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটন সাদ্দাম হোসেনকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল; কিন্তু নব্বই ও শূন্য দশকে মার্কিননীতি ইরাকের বিরুদ্ধে চলে যায়। প্রতিটি হস্তক্ষেপ ইরাকি সমাজকে আরও বিভক্ত করেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে এবং সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়েছে। এই বিশৃঙ্খলা থেকেই পরে আইএসের মতো চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর উত্থান ঘটে।

ইসরায়েলি সংকট ও দ্বিমুখী মার্কিননীতি

মার্কিন কৌশলের মূলে রয়েছে ইসরায়েলের প্রতি অটল সমর্থন; সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিকভাবে। এই জোট তৈরি হয়েছিল অপরিমেয় নৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্যের বিনিময়ে, যা ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব ও বাস্তুচ্যুতির ক্ষতকে আরও গভীর করেছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের কথা বললেও একই সঙ্গে বহুত্ববাদ দমনকারী শাসন ব্যবস্থা ও মতাদর্শকে শক্তিশালী করে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ওয়াশিংটনের অঞ্চলভিত্তিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।

এই বৈপরীত্য একটি বৃহত্তর সত্যকে উন্মোচিত করে: ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্রনীতি খুব কমই কোনো জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা সমর্থন করে থাকে; বরং এর মূল লক্ষ্য আখ্যান ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণ। যখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো হতাশা বা বিভক্তির কারণে অভ্যন্তরীণ সংঘাত নিরসনে মার্কিন হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানায়, তখন তারা প্রায়ই এর পরিবর্তে আরও গভীর অস্থিরতা নিয়ে আসে। যাকে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ বলা হয়, তা প্রায়ই চরমপন্থার সেই চক্রগুলোকেই চিরস্থায়ী করে, যা এটি শেষ করবে বলে দাবি করে থাকে।

বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের যে ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে– যেমন চট্টগ্রামে যৌথ সামরিক মহড়া এবং সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রতি তাদের কথিত আগ্রহ, তা অনেকের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে; বিশেষত যারা বিদেশি হস্তক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো মনে রেখেছেন। ওয়াশিংটন তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির আওতায় এই কাজগুলোকে ‘মানবিক সহায়তা’ বলছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মার্কিন সামরিক উপস্থিতি খুব কম ক্ষেত্রেই কেবল ত্রাণ বা দুর্যোগ মোকাবিলার মহড়াতে সীমাবদ্ধ থাকে।

বস্তুত বাংলাদেশ এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বঙ্গোপসাগর বিশ্ব প্রতিযোগিতার মঞ্চে পরিণত হয়েছে– পূর্ব থেকে চীন, পশ্চিম থেকে ভারত আর দূর থেকে যুক্তরাষ্ট্র এই উপসাগর নিয়ে বেজায় উৎসাহী। প্রতিটি দেশই বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব দাবি করে; কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব কৌশল আছে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সেন্টমার্টিন হঠাৎ নিছক নাজুক প্রবাল দ্বীপের চেয়ে বড় কিছুতে পরিণত হয়েছে। এক অর্থে সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে– বাংলাদেশ নিজস্ব পথে চলবে, নাকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অন্তহীন যুদ্ধের খেলায় আরেকটি ঘুঁটি হবে।

মার্কিন উপস্থিতি যদি গভীর হতে দেওয়া হয়, তবে তা ভূ-রাজনীতির বাইরেও সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিণতি বয়ে আনবে। ওয়াশিংটনের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ যেখানেই স্পর্শ করেছে, সেখানেই সমাজকে মেরূকরণ; চরমপন্থি আখ্যানগুলোকে শক্তিশালী এবং সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করেছে। বাংলাদেশে ধর্ম ও সাম্প্রদায়গত পরিচিতি ইতোমধ্যে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। আমাদের অবশ্যই এই সংক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বিদেশি সামরিক উপস্থিতির ভূমিতেই কিন্তু চরমপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এটি দখলদারিত্ব, ঔদ্ধত্য ও অসন্তোষকে পুঁজি করে চলে।

বিস্মৃত শিক্ষা

​যখন কোনো জাতি অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলায় বহিরাগত শক্তির ওপর ভরসা করে, তখন তারা নৈতিক ভিত্তি ও সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্ব হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো মুক্তি আন্দোলন তৈরি করে না; তৈরি করে নির্ভরতা বা পরনির্ভরশীলতা। সেই পরাধীনতার মূল্য দিতে হয় প্রগতিশীল চিন্তা, নারী অধিকার, শিক্ষা ও শিল্পের স্বাধীনতার পতনের মধ্য দিয়ে, যা স্বাধীনতা আকাঙ্ক্ষী সমাজের ভিত্তি।

আজ যখন মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায়– তেহরান থেকে কাবুল, ঢাকা থেকে বাগদাদ– নতুন প্রজন্ম জেগে উঠছে, তখন এই শিক্ষাটি অবশ্যই মনে রাখতে হবে: নবজাগরণের পথ আমদানিকৃত যুদ্ধ বা মতাদর্শ থেকে আসবে না। মুক্তি কখনোই বাইরের কাউকে দিয়ে করানো যায় না। এটিকে জন্ম নিতে হবে ভেতর থেকে– জ্ঞানের মাধ্যমে, ন্যায়ের মাধ্যমে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মান্ধতার ঊর্ধ্বে একটি পৃথিবী কল্পনা করার সাহসের মধ্য দিয়ে।

আমাদের কোনোভাবেই একটি নির্ভরতার শৃঙ্খল ছেড়ে আরেকটিকে স্বাগত জানানো উচিত হবে না। ভারতের ছায়া থেকে মুক্তি মানেই আমেরিকার অধীনে চলে যাওয়া নয়। প্রকৃত স্বাধীনতা মানে সতর্কতা– আমাদের ভূমি, আমাদের জলসীমা এবং আমাদের জনগণের নাজুক সম্প্রীতিকে সব ধরনের বিদেশি হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করা।

বাংলাদেশের শক্তি সবসময়ই তার নৈতিক ও সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বে; বিদেশি শক্তির নিরাপত্তামূলক ছায়ায় নয়, বরং তার নিজ জনগণের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায়। এই মুহূর্তে আমরা যেন আত্মসমর্পণ না করি; না কোনো সাহায্যের লোভনীয় আশ্বাসে, আর না সেই শান্তির মহড়ায়, যার প্রতিধ্বনিতে যুদ্ধের ভাষা শোনা যায়।

আনুশেহ আনাদিল: সংগীতশিল্পী, সমাজকর্মী

সূত্র, সমকাল