আওয়ামী লীগ সাড়ে ১৫ বছর দেশ পরিচালনা করেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের শাসনকাল শুরু হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মাত্রা ছিল অবিশ্বাস্য। দুই-তৃতীয়াংশের অনেক বেশি আসন নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে এবং এসেই বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতার সব স্তরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল এবং অনুগত একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে কারচুপির নির্বাচনের পথ আরো সুগম করে তারা। একই সঙ্গে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ গঠনের রাজনীতির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমাজের সর্বস্তরে বিভাজন তৈরি করে। এ সময় থেকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের ওপর নির্বিচার নিপীড়ন শুরু করা হয়।

এই পটভূমিতে ২০১৪ সালে সম্পূর্ণ একতরফা নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে আওয়ামী লীগ আরো বেশি আসন নিয়ে দ্বিতীয় দফা সরকার গঠন করে। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলবর্জিত এই নির্বাচনে ভোটের আগেই ১৫২টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয় ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে এমন নজির নেই।

২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে নজিরবিহীন কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার প্রায় আড়াই শ আসনে বিজয়ী হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাদের কারচুপির ধরন ছিল আরেকটি নিন্দনীয় প্রক্রিয়ায়। এই নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের সুযোগ রুদ্ধ করে ডামিপ্রার্থী দাঁড় করিয়ে মূলত এক ব্যক্তির (শেখ হাসিনা) ভোটে ৩০০ আসনের ফল নির্ধারণ করা হয়।

অকল্পনীয় কারচুপির প্রতিটি নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবির্ভূত হয় আরো ভয়ংকর, নিপীড়ক ও দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠী হিসেবে। আওয়ামী লীগের এই শাসনকালে ক্রমেই মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার আরো বেশি করে সংকুচিত করা হয় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং যথেচ্ছ মামলা প্রদানের মাধ্যমে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরাসরি সমালোচনা হয়ে ওঠে অসম্ভব একটি বিষয়।

আমি এই সময়পর্বে কলাম লিখে গেছি ক্রমাগত আরো সতর্ক, আরো কৌশলীভাবে, কিন্তু মূল সংকটগুলো একদমই আড়াল না করে। লেখালেখি ও মতপ্রকাশের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ, আদালত অবমাননা এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার শিকার হয়েছি, আমার অফিসকক্ষে আগুন দেওয়া ও পরে তালাবদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে, প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছি। কিন্তু তাই বলে কথা বলা আর লেখালেখি থামিয়ে দিইনি।

আমাদের সেই দুঃস্বপ্ন শেষ হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অকুতোভয় তরুণ নেতাদের নেতৃত্বে চব্বিশের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটেছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থার। এই আন্দোলনে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টেই ১৪০০ মানুষ হত্যার শিকার এবং পঙ্গুত্ব বা অন্ধত্বের শিকার হতে হয়েছে আরো বহু মানুষকে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ শুধু নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র আর শোষণমুক্তির আন্দোলনে এত বড় আত্মত্যাগর আর কোনো ঘটনা নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ে? কীসের অবসানের ঐক্যে এভাবে একত্র হয়েছিল মানুষ? কেমন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা ছিল তাদের বুকের ভেতর?

শেখ হাসিনার শাসনকালের দিকে তাকালে এটা বোঝা কঠিন বিষয় নয়। মানুষ ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা চেয়েছিল, নিজের ভোট নিজে দিতে চেয়েছিল, গুম-খুন নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে মুক্তি চেয়েছিল, শোষণ আর বৈষম্য থেকে মুক্তি চেয়েছিল। একই সঙ্গে মানুষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রভুত্বমূলক আচরণ থেকে রেহাই চেয়েছিল। সীমান্ত হত্যা, পানি আগ্রাসন, বাংলাদেশকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যর প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনার সীমাহীন ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল।

রাজনীতির নামে নির্মূলকরণ, নির্বাচনের নামে প্রহসন, উন্নয়ন নামের প্রতারণা, বন্ধুত্বের নামে ভারততোষণ, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন আর নাগরিক সমাজকে বশীভূতকরণের বহু ঘটনা দেশের মানুষের জানা। মানুষ এসব থেকে মুক্তি চেয়েছিল।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের কী দানবীয় শাসন থেকে মুক্তি দিয়েছে, তা মনে রাখা ও উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

লেখক : আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা

সূত্র, আমার দেশ