বাংলাদেশ বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগ সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি প্রত্যাশা করা হয়, তার বিপরীতে বিদেশি বিনিয়োগের হার অপর্যাপ্ত। নতুন কোম্পানি কম আসছে। বিশ্বব্যাংকের বেসরকারি খাতবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এ কথা। দেখা গেছে, ব্যবসায় পরিবেশ তথা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো পাঁচটি বড় বাধা রয়েছে।
এগুলো হলো বিদ্যুতের সমস্যা, অর্থায়নের সীমিত সুযোগ, দুর্নীতি, অনানুষ্ঠানিক খাতের আধিক্য ও উচ্চ করহার। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের প্রতিবেদনে কোন দেশ কত বিদেশি বিনিয়োগ পায়, তা তুলে ধরা হয়। সংস্থাটির ২০২৪ সালের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) পৌনে ২ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশের কমেছে পৌনে ১৪ শতাংশ।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৩০০ কোটি ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। অন্যদিকে ভারত ২ হাজার ৮১৬ কোটি, ভিয়েতনাম ১ হাজার ৮৫০ কোটি, ইন্দোনেশিয়া ২ হাজার ১৬৩ কোটি, কম্বোডিয়া ৩৯৬ কোটি ও পাকিস্তান ১৮২ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পায়। বাংলাদেশে আসা বিদেশি বিনিয়োগ সবসময়ই প্রত্যাশার চেয়ে কম ।
দেশে উচ্চনীতি সুদের (১০ শতাংশ) প্রভাবে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এপ্রিল ২০২৫ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৭ দশমিক ৫০ শতাংশে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম নিচু অবস্থান।
টেকসই বিনিয়োগ এবং উৎপাদনশীল খাতে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হলে সুদের ভারসাম্য রক্ষা, মুদ্রানীতি বাস্তবমুখী করা এবং বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশে বৈদেশিক ঋণ বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী জিডিপির হার ও রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। ফলে বৈদেশিক ঋণ অর্থনীতিতে অনেকটা ঝুঁকি তৈরি করছে। চাপ বাড়ছে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায়। গত দেড় দশকে অর্থনীতিতে নানাভাবে চাপ বাড়িয়েছে পতিত মাফিয়া সরকার। দেশি-বিদেশি ঋণ বাড়িয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। ঋণের বড় অংশই নানা কেনাকাটার নামে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এতে বেড়েছে সুদব্যয় ও ঋণ পরিশোধের চাপ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ বলছে, চলতি অর্থবছর শেষে সরকারের দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে দেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ১৩ লাখ ২৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা; আর বিদেশি ঋণের স্থিতি ১০ লাখ ১৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এক বক্তৃতায় বলেছেন, বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখন পর্যন্ত সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। এ পর্যন্ত বৈদেশিক ও সামগ্রিক ঋণ ‘নিম্ন ঝুঁকিপূর্ণ’ অবস্থানে রয়েছে। তবে বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে, বহিঃশক অর্থাৎ বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি হওয়া চাপের কারণে আরো ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে বাংলাদেশকে।
এদিকে সদ্য প্রকাশিত সরকারের মধ্যমেয়াদি (২০২৫-২৬ থেকে ২০২৬-২৭) ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, পরিমাণ বেশি হওয়ায় নিম্ন থেকে প্রায় উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। বিশ্লেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, বৈদেশিক ঋণ সব সময় দেশের জন্য কল্যাণকর নাও হতে পারে । এ জন্য বৈদেশিক ঋণগ্রহণের আগে সুবিধা-অসুবিধা মূল্যায়ন করে এগোতে হবে। কারণ বৈদেশিক ঋণ দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি ঋণের শর্তাবলি কঠিন হয়, বা সুদ বেশি হয়। পরিশোধের জন্য বাংলাদেশকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহৃত হতে পারত। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং ভবিষ্যতে ঋণ পেতে সমস্যা হতে পারে। বৈদেশিক ঋণের একটি বড় অংশ অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় হলে, তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তেমন প্রভাব ফেলে না। বিনিয়োগকারীরা তাদের মুনাফা সহজে নিয়ে যেতে পারে, যা দেশের অর্থনীতি থেকে পুঁজি স্থানান্তরের ঝুঁকি তৈরি করে। কিছু ক্ষেত্রে, বিদেশি বিনিয়োগ স্থানীয় শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যদি তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারে।
কিছু বিদেশি বিনিয়োগ টেকসই নাও হতে পারে এবং পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক ঋণের ভারসাম্য বজায় রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারকে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যা বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে, কিন্তু একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে না। আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে, তবে তা যেন দেশের কল্যাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে হয়। অন্যদিকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রেও হিসাব করে নিতে হবে, যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যৎ অগ্রগতি বাধার সম্মুখীন না হয়।
লেখক : ব্যাংকার