কিছুদিন আগে যে রোহিঙ্গা ইস্যু আমাদের বেশ ব্যস্ত রেখেছিল, তা নিয়ে সম্প্রতি আমরা মোটামুটি নীরব রয়েছি। অবশ্য যেভাবে একের পর এক ঘটনা ঘটছে, তাতে শুধু পিলে চমকাচ্ছে না, কখনো কখনো বাকরুদ্ধ হওয়ার জোগাড় হচ্ছে।
এফ-৭ ফাইটার জেট ও প্রশিক্ষণ বিমান মাইলস্টোন কলেজের ওপর পতিত হওয়ার খবরে সারা দেশ শোকগ্রস্ত হলেও কিছু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
বিমান বাহিনী থেকে জানানো হয়েছে, প্লেন দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক, দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই, তবে এমন দুর্ঘটনা কেন ঘটে, তার কারণ আল্লাহ জানেন বলে জানানো হয়েছে। বিষয়টি অনেকটা এ রকম হয়ে গেল না আপনি দরজা-জানালা খুলে ঘুমাবেন আর সকালে উঠে বলবেন চোর কেন সব নিয়ে গেল, আল্লাহই ভালো জানেন। বিমান বাহিনী একদিকে বলছে, এটি দুর্ঘটনা, একই সঙ্গে বলছে এই বিমান পতিত হওয়ার কারণ তারা জানে না। তাহলে এটিকে আমরা দুর্ঘটনা বলব কি না সেটি একটি প্রশ্ন।
আরো যেসব প্রশ্ন সাবেক বৈমানিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনে ঘুরছে, তার কয়েকটি হলো ১. এটি যদি নিছক দুর্ঘটনাই হবে, এতগুলো প্রাণ চলে যাওয়ার দায় স্বীকার করতে বিমান বাহিনীর কেন এক দিন লেগে গেল?
২. বিমান বাহিনী যদি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনার প্রকৃত কারণ জানাতে না পারে, তাহলে আইএসপিআরকে বিমান বাহিনী থেকে এত দ্রুত কীভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো যে, যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য এমনটি হয়েছে?
৩. ১৭ বছর না হয় বিমান বাহিনীতে লুটপাট হয়েছে। দেশে প্রায় এক বছর ধরে যে সরকার আছে, তার কাছে বিমান বাহিনী কতবার দাবি জানিয়েছে, এসব প্রাণ হননকারী অনুপযুক্ত বিমান বাতিল করে যুগোপযোগী বিমান কেনার জন্য?
৪. বৈমানিক তৌকির বিমানে আরোহণ করার আগে সেই বিমানের লেজ থেকে মাথা পর্যন্ত, বাইরে থেকে ভেতর পর্যন্ত কে বা কারা পরীক্ষা করেছিল, সেই পরীক্ষা শেষে কে তৌকিরকে উড়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল?
৫. প্রশিক্ষণ বিমান জনবসতিপূর্ণ এলাকার বদলে জনমানবহীন এলাকায় ওড়ানো নিশ্চিত করতে না পারার দায় বিমান বাহিনী কীভাবে এড়াবে?
৬. পতিত বিমানের ব্ল্যাকবক্সের কথা ঘটনার এক সপ্তাহ পরও কেন অজানা রয়ে গেল?
প্রশ্নের তালিকা আরো দীর্ঘ করা যেতে পারে। বড় দুর্ভাগ্য, পেঁয়াজ-মরিচের দাম কেন আকাশছোঁয়া হয়, ধর্ষণের কেন বিচার হয় না, ফলে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর শাস্তি কেন হয় না, দায়িত্বে অবহেলার কারণে অন্যের প্রাণনাশের ঘটনা ঘটলেও পদ থেকে কেন পদধারী সরে যান নাÑএসব প্রশ্নের যেমন উত্তর মেলে না, তেমনি ১৯৯২ থেকে এ পর্যন্ত ঘটা ২৭টি প্রশিক্ষণ বিমান কেন দুর্ঘটনাকবলিত হলো, তার পূর্ণাঙ্গ জবাবও আমরা পাইনি।
১৯৯৮ সালে প্রশিক্ষক ফারিয়া লারা কিংবা ২০১০ সালে স্কোয়াড্রন লিডার আশরাফ ইবনে আহমেদ যে বৈমানিকই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিবারের তথা দেশের কাছে দুর্ঘটনার কারণ লুকানো হয়েছে বলেই আশঙ্কা তৌকিরের এভাবে চলে যাওয়ার কারণটিও হয়তো আমাদের অজানা রয়ে যাবে।
জিয়াউর রহমান ও বর্তমান বিএনপির রাজনীতিজিয়াউর রহমান ও বর্তমান বিএনপির রাজনীতি
ঘটনার রাতে আমার মতো অনেক শিক্ষকই নিশ্চয়ই ইমেইল পেয়েছেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা জানতে চেয়েছে, যেহেতু শোক দিবস ঘোষণা করা হয়েছে, সেহেতু আগামীকাল (২২ তারিখ) বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কি না। শোক প্রকাশের জন্য আমাদের ছুটি লাগে। কারণ, ১৭ বছরে তৈরি করা শোকপ্রকাশের সংস্কৃতি শিখিয়েছে শোক দিবস মানে হাঁড়ি ভর্তি খিচুড়ি রান্না, লাইন ধরে মারামারি করে সেই খিচুড়ি ভক্ষণ, তারপর মাইক বাজিয়ে গান করা এবং শহরের আকাশ ঢেকে স্তুতিমূলক বিলবোর্ড আর ব্যানার ঝুলিয়ে দেওয়া। আমাদের সন্তানদের শেখানো হয়নি যে, বারান্দার পাশে দুদণ্ড দাঁড়িয়ে কিংবা কাজের ফাঁকে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া ছোট্ট সাইন মারমা, মেহেনাজ, আফিয়া, কিংবা মাহেরিন ম্যাডামের মুখটা মনে করে তাদের জন্য প্রার্থনা করা যায়। ছোট্ট শিশুগুলোর মা-বাবার শূন্য বুকটা যেন এ শোক সইতে পারে, সে প্রার্থনা করা যায়।
এতসব ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নারী সমাজের নড়েচড়ে বসার মতো নির্দেশ দিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ। ভাগ্যিস, গভর্নর সাহেব অনলাইন নিউজ দেখায় অভ্যস্ত। বিদেশ থেকে তড়িৎ এক নির্দেশে জারি করা সেই নির্দেশ বাতিল না করলে এতক্ষণে শাহবাগ অবরোধ কিংবা শাপলা চত্বরে মানববন্ধন হতো। মজার ব্যাপার হলো, নির্দেশনাটি ছিল নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। উসকানিমূলক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হিসেবে তা চালিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু নারীকর্মীদের নাম দিয়ে।
পশ্চিমা ছোট পোশাক পরা কে, যারা আধুনিকতার ধারক মনে করেন, তাদের জন্য আফসোস হয় বটে। কারণ, ওয়ালমার্ট, আমাজন, আইবিএম, মাইক্রোসফট, জেপি মরগান চেস থেকে শুরু করে ব্যাংব অব আমেরিকা, রয়েল ব্যাংক অব কানাডা, টিডি ব্যাংকসহ বহু পশ্চিমা প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পালনকালে পেশাদার ও শালীন পোশাক পরিধান করা তাদের কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে অনেক আগেই। সিমন্স ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ড্রেস কোডের নিচে লেখা রয়েছে নারী কর্মীরা হাই হিল নয়, মিডিয়াম হিল অথবা জুতো পরবে। কানের দুল ছাড়া শরীরের অন্য যেকোনো অংশের পিয়ার্সিং এবং ট্যাটু ঢেকে রাখবে।
এমনকি আমেরিকার ফেডারেল সরকার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ, সিটি কাউন্সিলসহ বিভিন্ন দপ্তরে লেটেস্ট ফ্যাশন দেখানো যায় এমন পোশাকের বদলে সনাতন ও পেশাদার পোশাক পরার রীতি রয়েছে তাদের ড্রেস কোডের কারণে। এগুলো কিঞ্চিৎ জানা থাকলে আমাদের গভর্নর মহাশয় সম্ভবত এত তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতেন না। অবশ্য, তার সিদ্ধান্তের তারিফ করতেই হয়। কারণ, এই সিদ্ধান্তের ফলেই ঢাকাবাসী আজ বা আগামীকাল আন্দোলনের নামে আরেক দফা হয়রানিতে পড়া থেকে বেঁচে গেল। এখন অবশ্য যারা এহেন নির্দেশনার প্রস্তুতকারক, তাদের শাস্তির দাবি উঠেছে। এটি গভর্নর সাহেব সামলাবেন কেমন করে?
তবে আফসোস যে, বাংলাদেশ ব্যাংক জানে না এ জাতীয় নির্দেশনায় শুধু কী করতে হবে, তা লিখতে হয়। কী করা যাবে না, তা না লেখাই উত্তম। সেটি বিতর্ক তৈরির ইন্ধন জোগায়। যারা এটিকে ‘নারীদের জন্য নির্দেশনা’ হিসেবে চালিয়ে দিতে ব্যস্ত ছিলেন, তারা এর অস্পষ্ট বিষয়গুলো যেমনÑ‘পেশাদার রঙ’ বলতে এ নির্দেশনা কী বুঝিয়েছে, তার ব্যাখ্যা চাননি। দেশের যেসব প্রতিষ্ঠান ড্রেস কোডের মধ্যে ‘হিজাব’কে নিষিদ্ধ করেছে, তা নিয়েও তারা কিছু বলেন না। বিচিত্র বটে।
এত কিছুর মাঝখানে মানবাধিকার কমিশনের যাত্রা নিয়ে বাংলাদেশ যে ভীষণ শঙ্কা আর দোদুল্যমানতায় আছে, তা বলতে দ্বিধা নেই। একটি দেশে কেন মানবাধিকার কমিশন প্রয়োজন, সেই কমিশনের কর্মপরিধি কী হবে, এর আগে কোন কোন দেশে সেই কমিশন কী কী কাজ করেছে, সেসব কাজ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে দরকার কি না এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতি তথা সাধারণ মানুষের চেতনার সঙ্গে এই কমিশন তাল মিলিয়ে কাজ করতে সক্ষম কি নাÑএই প্রশ্নগুলোর উত্তরের জন্য কোনো সম্ভাব্য সমীক্ষা কি হয়েছিল? জাতীয় পর্যায়ে জরিপ ও নিরাপত্তা সংস্থা থেকে শুরু করে একাধিক সংস্থার মধ্যে আলোচনা হয়েছিল? নাকি সেই ভালুকের গল্পের মতো অবস্থা হতে যাচ্ছে আমাদের?
একবার এক ভালুক আর এক রাখালের খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বনের মধ্যে চলতে গিয়ে হঠাৎ রাখালের ঘুম পেল। ভালুককে সে বলল, কী করি বলতো বন্ধু? ভালুক বলল, ঠিক আছে বন্ধু, তুমি ঘুমাও। আমি তোমাকে পাহারা দিচ্ছি। তাই হলো। মাথার নিচে গামছাটা বিছিয়ে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আর ভালুক বসে আছে তার পাশে। এমন সময় একটা মাছি বারবার রাখালের মুখের কাছে উড়তে লাগল। কখনো মুখে বসে, কখনো নাকে, কখনো কপালে। ভালুক তাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু যতই তাড়ায়, ততই মাছি উড়ে রাখালের মুখে বসে। বন্ধুর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে দেখে ভালুকের মেজাজ খারাপ হয়ে যেতে লাগল। রাগ হয়ে সে বিশাল একটা পাথর তুলে নিল। মনে মনে বলল, ব্যাটা মাছি! এবার আয় দেখব কত পারিস। ঠিক এরপরই মাছিটা এসে বসল রাখালের মুখে। আর ভালুক আস্ত পাথর দিয়ে দিল এক বাড়ি। আর তারপর যা হওয়ার তাই হলো। পাথরের বাড়িতে রাখালের মাথা গেল থেবড়ে। মাছি গেল উড়ে। আর বন্ধু গেল মরে।
মানবাধিকারের নামে পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর দরিদ্র মানুষগুলোর নিজস্ব সহজ-সাবলীল জীবনধারা ও সংস্কৃতিকে পাল্টানোর ঔপনিবেশিক এজেন্ডা নিয়ে এই মিশন বাংলাদেশে আসছে না তো?
দেশের সার্বিক অবস্থায় দেশবাসীর প্রাণ রক্ষার্থে প্রাণহরণকারী ভালুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে না তো এ সরকার?
লেখক : শিক্ষক, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়