রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে মুক্তির পর খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী; স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতীক বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ৮১তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৫ সালের এদিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জন্মের এই সময়টা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক পরপর। তখন বিশ্বময় এক শান্তির পরিবেশ বিরাজ করছিল।
আজ এমন একটি সময়ে খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মবার্ষিকী তাকর্মীসহ দেশবাসী পালন করছে, যখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ নন। দিনটিতে দলের পক্ষ থেকে দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদিকে আনন্দের খবর হচ্ছে, এ সময়টায় বাংলাদেশ স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেশ গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটবে।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে খালেদা জিয়া কারাগারে বন্দি ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন ও দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর কারাগার থেকে পুরোপুরি মুক্ত হন তিনি। গণতন্ত্রের সংগ্রামে তার ত্যাগ অপরিসীম। এই ত্যাগ বৃথা যায়নি। ইতিহাসে তার এ ত্যাগ অনন্য ঘটনা হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম-এর শাহাদাতের পর ১৯৮২ সালে তার সহধর্মিণী হিসেবে খালেদা জিয়া জনগণের আহ্বানে সাড়া দিয়ে একজন সাধারণ গৃহবধূর জীবন থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন। এরপর তিনি রাজনীতি আলোড়িত ও আলোকিত করেন। জেনারেল এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন গণতন্ত্র মুক্তির বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম। জনগণ তাকে রাজপথেই ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। দেশবাসীর কাছে তিনি হয়ে ওঠেন ‘দেশনেত্রী’।
নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মতো ১/১১-র মইন-মশহুদ চক্রের সেনাসমর্থিত সরকারের বিরাজনীতিকীকরণ চক্রান্তের বিরুদ্ধেও হিমালয়সম দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন অসামান্য এই নারী, খালেদা জিয়া। তার সেই দৃঢ়তাই অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত হতে সাহস ও শক্তি জুগিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধেও তিনি দুর্বার লড়াই করেছেন। অন্যায়ের কাছে তিনি মাথানত করেননি। এভাবেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সব দুর্যোগ এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়া নিজেকে অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বলন করে রেখেছেন।
তার এ ভূমিকাকে স্তব্ধ করে দিতে হাসিনার সরকার তার ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। তাকে ৩৭টি মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক মামলায় জড়িয়ে সীমাহীন অমানবিক নির্যাতন করা হয়। জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের মামলায় ফরমায়েশি রায়ে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তাকে জেলে নিয়ে সরকার নীলনকশা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে ২০১৮ সালে ‘নিশিরাতের ভোট’ ও ২০২৪ সালে ‘ডামি নির্বাচন’ সম্পন্ন করে। এ দুটি ভুয়া নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে সম্পন্ন করেছিলেন ‘বিনা ভোটের’ সেই কলংকিত নির্বাচন। ১/১১-র সেনাসমর্থিত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা জবরদখল করেছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর তিনি আর ক্ষমতা ছাড়েননি। এ সময় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়। সুশাসন নির্বাসনে চলে যায়। আইনের শাসন বলতে দেশে কিছুই ছিল না। নির্বাচনি ব্যবস্থা তছনছ হয়ে যায়।
শুধু ক্ষমতা দখলই নয়, বিএনপি এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ওপর হাসিনা সরকারের অত্যাচার-নির্যাতন সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেখ হাসিনার গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও অপশাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া দেশব্যাপী এমন দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন যা ইতোপূর্বে দেশে হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে সে আন্দোলন তখন সফলতা পায়নি।
ফ্যাসিবাদী সরকার গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণহত্যা, ঢালাও মামলা দিয়ে রাজধানী ঢাকাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। তারপরও শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন খালেদা জিয়াকে বন্দি করা না হলে পরবর্তী নির্বাচন নিজের মতো করা দুরূহ হয়ে উঠবে। তাই তিনি সাজানো মিথ্যা মামলায় দণ্ডের ব্যবস্থা করে ২০১৮ সালে খালেদা জিয়াকে জেলে বন্দি করেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে ২০১৭ সালের ১৯ ও ২৬ অক্টোবর বকশিবাজারের আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় এক মর্মস্পর্শী জবানবন্দি দেন খালেদা জিয়া। আদালতে তিনি বলেন, ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টকে কেন্দ্র করে আমিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলার সব অভিযোগ সম্পূর্ণ কাল্পনিক ও পুরোপুরি বানোয়াট। সব অভিযোগ স্ববিরোধী বক্তব্যে ভরপুর।
এ ট্রাস্টের অর্থায়ন, পরিচালনা ও অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে আমার নিজের ব্যক্তিগতভাবে বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালনকালে সম্পর্ক ছিল না এবং এখনো নেই। দুদকের আইনগত কর্তৃত্ব ও এখতিয়ারের বাইরে এ মামলা করা হয়েছে। এ ভিত্তিহীন মিথ্যা মামলায় বিচারের নামে দীর্ঘদিন ধরে আমি হয়রানি, পেরেশানি ও হেনস্তার শিকার হয়েছি।’
জেলে থাকাকালে খালেদা জিয়াকে উপযুক্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ আড়াই বছর তিনি নির্জন, স্যাঁতসেঁতে কারাগারে থাকার ফলে অনেকগুলো ব্যাধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। সেখানে চিকিৎসার সুযোগ ছিল না।’ তখন অভিযোগ পাওয়া যায় যে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে স্লো পয়জনিংও করা হয়েছে। নির্বাহী আদেশে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে অন্তত পাঁচবার বিদেশে চিকিৎসার জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে বিদেশে যেতে দেননি।
এভাবে চিকিৎসাবঞ্চিত এবং জেল-জুলুম সহ্য করেও খালেদা জিয়া তার নীতিতে অটল, অনঢ় থাকেন। জেলে যাওয়ার আগে তিনি দলের নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে যান যে, ‘বিপদে ভেঙে পড়তে নেই। বিপর্যয় কেটে যাবে। এদেশের ছাত্র-জনতা কখনোই অন্যায় মেনে নেয়নি। তারা এর প্রতিবাদ করবেই। গণতন্ত্র ফিরে আসবেই।’ তার সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনার পতন হয়েছে এবং তিনি ভারতে পালিয়েছেন সদলবলে।
দখলদার হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন আজ ছাত্র-জনতার রক্তঝরা সংগ্রামে অবসান হয়েছে। ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এ বিজয় ছিল খালেদা জিয়ার সূচনা করা পনেরো বছরের আন্দোলনেরই ফসল। মুক্ত খালেদা জিয়া এক যুগ পর ২১ নভেম্বর ২০২৪ সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে গিয়েছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই অনুষ্ঠানে তার ভাষণে বলেন, ‘এক যুগ ধরে খালেদা জিয়া এই মহাসম্মেলনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাননি। আমরা সবাই আনন্দিত ও গর্বিত যে, আপনাকে সেই সুযোগ দিতে পেরেছি।’ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারাও তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মুক্ত হওয়ার পর খালেদা জিয়া লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান। কাতারের আমিরের বিশেষ বিমানে লন্ডন যাওয়ার সম্মান পান তিনি। লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা হয়। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্যে গণতন্ত্রে উত্তরণের আহ্বান জানান। দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রকামী মানুষের মনে সৃষ্টি হয় নতুন আশা। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়া মাদার অব ডেমোক্রেসি বা ‘গণতন্ত্রের মাতা’ হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছেন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আমার দেশ