মাঠ ঘুরে এলাম ৯ থেকে ১০ দিন। রাজশাহী শহর, শহরসংলগ্ন উপকণ্ঠ এবং গ্রাম। সরেজমিন দেখলাম, স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মীরা কেমন আছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপ হলো। নেতাদের দেখা পাইনি। কর্মী আর সমর্থকদের পেলাম। নেতারা বেশির ভাগ দেশছাড়া। অধিকাংশই ভারতে। পলাতক নেতারা কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন, খোঁজখবর নেন। কিন্তু তাঁরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সেই সম্পর্কে কিছুই জানান না। শুধু কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের ভেতর যোগাযোগ রক্ষা করেন। এ যোগাযোগ চলে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। শেখ হাসিনার শাসন নিয়ে তাঁদের ভেতর কোনো অনুশোচনা বা দুঃখবোধ চোখে পড়ল না; বরং তাঁর শাসনের পক্ষে তাঁরা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।

আওয়ামী লীগের একটি ‘বড় অর্জন’

আওয়ামী লীগের একটি বড় অর্জন এই যুক্তিবোধহীন সমর্থকশ্রেণি তৈরি। তাঁরা শেখ হাসিনার কোনো সমালোচনা শুনতে পছন্দ করেন না বা সমালোচনা করতে চান না।

উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা বললেন, কথায় কথায় শেখ হাসিনার সমালোচনা করা ফ্যাসিস্ট বলাটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। এই নেতার অনুযোগ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য হলো আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা সহজেই শেখ হাসিনার সমালোচনা করেন। কিন্তু বিএনপির সমর্থকেরা তারেক জিয়ার কোনো সমালোচনা করেন না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জামায়াতের ভালো-মন্দ দিক, নির্বাচন এবং নির্বাচন হলে কে ক্ষমতায় আসবে, মাঠেঘাটে তা ঘিরে আলোচনা চলছে। সংস্কার নিয়ে কোনো আলোচনা কানে এল না।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট বৈষম্যহীন বাংলাদেশে বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব মাঠে খুঁজে পেলাম না। মাঠে যা পেলাম, তা হলো শেখ হাসিনা–পরবর্তী রাজনৈতিক পুনর্বাসনের জন–আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষায় বিএনপির অবস্থান অগ্রগণ্য।

ঢাকার বাইরে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা

একটি পর্যবেক্ষণ হলো, গণ–অভ্যুত্থানের চেতনা ঢাকার বাইরে নেওয়া সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়াকে স্থানীয় জনগণ গণ–অভ্যুত্থানের মুখে একটি সরকারের পতন হিসেবেই দেখছে। গণ-অভ্যুত্থানের মর্মবাণী ঢাকার ফ্রেমে আটকে আছে। এটা মর্মান্তিক ব্যাপার। ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ বা ‘নতুন বয়ান’ কিংবা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন মাঠেঘাটে নেই।

স্থানীয় জনগণ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় জনগণ বিএনপিকে আগামী দিনের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। গ্রামীণ রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে জনগণ বিশেষ কিছু ভাবছে না। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক আচরণের অভ্যস্ততা কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; জীবন-জীবিকা, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা মাড়িয়ে এর শিকড় অনেক গভীরে। জনগণের ক্ষমতাপ্রিয়তা বা ক্ষমতাসখ্যের তীব্র অনুভূতি প্রচলিত রাজনীতির একটি বিশেষ দিক, যার ভিত্তি হলো রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক এক বিশেষ সুবিধাবাদী ব্যবস্থা। মতাদর্শের চেয়ে অনেক বেশি অনুগামী ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে।

নতুন দল নিয়ে তৃণমূলে ভাবনা

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গঠন ও ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় জনগণের অভিমত হলো, তারা দল না করে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকলেই ভালো হতো। দল গঠনের ব্যাপারে জনগণ তাদের তাড়াহুড়া দেখেছে। তাদের মন্তব্যে এনসিপি দল দ্রুত গঠিত হয়েছে। তারা নির্বাচন করতে চায় এবং ক্ষমতায় যেতে যায়। কিন্তু গ্রামের ভোট এনসিপির বাক্সে আনা সহজ হবে না। কারণ, গ্রামের মানুষের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংযুক্তি, তার বাইরে আনা কঠিন।

গ্রামীণ পরিসরে নাগরিক বোধ সেই অর্থে বিকশিত হয়নি। মানুষ আছে বড় আকারের দলা হয়ে। এই দলা বালুর দলার মতো ঠুনকো। সামান্য আঘাতে এলোমেলো হয়ে যায়। আমাদের চাওয়া ছিল এঁটেল মাটির দলা, যূথবদ্ধ সামাজিক বিন্যাস। কিন্তু সামাজিক ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। সম্পর্কগুলো ভীষণভাবে হালকা হয়ে উঠছে। পরিশীলিত রাজনৈতিক বোধ ও দায়িত্বশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই দায় সবার। জনগণের ভেতর বিদ্যমান ক্লেদাক্ত রাজনীতি লকলকে জিব বের করছে। এর শেষ কোথায়!

সুইডিশ লেখক ও ইতিহাসবিদ জোহান্স নর্গবাগ বলেছেন, গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতিতে মানুষ সম্ভাবনা নয়, সুরক্ষা খুঁজে। তিনি ‘দ্য প্রোগ্রেস’ গ্রন্থে এই ধারণা তুলে ধরেন। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে কথোপজীবী শ্রেণি গড়ে উঠল, তারাও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সম্মেলনকক্ষের অনুরাগী। বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের সামাজিক কোনো রূপান্তর গ্রামীণ পরিসরে দেখা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল গুটিকয় শহরের সমষ্টি নয়। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গ্রামের মানুষদের যুক্ত করা না গেলে তা বিশেষ কোনো ফল আনবে না।

আরেকটি বিষয় হলো, শাসন যত ভালো হোক না কেন, তা যদি জনগণের মনে স্বস্তি তৈরি না করে, তবে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না। শেখ হাসিনার পতনের মূলে রয়েছে জন–অসন্তুষ্টি। উন্নয়ন একটু কম হলেও সমস্যা নেই। মানুষ স্বস্তি চায়। ৫ আগস্ট–পরবর্তী মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, হানাহানি, কলহ, ক্ষেত্রবিশেষে খুনোখুনির অভিযোগ উঠছে। মানুষ শেখ হাসিনাকে তাড়িয়েছে একটু স্বস্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদার আশায়। বাস্তবে জনপরিসরে নতুন করে অস্বস্তি বাড়ছে।

পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের ওপর সেই খড়্গ নামছে প্রতিনিয়ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ একবার পরাজিত হয়েছে। সেই অবধি আওয়ামী লীগকে প্রতিদিন পরাজিত করার চেষ্টা হচ্ছে। একটি বড় জয়ের পর আর কোনো ছোট জয় থাকতে পারে না। যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যের বিচারের ভার নিজ হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

ফ্যাসিস্ট তাড়ানোর পর বহুমাত্রিক অভিঘাত

পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের ওপর সেই খড়্গ নামছে প্রতিনিয়ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ একবার পরাজিত হয়েছে। সেই অবধি আওয়ামী লীগকে প্রতিদিন পরাজিত করার চেষ্টা হচ্ছে। একটি বড় জয়ের পর আর কোনো ছোট জয় থাকতে পারে না। যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যের বিচারের ভার নিজ হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

বিজয়ীদের ঔদ্ধত্য বাড়ছে। উদ্ধত আচরণ জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। বিজয়ী কতটা উন্নত, তা বোঝা যায় বিজিতের প্রতি সে কেমন আচরণ করে তা দিয়ে। বিজয়ের স্বাদ বিজিতদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া কাজের কথা হতে পারে না। বিজয় উদ্‌যাপনের চেয়ে তার মর্মকে বাস্তবে রূপ দেওয়া জরুরি কাজ। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো, সমাজের গভীর ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা দরকার। আন্তসম্পর্কের গভীর নেতিবাচক অভিঘাত নিয়ে কোনো সমাজ বেশিদূর এগোতে পারে না।

ফ্যাসিস্ট তাড়ানোর বহুমাত্রিক অভিঘাত পড়েছে সমাজের নানা স্তরে। গ্রামের একজন সাধারণ আওয়ামী লীগ সমর্থকও তা পদে পদে অনুভব করছেন। ক্ষমতাহীনতার তিক্ত স্বাদ এবং অসহায়ত্ব তাঁদের পেয়ে বসেছে। পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দুয়ারীবাজারের এক আওয়ামী লীগ সমর্থক জানান, অনেক মামলা তাঁর। এতে তাঁর সমস্যা নেই। সমস্যা হলো ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে। আর অর্থনীতি শেষ হয়ে গেলে মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। অর্থনীতি ও রাজনীতি কীভাবে মিলেমিশে গেছে, তার চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন তিনি।

নিছক রাজনৈতিক সমর্থন ও দলীয় সম্পৃক্ততার কারণে কাউকে রাজনৈতিক, সামাজিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানি করা যাবে না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই চলছে। এতে সামাজিক সংহতি ও সহাবস্থানমূলক সম্পর্কে ব্যাপক ফাটল ধরেছে। ফ্যাসিস্ট তাড়ানোর মাইক্রো–ইমপ্যাক্ট কত গভীরে, তা বুঝতে মাঠে পাওয়া কয়েকটি ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো।

ব্যাংকঋণ ‍নিয়ে মামলার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা জানান, তৎকালীন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তাঁকে ক্ষমতার শেষ দিকে উপজেলা কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন। তিনি তা নিতে চাননি। পদ পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মাথায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীরা তাঁর নামে মামলার হুমকি দিতে থাকেন। মামলা থেকে বাঁচতে চাঁদা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। মামলা-মোকদ্দমার ঝক্কি এড়াতে তিনি ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঋণ নেন। নেতাদের চাঁদা দিয়ে তিনি মামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী এই নেতা ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও সংসার চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন।

টুপি ও পাঞ্জাবি যখন মুক্তির দাওয়াই

মাঠে দেখা হলো একজন পরিচিত আওয়ামী সমর্থকের সঙ্গে। বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আলোকছত্র এলাকায়। তাঁর পোশাক-আশাকে ব্যাপক পরিবর্তন দেখলাম। তিনি টুপি ও পাঞ্জাবি পরেছেন, নিয়মিত নামাজ পড়ছেন।

পোশাক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানান, নিরাপত্তা, হুমকি ও মামলা থেকে বাঁচতে তিনি এই পরিবর্তন এনেছেন। তিনি আরও জানান, এতে তাঁর সমাজে মর্যাদা বেড়েছে। অনেকে সালাম দেন, সম্মান করেন।

গভীর নলকূপের অপারেটর পরিবর্তন

৫ আগস্টের পরপর তানোর-গোদাগাড়ী উপজেলা প্রায় সব গভীর নলকূপের অপারেটর পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থকেরা অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে তাঁদের নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। একটি গভীর নলকূপের অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেতে এক লাখ টাকা উপরি গুনতে হয়েছে।

বরেন্দ্র এলাকার গভীর নলকূপ কেবল সেচের উৎস নয়, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বড় পাওয়ার হাউস। কারণ, এটি সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষক নতুন করে অপারেটরদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয় জনগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছেন। প্রচলিত রাজনীতির ঘেরাটোপের ভেতরই তাঁরা রয়েছেন। তার ভেতরেই তাঁরা যা খুঁজছেন, তা সুরক্ষা, সম্ভাবনা নয়। গ্রামের মানুষ পরিবর্তন আশা করে। কিন্তু সেটা কত দূর, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নন।

খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক

সূত্র,প্রথম আলো