বিশ্বব্যাপী চলমান হানাহানি-মারামারি, যুদ্ধবিগ্রহ প্রত্যক্ষ করিয়া অনেকে আধুনিক সভ্যতার উপর বিষোদ্গার করিয়া থাকেন। তাহাদের সোজাসাপটা অভিযোগ হইল, 'তথাকথিত বিশ্বসভ্যতা'ই জাতিগুলিকে ক্রমাগত যুদ্ধের দিকে ঠেলিয়া দিতেছে। ঘরে ডাকাত পড়িলে তাহার সহিত মিষ্ট এবং শিষ্ট আলাপ করা সম্ভবত কেবল ফেরেশতার পক্ষেই স্বাভাবিক এবং মানুষ যেইহেতু ফেরেশতা নহে, অতএব সকলে সভ্যতার উপরেই দোষ চাপাইতে চাহিবেন; কিন্তু প্রশ্ন হইল, নিষ্কলুষ ছিল কোন যুগ, কোন কাল?
প্রাচীন বা মধ্যযুগ কি সংঘাতমুক্ত ছিল? আমরা বরং যুদ্ধবিগ্রহের কার্যকারণ খুঁজিতে স্মরণ করিতে পারি ফরাসি লেখক ভিক্টর হুগোর উক্তিটি; তিনি বলিয়াছেন, 'শান্তি সভ্যতার গুণ, যুদ্ধ তাহার অপরাধ।'
করোনা মহামারির বিভীষিকাময় দিনগুলির কথা আমরা যেন সত্যিই ভুলিয়া গিয়াছি! অথচ সেই করোনা আবারও হানা দিতেছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। এইখানে অবধারিতভাবে প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, শত শত মাইল দূরে বসিয়া আমরা যেইখানে শত্রুপক্ষের একেবারে বেডরুমে পর্যন্ত মিসাইল মারিতেছি 'খুবই নির্ভুলভাবে', সেইখানে ক্ষুদ্র ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে কেন পরাস্ত করিতে পারিতেছি না? কোভিড-১৯ আমাদের সভ্যতাকে অস্তিত্বের মুখে লইয়া গিয়া দাঁড় করাইয়াছিল-যাহার বিপদ এখনো কাটে নাই, অথচ আমরা কি না সেই অতিকায় ক্ষুদ্র অণুজীবকে এখনো পরাস্ত করিতে পারিলাম না! ইহার কারণ কী?
প্রতিনিয়ত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগুলি নূতন নূতন যুদ্ধ-ফ্রন্ট খুলিয়া বসিতেছে, একে অন্যকে ঘায়েল করিবার জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সমরাস্ত্র তৈরি করিতেছে। অথচ পরিতাপের বিষয় এই যে, মানবতাকে বাঁচানোর জন্য যথাযথ ভ্যাকসিন বা টিকা বানানোর মতো পর্যাপ্ত সময় বা অর্থ যেন তাহাদের হাতে নাই! যুদ্ধে প্রতিদিন বিলিয়ন ডলার ব্যয় হইতেছে, অত্যাধুনিক সকল ল্যাব বসানোর কর্মযজ্ঞ চলিতেছে, কীভাবে হাজার মাইল পাড়ি দিয়া শত্রুঘাঁটিতে নির্ভুল হামলা চালানো যায়, সেই মাত্রা বা পাল্লার অস্ত্র তৈরিতেই বিজ্ঞানীরা অধিক সময় ব্যয় করিতেছেন। ইহার ফলাফলও যাহা হওয়ার তাহাই হইতেছে-একদিকে বুলেট-বোমা, মিসাইল; অন্যদিকে রোগব্যাধি, অকাল-দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসের শিকার হইতেছে বিশ্ব।
স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্ব কেমন হইতে পারে, সেই সম্পর্কে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন তাহার 'সভ্যতার সংঘাত' বা 'ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস' তত্ত্বে উল্লেখ করেন, 'আগামীর পৃথিবীর দ্বন্দ্ব-সংঘাত কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ বা অর্থনৈতিক কারণে হইবে না, বরং ইহার কারণ হইবে সংস্কৃতি ও ধর্ম।' হান্টিংটনের তত্ত্বটি আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহের কার্যকারণ হিসাবে সর্বমহলে গ্রহণীয় নহে-ইহা লইয়া বিস্তর সমালোচনা রহিয়াছে!
ইহার বিপরীতে বরং লক্ষণীয়, আজিকার বিশ্বের অধিকাংশ যুদ্ধ সংঘটিত হইতেছে 'অর্থনৈতিক' বা 'ভূরাজনৈতিক' কারণে। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, আধুনিক সভ্যতা বিকশিত হইয়াছে শিল্পবাণিজ্যের উপর ভর করিয়া; অর্থাৎ, জাতিগুলির ব্যবসায়-বাণিজ্য, তথা অর্থনীতি লইয়া ব্যস্ত থাকার কথা। দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ লাগিয়াই রহিয়াছে; ন্যায়-অন্যায়ের বালাই নাই, নাই আইনের প্রয়োগ বা তোয়াক্কা। এইখানে শক্তিই যেন সকল- 'মাইট ইজ রাইট'। যে যেইভাবে পারিতেছে, নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য শক্তির প্রয়োগ ঘটাইতেছে। জাতিগুলি এইরূপ আচরণ কেন করিতেছে, তাহা লইয়া কি কোনো গবেষণা হইতেছে; সেই সময় কি আমাদের আছে?
বহু মানুষ একত্রিত হইয়া, বহু দিন ধরিয়া কায়মনোবাক্যে যেই সভ্যতা গড়িয়া তুলিয়াছে, তাহার ভিতর যে মনুষ্যত্ব নাই, ইহা হইতে পারে না। অধিকন্তু, পৃথিবীতে এমন কোনো সত্যতা নাই, যাহা অমানবিক ছিল। এই অনুযায়ী বিচার করিলে, জাতিগুলির যুদ্ধোন্মাদ হইয়া উঠিবার কারণ হিসাবে সভ্যতাকে যতটা না দায়ী করা যায়, তাহার চাইতে অধিক দায় বর্তায় মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত-অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের উপর। আমরাই সভ্যতাকে গড়িয়া তুলিয়াছি, উহা পরিচালনার চাবিও আমাদের হাতেই; সুতরাং, সভ্যতার বিনাশ হইলে তাহা আমাদের হাত ধরিয়াই হইবে। সুতরাং, আমাদের অবিলম্বে সিদ্ধান্ত লইতে হবে, আমরা কি সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নের মুখে ফালাইয়া দিব, মারণাস্ত্র তৈরি করিয়া যুদ্ধোন্মাদ হইয়া উঠিব? সভ্যতা বা নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নে ইহার উত্তর অন্বেষণ আজ অনেক বেশি জরুরি।