এমন কঠিন বাস্তবতার নিরিখে কিছু জায়গায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত জরুরি। তা সনদ, দলিল, ঘোষণা যেভাবে হোক। সব সংস্কারে সবাই একমত হয়ে যাবেন, তা মনে না করা শ্রেয়। ন্যূনতম বা মৌলিক বিষয়ে একমতে আসতে না পারলে পুরনো বন্দোবস্ত নিয়তির মতো ললাটের লিখন হতে বাধ্য। সেই উপলব্ধিটা আরোপ করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। ভেতর থেকে তাগিদ না এলে সংস্কার, সনদ, ঘোষণা নিরর্থক হবে।

ফয়সালা বা বন্দোবস্ত কিছু একটা হচ্ছে। আপাতত তা এড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু, এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ ও প্রতিক্রিয়ায় সংশয় দেখা দিয়েছে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে। কথা দিয়ে কথা না রাখা, রূপরেখায় একাত্ম হয়েও তা বেমালুম ভুলে যাওয়া, বিপরীত কাজে মত্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত মানুষের কাছে টাটকা বিষয়ের মতো। আগামীর দলিল বা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন কেমন হতে পারে- এ বিষয়ে মানুষের কিছু ধারণা জন্মেছে।

রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশনের আনা প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পরিমাণ ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি হবে। ধরা যাক, সেটি সম্পন্ন হলো। বাস্তবায়ন করবেন কে? কখন করবেন? কীভাবে করবেন? গত ক’দিনের নমুনা বলছে, সামনের সরকার তার মতো করে সেই দলিল-সনদ দেখবে। ক্ষমতার বাইরের দলগুলো চাপ দেবে, মনে করিয়ে দেবে। তাও নিজেদের মতো করে। দলগুলোকে দেয়া সনদের খসড়া ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে গোলমাল বাধার খবর মানুষকে ব্যথিত করছে।

জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ কিছু দল এখন সমরৈখিকে। তা প্রকাশ্যে জানানো হয়েছে। সংস্কার নিয়ে কথা চলছে ১০ মাস ধরে। অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন হয়। কমিশনগুলো প্রতিবেদন দেয় গত ফেব্রুয়ারিতে। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর পর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো দুই ভাগে ভাগ করে ঐকমত্য কমিশন। এর মধ্যে আইনবিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব, এমন অনেক সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আর ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সাথে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন।

প্রথম পর্বে ৩৩টি দল ও জোটের সাথে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পৃথক আলোচনা করে কমিশন। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি, এমন ২০টির মতো মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসাথে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কারের ক্ষেত্রে এ প্রস্তাবগুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বে এখন পর্যন্ত ১৩টি বিষয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিরোধের মধ্যে বিএনপি থেকে ক্ষোভের সাথে জানানো হয়েছে, সংস্কারের নামে খানাপিনা বেশি হচ্ছে। কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। এর পরও কাজ চলছে। হচ্ছে বৈঠকের পর বৈঠক।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, নির্বাচন পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে কোনো কথা শেষ হয়েও হয় না শেষ। কথা থেকে যায়। আবার কিছু বিষয়ে একমত হওয়ার তথ্যও জানানো হয়। দ্বিতীয় পর্বে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন; সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন; সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ; রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান; হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলা পর্যায়ে নিম্ন আদালত স্থানান্তর; সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি; জরুরি অবস্থা জারিসংক্রান্ত; প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; ইসি গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা হবে; পুলিশ কমিশন গঠন; প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান।

এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছে, একই ব্যক্তি একসাথে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না, এ প্রস্তাবে তিন-চতুর্থাংশ দল একমত এবং সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব। এগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে বিএনপিসহ যারা একমত হয়নি, তারা জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিতে পারবে। ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনে ন্যূনতম ৫ শতাংশ বর্ধিত হারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন অব্যাহত থাকবে। এটিও সংবিধানে যুক্ত হবে। সংরক্ষিত নারী আসন ২০৪৩ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০টি থেকে বাড়িয়ে ১০০টি করা এবং সেখানে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করেছিল সংস্কার কমিশন। সংস্কারের মাঝে মৌলিক-যৌগিক ভাগও রয়েছে। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে জোরালো আপত্তি আছে বিএনপির। তারা এ সংক্রান্ত বিধান সংবিধানে যুক্ত না করে আইনের মাধ্যমে নিয়োগ করার পক্ষে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে দলগুলো একমত হলেও উচ্চকক্ষের নির্বাচনপদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা আছে। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে অর্থাৎ সারা দেশে একটি দল যত ভোট পাবে, তার অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন পাবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশির ভাগ দল এ প্রস্তাবে একমত। তবে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের এতে আপত্তি আছে। উচ্চকক্ষের ক্ষমতা কী হবে, তা নিয়েও মতভিন্নতা আছে। এমন পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে কমিশনকে একটি সিদ্ধান্ত দেয়ার ভার দেয়া হয়েছিল।

রাষ্ট্রের মূলনীতি প্রশ্নে দলগুলোর মধ্যে বেশ বিভক্তি। এসব বিভক্তি জিইয়ে রেখে আগামীতে তা কোথায় গড়াবে, এ নিয়েও কথা আছে। বর্তমান এবং সদ্য অতীত নিয়ে চলছে নানান ফ্যাকড়া। জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী ছিল- প্রশ্নটি নতুন করে টেনে আনা হয়েছে। এতে কার কৃতিত্ব বেশি- এ বিতর্ক দোষের নয়। ভালো কিছুর কৃতিত্ব নেয়ার একটি অভিপ্রায় সবার মধ্যে কাজ করে। সেটা করতে গিয়ে আক্রমণ এবং একসময়ের সহযোগী দলকে ফ্যাসিস্টের দোসর বানিয়ে ফেলার চর্চা সামনে ভিন্ন কিছুর বার্তা দিচ্ছে।

কে না জানে, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে এসে আন্দোলন দমনে কত কঠোর হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কারফিউ জারি, দেখা মাত্র গুলির হুকুম কি বাদ ছিল? সেই সাথে বিএনপি-জামায়াত, কোটাবিরোধী ছাত্রদের দমনে ছাত্রলীগ-যুবলীগ যথেষ্ট- এ ঘোষণা তো ছিলই। এক বছর আগের সেই বেদনা অনেকটা ভুলে যাওয়ার মানসিকতা লক্ষণীয়। কারো কারো বক্তব্য-বিবৃতিতে মনে হয় না কোন পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে এমন অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ ১৪০০’র বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হন। তাদের জীবনদান ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালাতে বাধ্য হয়। সেই নিদারুণ বাস্তবতায় প্রথাগত কিছু সংস্কার ও বন্দোবস্ত অবশ্যই কাম্য। রাষ্ট্র-কাঠামো পুনর্গঠনের অভিপ্রায় সেখানে। বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা শান্তি ও গণতন্ত্রকামী সবার দায়িত্ব। কিন্তু, সেখানে এখন মন-মননের এত বিভক্তি, কথার প্যাঁচ! আবার মাঝে মধ্যে সরকারও আক্রমণের শিকার। সরকারের ভেতর আরেকটি সরকারের অস্তিত্বও দেখছেন কেউ কেউ।

তার ওপর যোগ হয়েছে চাঁদাবাজি। প্রায় প্রতিটি জেলায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি মহামারী আকার নিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে এসব ঘটনায় পতিত সরকারি দলের নেতাকর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত। গণ-অভ্যুত্থানের পর সেই দলটির নেতাকর্মীরা হয় আত্মগোপনে, নয় কারাগারে। তা হলে এসব চাঁদাবাজি কে বা কারা ঘটাচ্ছে, এ প্রশ্ন যৌক্তিক। সব সরকারের আমলে পেশাদার চাঁদাবাজরা যে কোমর বেঁধে নেমেছে, তাও সত্য। তা হলে মানে কী দাঁড়াল? আগে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে এসব রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা চাঁদাবাজরা রং বদল করে ক্ষমতাসীন দলে ভিড়ে যেত। তারা নিজেদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ভাবতে পছন্দ করত।

এখন তো রাজনৈতিক সরকার নেই। ক্ষমতায় থাকা ইউনূস সরকারের তো দল নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটি এতটাই বিধ্বস্ত যে তাদের নেতাকর্মীদের পক্ষে পোশাক বদল করে মাঠে থাকা অসম্ভব। নৌকার ঢোল বাজিয়ে, মুজিব কোর্ট গায়ে জড়িয়ে চাঁদা বখরার বাস্তবতা নেই। অবস্থা বুঝে তারা সওয়ার হয়েছে দেশের বড় দলটির ঘাড়ে। সেখানেও বহিষ্কারসহ নানা শাস্তি। এই কঠিনের মধ্যেও পেশাদাররা দমছে না। কোনো না কোনো ডালপালা ধরছে।

এমন কঠিন বাস্তবতার নিরিখে কিছু জায়গায় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত জরুরি। তা সনদ, দলিল, ঘোষণা যেভাবে হোক। সব সংস্কারে সবাই একমত হয়ে যাবেন, তা মনে না করা শ্রেয়। ন্যূনতম বা মৌলিক বিষয়ে একমতে আসতে না পারলে পুরনো বন্দোবস্ত নিয়তির মতো ললাটের লিখন হতে বাধ্য। সেই উপলব্ধিটা আরোপ করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। ভেতর থেকে তাগিদ না এলে সংস্কার, সনদ, ঘোষণা নিরর্থক হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সূত্র, নয়া দিগন্ত