সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রার্থীরা ধারণার চেয়েও বেশি ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছে। তাদের প্যানেলে, এমনকি তাদের প্যানেলের বাইরেও হিজাবধারী বেশ কয়েকজন প্রার্থী বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। ধারণা করা হতো, ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের প্রতি নারীদের আস্থা কম। এই নির্বাচনে সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে প্রতিটি ছাত্রাবাসেই নারী ভোটাররা একতরফা ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের সমর্থন দিয়েছেন। ফল ঘোষণার সময় ইসলামপন্থিদের বিজয়ে বিভিন্ন হলে ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস করতেও দেখা গেছে। এই ছাত্রীদের একটি অংশ হিজাব করে। আবার একটি বড় অংশই হিজাব করে না। তবে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে জেন-জি প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা তথাকথিত প্রগতিশীলদের মতো হিজাবের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না।
হিজাব ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতীক। পাশ্চাত্যের জনমানসে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটে হিজাবের বিরোধিতার মাধ্যমে। তাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে হিজাব নারীকে অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে আটকে রাখে; আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিজাবের স্থান নেই। তাই তো হিজাব পড়ার অপরাধে তুর্কি এমপি মারওয়া কাবাজ্জির সংসদ সদস্যপদ খারিজ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, তার নাগরিকত্ব পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল। তুর্কি জনগণ পরে ভোটের মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছেন। মারওয়াকে তার নাগরিকত্ব ও সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছে। হিজাব এখন আলোকিত নারীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া কোনো বিষয় নয়, বরং মুসলিম নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত পছন্দ। হিজাব পরা বা না-পরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অংশ। একজন নারী হিজাব পরে যেমন উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারেন, তেমনি কর্মক্ষেত্রেও সফল হতে পারেন। অর্থাৎ হিজাব নিজে কোনো অন্তরায় নয়। হিজাবধারী প্রার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিপুল সমর্থন এই ধারণাকে আরো শক্তিশালী করেছে।
শিক্ষাঙ্গন ও কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং সামাজিক অগ্রগতি আজকের বিশ্বে অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয়। পাশ্চাত্যের মতবাদে প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ মনে করেন, হিজাব নারীর স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। আবার অনেকে বলেন, এটি শুধু শালীনতার প্রতীক এবং প্রগতির পথে কোনো প্রতিবন্ধক নয়। বাস্তবে বিষয়টি ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নীতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। হিজাব মূলত একটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পোশাক, যার মাধ্যমে নারী তার শালীনতা বজায় রাখার চেষ্টা করে এবং নিজের ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে থাকে। হিজাব পরা বা না পরা একজন নারীর মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।
ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। হাজার হাজার মুসলিম ছাত্রী হিজাব পরে পড়াশোনা করে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, মিসরসহ ইসলামি দেশগুলোয় নারীরা হিজাব পরেই শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কর্মক্ষেত্রে হিজাব পরা নারীরা বিজ্ঞানী, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। নোবেলজয়ী তাওয়াক্কুল কারমান ও মালালা ইউসুফজাই এবং মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমরের মতো অনেকেই হিজাব পরে চলাফেরা করে থাকেন। তবে ফ্রান্সের মতো কিছু দেশে সরকারি নীতি ও আইন দিয়ে ধর্মীয় পোশাক পরিধান করার স্বাধীনতাকে সীমিত করে নারী প্রগতিকে ব্যাহত করা হচ্ছে। এখানে রাষ্ট্রীয় নীতিই নারী স্বাধীনতার অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদি নারীকে শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও সামাজিক জীবনে সমান সুযোগ দেওয়া হয়, তবে হিজাব পরে বা না-পরে উভয় অবস্থাতেই তারা প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। সুতরাং, হিজাবকে বাধা নয়; বরং নারীর স্বাধীনতা ও পছন্দের প্রতীক হিসেবে দেখা উচিত।
বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত নারীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। অসংখ্য নারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছেন। ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। অনেকে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীতেও কাজ করছেন। এদের মধ্যে অনেকেই হিজাবধারী। তবে কোনো কোনো রক্ষণশীল পরিবার মেয়েদের চলাফেরাকে হিজাবের আড়ালে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, ফলে তারা উচ্চশিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে এগোতে পারে না। আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। অনেক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েদের জন্য হিজাব একটি আশীর্বাদ। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে হিজাব এখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে বলেই তারা হিজাব মেনে শিক্ষা-দীক্ষা ও বিভিন্ন পেশায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
অনেক নারী হিজাব পরে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। হিজাব নারীর শালীনতা বজায় রাখে, তাদের আত্মসম্মান ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। অনেক নারী হিজাব পরে বেশি আত্মবিশ্বাসী বোধ করেন, কারণ এতে তারা নিজের শরীরকে অন্যের দৃষ্টির বাইরে রাখতে পারেন। বিশেষ করে জনসমাগমে হিজাব অনেক নারীর জন্য নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি আনে।
শিক্ষা আর জীবিকা অর্জনের স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। হিজাব পরার অজুহাতে মানুষের অধিকার খর্ব করা একটি পশ্চাৎপদ ধারণা। কোথাও কোথাও হিজাবধারী নারীকে ‘সংকীর্ণমনা’ বা ‘আধুনিক নয়’ বলে দেখা হয়। আবার উল্টোভাবে, হিজাব না-পরা নারীদের ‘অধার্মিক’ বা ‘অশালীন’ মনে করা হয়। উভয়টিই উগ্রতা, উভয়টিই সামাজিক বৈষম্যের জন্ম দেয়। জুলাই অভ্যুত্থানে ও সাম্প্রতিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে হিজাবধারী এবং অহিজাবি নারী উভয়েই সমানভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। এতে বোঝা যায়, পোশাক বা হিজাব মানুষের মানবিক চিন্তা ও মূল্যবোধকে বাধাগ্রস্ত করে না।
যদি সমাজ বা প্রতিষ্ঠান হিজাবের কারণে নারীদের প্রতি বৈষম্য করে, তবে হিজাব নারী প্রগতির পথে বাধা হতে পারে। হিজাবকে অজুহাত করে নারীদের বিদ্যালয় বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হলে নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাত করা হয়। তেমনি যদি পরিবার বা সমাজ নারীকে হিজাবের আড়ালে রেখে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে, তবে তাতেও নারীকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এই দেশে এখন অনেক শিক্ষার্থী নিয়মিত হিজাব পরে পড়াশোনা করছেন এবং কর্মক্ষেত্রেও তারা সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে হিজাবধারী নারীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন হিজাব পরে নারীদের পক্ষে নেতৃত্বের আসনেও বসা সম্ভব।
জুলাই বিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তিই ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়। এই আন্দোলনে নারীরা ঘাম আর রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন নতুন বাংলাদেশে তাদের আর অবহেলা করা যাবে না। বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পরার কারণে মাঝেমধ্যে হেনস্তার খবর শোনা গেলেও হিজাব পরা নিয়ে কোনো আইনগত বাধা নেই। এমনকি সরকারি চাকরিতেও হিজাব বাধা নয়। তবে কিছু বেসরকারি চাকরিতে ড্রেস কোডের নামে হিজাবকে অনুমোদন করা হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় হিজাব পরার কারণে মাঝেমধ্যে মেয়েদের ক্লাস করতে দেওয়া হয়নি। মুখ অনাবৃত করতে রাজি না হওয়ায় কট্টরপন্থি কোনো কোনো শিক্ষক মৌখিক পরীক্ষা থেকেও ছাত্রীদের অপমানজনকভাবে বের করে দিয়েছেন, মানসিকভাবে হয়রানি করেছেন। সামনের দিনগুলোয় এ অবস্থার পরিবর্তন আসতে বাধ্য। হিজাবের কারণে এমনকি হিজাব না পরার কারণে কাউকে হেনস্তা করা হলে জেন-জি প্রজন্ম তা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেবে বলে মনে হয় না।
লেখক : অধ্যাপক, বুয়েট