একটা ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। অতীত আর ভবিষ্যৎ এখানে এসে মিলেছে। ইতিহাস বিরতি নিয়েছে। নতুন শুরুর একটা সুযোগ যেন এসেছে। এই দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখেছে, অর্থনৈতিক সংগ্রাম দেখেছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল হতে দেখেছে। অন্তর্বর্তী কাল এখন আশা নিয়ে এসেছে। এটা শুধু সরকার ব্যবস্থার বিরতি নয়। এটা জাতীয় জাগরণের মুহূর্ত। মানুষ এখন ন্যায়বিচার, সততা, আর সুযোগের দাবি তুলছে।

এই মুহূর্তে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নোবেল শান্তি পুরস্কারবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি রাজনীতিবিদ নন, নৈতিক দিকনির্দেশক। ক্ষুদ্রঋণ আর সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা ড. ইউনূস বিনয় আর ভিশন নিয়ে এসেছেন। তার নেতৃত্ব ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত নয়, জড়িত সেবার সঙ্গে। অতীতে তার বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদরা কুৎসা রটিয়েছেন। তারপরও সেবার জন্য তিনি এগিয়ে এসেছেন। পুরোনো দ্বন্দ্ব সরিয়ে রেখে তিনি এসেছেন। বিশ্বাস আর নৈতিকতা ধারণ করে এসেছেন।

সারা বাংলাদেশের মানুষ এর জবাব দিয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, এমনকি হতাশ কর্মকর্তারাও তাকে সমর্থন দিয়েছেন। এটা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কোনো আন্দোলন নয়, তৃণমূল থেকে উঠে আসা আন্দোলন। নাগরিকেরা ভব্যতা দেখতে চায়, নৈরাশ্য চায় না। তারা স্বচ্ছতা চায়, দুর্নীতি চায় না। তারা সবার জন্য সুযোগ চায়, শুধু অভিজাত শ্রেণির জন্য নয়। এই আশাবাদীরা মনে করেন, পরিবর্তন সম্ভব।

যে ভবিষ্যতের জন্য লড়া যায়

বিশৃঙ্খলার মধ্যেও সম্ভাবনা দেখেছিলেন সান জু। বাংলাদেশের সামনে এখন সেই সম্ভাবনা। এই দায়িত্বটা সবার, শুধু ড. ইউনূসের নয়। সমর্থন পেলে এই অন্তর্বর্তী সময়টা জাতীয় পুনর্গঠন উসকে দিতে পারে। এই সিদ্ধান্তটা শুধু শাসক শ্রেণির নয়। এভাবেই আমরা শাসন দেখতে চাই। একটা পুরো প্রজন্মের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে বাংলাদেশ।

আস্থার পুনর্বহাল : নেতৃত্বগুণ ও সততা

‘নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো অন্যের সেবায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা’—মহাত্মা গান্ধী।

প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসের ভূমিকা খুবই স্বচ্ছ। তিনি ক্ষমতার কথা বলেন না। তিনি দায়িত্ববোধ থেকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুদ্রঋণ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বৈশ্বিক পরিচিতি রয়েছে তার। ২০০৬ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। জীবনে তিনি নৈতিক নেতৃত্বের প্রমাণ রেখেছেন। এখন তিনি এই মূল্যবোধগুলোও বাংলাদেশের সরকার কাঠামোতে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন বলে মনে হয়।

শাসনে নৈতিক কর্তৃত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা

বিগত দেড় দশকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অপব্যবহার বাংলাদেশের ক্ষতি করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা ক্ষয়ে গেছে। গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে মানুষ। ড. ইউনূস এসব বদলানোর চেষ্টা করছেন। আস্থা ফেরাতে তার সরকার কাজ করছে। তিনি স্বচ্ছতা নিয়ে এসেছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ করে তুলছেন, দলের প্রতি নয়। আদালতের মামলাগুলোর পুনঃপর্যালোচনা করা হচ্ছে। উপদেষ্টা পদগুলো নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। ন্যায্যতার কথা বিবেচনায় রেখে নির্বাচনি কাঠামো সংস্কার করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপগুলো বুঝিয়েছে যে, সরকার ন্যায্যতার ভিত্তিতে চলছে।

এর আগে রাজনীতি বাংলাদেশকে বিভক্ত করেছিল। দুর্নীতি ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপব্যবহার হয়েছে অবাধে। বিচারব্যবস্থার রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। আনুগত্যকে মেধার ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ওপরের দিকে ছিল বাংলাদেশ। বিচারিক ও নির্বাচনী স্বাধীনতার অবনতির কথা জানিয়েছিল ‘ফ্রিডম হাউস’। গণতন্ত্রের প্রশ্নে মোহভঙ্গ হয়েছিল সাধারণ মানুষের।

ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে দুর্নীতির মামলাগুলো পুনর্বিবেচনা করা হয়েছে। কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি। অবসরপ্রাপ্ত বিচারক আর সৎ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন প্যানেল এই রিভিউ করছে। অতীতের রাজনৈতিক প্রভাবিত প্রক্রিয়া থেকে এই প্রক্রিয়া অনেকটাই আলাদা।

নির্বাচন কমিশন আর দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার চলমান। এগুলো এককালে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এখন জনগণের মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য পেশাদার ব্যক্তিরা সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পক্ষপাতহীন উপদেষ্টা কাউন্সিল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নাম প্রস্তাব করছে। স্বচ্ছতাকে এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত আর বাজেটের তথ্য অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে। খোলা ডেটা পোর্টাল থেকে নাগরিকেরা সরকারের কর্মকাণ্ডের খোঁজ রাখতে পারছে।

প্রতিহিংসার রাজনীতির অবসান

ড. ইউনূস প্রতিশোধের রাজনীতির পথে হাঁটেননি। অতীতে তার ওপর নির্লজ্জ হামলা হয়েছে। কিন্তু তিনি সংযম দেখিয়েছেন। তার সরকার নিশ্চিত করেছে যাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে কেউ টার্গেট না হয়। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এই নীতি আস্থা আর ন্যায্যতা নির্মাণ করেছে। শাসন চলছে এখন ন্যায্যতার ভিত্তিতে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্ব ব্যাংক এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ আর বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে অনুসন্ধান বাড়ছে। একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণের চেষ্টা চলছে। এই সংস্কৃতিতে যোগ্যতা, সেবা ও চরিত্র গুরুত্ব পাচ্ছে।

স্বচ্ছতা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের চেষ্টা আছে। নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ ও তরুণদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় সরকার যুক্ত করেছে। জনতুষ্টিবাদী স্লোগান ড. ইউনূস এড়িয়ে চলছেন। বরং তিনি মূল্যবোধ আর অভিন্ন কল্যাণের কথা বলছেন। আদর্শবাদ আর বাস্তব সমাধানের মিশেল ঘটেছে তার কৌশলে।

ভেঙে পড়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিপরীতে

অতীতের সংঘাতমূলক রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান নীরব শক্তির কোনো মিল নেই। এতে প্রতিশোধ নয়, বরং বোঝাপড়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণ নাগরিক, ব্যবসায়ী ও বৈশ্বিক অংশীদাররা এতে আস্থা ফিরে পাচ্ছে বলে মনে করা যায়।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা বৈশ্বিক সমর্থন বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবার বাংলাদেশের সঙ্গে লেনদেন শুরু করেছে। এই মুহূর্তটা আধুনিক বাংলাদেশকে সংজ্ঞায়িত করতে পারে। গান্ধী যেমনটা বলেছেন—‘সত্যিকারের নেতৃত্ব হলো স্বার্থহীনভাবে সেবা দেওয়া।’

জামায়াতের সমাবেশ কী বার্তা দিল?জামায়াতের সমাবেশ কী বার্তা দিল?

বাংলাদেশ অসমতা আর বৈষম্যের সংস্কৃতি দেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ক্ষুদ্র কৃষক, বেকার যুবক এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে তারা সহায়তা দিয়েছে। ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসার মডেল এই সংস্কারে দিশা দেখিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ, উদ্যোক্তা ধারণা এবং তারুণ্যের অংশগ্রহণ শহর ও গ্রামের ব্যবধান ঘুচিয়েছে। লক্ষ্যটা সহজ—তৃণমূল থেকে প্রবৃদ্ধি, ওপর থেকে নয়।

মর্যাদার কূটনীতি : বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ

‘কূটনীতি হলো অন্যকে তোমার সহায়তায় কাজে লাগানোর শিল্প’—ড্যানিয়েল ভার।

কূটনীতিতে অভিন্ন মানবিকতার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশ্বনেতাদের মর্যাদার সঙ্গে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেছেন, কোনো বিনিময়ের ভাবনা থেকে নয়। বাংলাদেশ বিশ্বে একটা মূল্যবোধের কণ্ঠস্বরের স্বীকৃতি পেয়েছে। ড. ইউনুস রোহিঙ্গা সংকটকে প্রাধান্য দিয়েছেন। জাতিসংঘ ও আসিয়ান থেকে নতুন সহায়তা নিয়ে এসেছেন। এই মর্যাদার কূটনীতিতে আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে।

নাগরিক সমাজ ও তরুণদের জাগরণ

‘শিক্ষা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, যেটা দিয়ে বিশ্বকে বদলে দেওয়া যায়’—নেলসন ম্যান্ডেলা।

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে মানুষের মননে। এককালের হতাশ যুবসমাজ এখন লক্ষ্য দিয়ে চালিত হচ্ছে। শিক্ষার্থী, নাগরিক গোষ্ঠী এবং শিল্পীরা ফোরাম আর প্রচারণার আয়োজন করছে। নৈতিক জাতি গঠনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এটা শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা বাংলাদেশের আত্মাকে ফিরিয়ে আনার ডাক।

অন্তর্বর্তীকালীন সুশাসন থেকে টেকসই সংস্কার

‘সত্যিকারের নেতা জনমত খোঁজেন না, বরং জনমত গড়ে তোলেন’—মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।

অন্তর্বর্তী সরকারে ড. ইউনূসের ভূমিকাটা সাময়িক। কিন্তু তার সংস্কারের ভাবনাগুলো স্থায়ী। নির্বাচনী সংস্কার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মিডিয়া সংস্কার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার প্রচেষ্টাগুলো স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। এটা কোনো ক্ষণিক পরিবর্তন নয়, বরং এগুলোই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবে।

‘আশা কোনো কৌশল নয়, বরং আশা ছাড়া কোনো কৌশলই আসলে সফল হতে পারে না’—ফরিদ জাকারিয়া।

চ্যালেঞ্জ এখনো রয়েছে। দুর্নীতি ও আঞ্চলিক হস্তক্ষেপে উন্নতি এখনো হুমকিতে পড়ছে। ক্ষমতা রক্ষার জন্য অনেকে ড. ইউনূসকে দোষারোপের চেষ্টা করছেন। প্রতিবেশী একটি দেশের প্রভাব বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, কিন্তু জনগণের নজর খোলা রয়েছে। তারা আর নীরব নেই। এটা একটা জাতীয় জাগরণের মুহূর্ত। এটা এমন বাংলাদেশের ডাক, যেখানে সুশাসন হবে পবিত্র, সরকারি অফিসগুলো হবে সেবার কেন্দ্র, আর ভবিষ্যৎ হবে আশাব্যঞ্জক। প্রভাতের মুহূর্ত এখানেই। এই ডাকে সাড়া দিয়ে কে এখন উঠে দাঁড়াবে?

সূত্র, আমার দেশ