জুলাই অভ্যুত্থানের দায় ও আত্মনির্ভর চিন্তাতত্ত্বের গঠন আত্মনির্ভরতার পথে ঘেটো মেন্টালিটি (Ghetto mentality) পরিহার করতে হবে। অনেকেই মনে করেন, আত্মনির্ভরতা মানেই নিজস্ব গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা। এটি এক ধরনের ঘেটো মেন্টালিটি, সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ। প্রকৃত আত্মনির্ভরতা হয় উন্মুক্ত, সংলাপমূলক, বিচারী ও গ্রহিষ্ণু এবং সত্যমুখী। আত্মনির্ভরতা মানে নিজস্ব অবস্থান থেকে কথা বলা, এক ধরনের আত্মবিশ্বাসী সংলাপ ও সমালোচনার ক্ষমতা। আত্মনির্ভর চিন্তাতত্ত্বকে একাডেমিক প্রস্তাবে সীমিত করলে ভুল করব। এটি জুলাই অভ্যুত্থানের আত্মায় নিহিত চিন্তাগত আকুতির প্রতি সাড়া। জুলাই এর বার্তা বহন করুক। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও মিডিয়ায় চিন্তা কীভাবে হাজির? সাধারণত পশ্চিমা লিবারেল, মার্কসবাদী, সেকুলার জাতীয়তাবাদী পথরেখা এদের চিন্তাকে দিশা দেয়। এতে যুক্ত থাকে ভারতীয় ঘরানার বাঙালি রেনেসাঁ ও হিন্দু রিফর্মেশনের দাবি, দ্রব্য ও ধ্রুব। এসব আমদানি করা মডেল একচক্ষু কিংবা অন্ধ আচরণ করে। কারণ তারা ক. বাস্তব সঙ্কট বোঝে না, খ. ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে অবজ্ঞা করে, গ. জনগণের ভাষা ও বোধের সাথে সম্পর্কহীন, ঘ. জাতি গঠনের ঔপনিবেশিক ফ্রেম অনুসরণ করে এবং ঙ. এখানে চিন্তা সাইটেশন কালচারনির্ভর। মানে হলো কে বলেছে, তার ওপর নির্ভর করে, কী বলেছে, তার ওপর নয়। আমদানি করা চিন্তার সঙ্কট থেকে উত্তরণ এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আত্মনির্ভর চিন্তাতত্ত্ব গঠনের দায় রয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের। কিন্তু কী হবে তার কর্মনীতি? মোটা দাগে কয়েকটা দিক উল্লেখ করা যায়। ১. জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক আজাদী ও পুনরুদ্ধার : এখানে মূল কর্মনীতি হবে চিন্তার অধিকার পুনর্দাবি ও মৌলিক জিজ্ঞাসার অগ্রাধিকার। এ ক্ষেত্রে প্রথমত, জ্ঞানচর্চার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে চিন্তার স্বাধীনতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তা করার অধিকারের নীতিগত ও সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, অনুকরণভিত্তিক জ্ঞানচর্চা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। পশ্চিমা ফ্রেমওয়ার্কের অনুরণনে কাজ হবে না, বরং বাস্তবতার আলোকে নিজস্ব ফ্রেম গঠন করতে হবে। তুমি কী ভাবো, তার চেয়ে জরুরি হলো তুমি কেন ভাবো এবং কীভাবে ভাবো? এই মুখ্য প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তৃতীয়ত, মৌলিক জিজ্ঞাসার পুনরুজ্জীবন। মৌলিক প্রশ্নগুলোর সাথে মোলাকাত ও মোকাবেলার বিকল্প নেই। আমরা কে? আমাদের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ কী? আমাদের নৈতিক কাঠামো কী? এগুলো এমন প্রশ্ন, যার মুখোমুখি হতে হবেই। এমনতরো বিষয়ের জবাবের স্পষ্টতা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাকে পাঠ্যক্রম ও জনপরিসরে খোলাসা করতে হবে। চতুর্থত, ইলমের আত্মবিশ্লেষণমূলক পুনর্নির্মাণ ও একাডেমিক ভাষায় চিন্তার উপনিবেশ দূরীকরণ। এ ক্ষেত্রে ক. জ্ঞানকে শুধু তথ্য হিসেবে দেখলে চলবে না, বরং বাস্তব ও নৈতিক বিশ্বদর্শনের অঙ্গ হিসেবে দেখতে হবে। খ. মুসলিম চিন্তার ধারায় ইলমি মুকাবিলা, উমরান ও তাদাব্বুর চর্চার পুনর্গঠন করতে হবে। গ. ভিনদেশী পারিভাষিক আধিপত্য এড়িয়ে বাংলা ও তুরাসি (ঐতিহ্যগত) পারিভাষিক কাঠামোর পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ঘ. গবেষণায় ও পাঠ্যপুস্তকে বিদেশী অনুমোদনের পরিবর্তে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক মানদণ্ড ব্যবহার। ২. চিন্তার উৎসে প্রত্যাবর্তন : এখানে মূল কর্মনীতি হবে ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার এবং প্রাসঙ্গিকতার নবগঠন। এই খাতে প্রথমত, বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের পুনঃউন্মোচন জরুরি। জ্ঞানীয় ভূমি ও আবহাওয়ার যে অতীত, তার পুনরুজ্জীন ও পুনর্গঠন করতে হবে। চিন্তার যে অনুশীলন ইতিহাসের নানা পর্বে আমাদের বিকাশ দিয়েছিল, উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে তার নবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলার লোকজ প্রজ্ঞা ও সুফি-মানসের পুনর্মূল্যায়ন। কৃষিভিত্তিক সমাজজ্ঞান, নৈতিক চেতনা এবং জীবনবোধের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। আত্মসংশোধন, অন্তর্জগৎ, মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় চর্চিত সুফি চিন্তাকে সামনে আনা এবং আত্ম, সমাজ ও পরমতত্ত্বের সম্পর্ক ব্যাখ্যার প্রচলিত ধারাগুলোর বোঝাপড়া। আমাদের নিজস্ব সৃষ্টি, কৃষ্টি ও দর্শনীয় স্তম্ভগুলোকে একাডেমিক ও জনপরিসরে প্রতিস্থাপন। ঐতিহ্যবাহী চিন্তাবিদদের পুনর্পাঠ এবং বাঙালি-মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তিক অভ্যাসের নতুন পাঠ্য নির্মাণ। তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক-দর্শনীয় স্তম্ভগুলোর সামাজিক প্রতিস্থাপন। বায়তুল হিকমা বা জামিয়া নেজামিয়ার ঐতিহ্য জ্ঞানকেন্দ্র গঠনের দিশা দেয়। ঐতিহ্য ও নতুন বাস্তবতার সঙ্গতিসহকারে জ্ঞানচর্চাকে ‘উপকারভিত্তিক দর্শন’ হিসেবে পুনর্নির্মাণ করতে হবে। বিষয়গত বিচারে দ্বীনি ইলম ও পার্থিব জ্ঞানের দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব অতিক্রম করতে হবে। চতুর্থত, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর মালিকানার পুনর্দাবি জরুরি। কেবল অতীতের স্মৃতি উদ্ধারের জন্য এই প্রক্রিয়ার কথা বলছি না, বলছি সামগ্রিক অর্থ ও আবেদনের সাপেক্ষে। কারণ তাতে নিহিত আছে একটি জাতি বা জনগোষ্ঠীর পরিচয়, ক্ষমতা ও ভবিষ্যৎ নির্মাণের কৌশল। এ ক্ষেত্রে ক. জাতির অতীতকে নিজস্ব ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যাপদ্ধতিতে অনুধাবন ও উপস্থাপন করতে হবে। যা হবে ঔপনিবেশিক বা আধিপত্যশীল ব্যাখ্যাগুলোর বিকল্প ন্যারেটিভ। খ. ধর্ম, দর্শন, সংস্কৃতি, ভাষা ও নৈতিকতার ঐতিহ্যকে পশ্চিমা মাপকাঠি বা আধুনিকতার প্রিজমে না দেখে নিজস্ব প্রসঙ্গ ও প্রয়োজনের আলোকে নতুন করে উদ্ধার ও মূল্যায়ন করতে হবে। গ. যেসব ইতিহাস চেপে রাখা হয়েছে, বিকৃত করা হয়েছে বা অন্যের দৃষ্টিকোণে রচিত হয়েছে- সেগুলোর মালিকানা পুনর্দাবি করতে হবে। এর মানে হলো- এই ইতিহাস আমাদের, এর ভাষ্য আমরাই নির্ধারণ করব। ৩. ইসলামী ফিকরিয়্যাতের উন্মোচন ও পুনর্পঠন জরুরি। এই ফিকরিয়্যাত আমাদের দেয় আত্ম-অভিজ্ঞা ও হিদায়াহভিত্তিক মীমাংসা। যেখানে চিন্তার সূচনা হয় ইখলাস ও তাযকিয়া থেকে। এখানে দার্শনিক অহংকারের বদলে ওহির আলোয় অন্বেষণ করা হয় জ্ঞান। বাংলার চিন্তাগঠনে এর ভূমিকা মুখ্য। এই পথে ফিকহ, কালাম, তাসাওউফি ত্রিবিধ ধারার যৌথ সমন্বয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। মানে, ইবনে তাইমিয়্যা, ইমাম গাযালি, শাহ ওয়ালিউল্লাহর মতো ত্রিমাত্রিক চিন্তাপ্রবাহকে নতুনভাবে পাঠ করা চাই। এই পাঠ ও তত্ত্বায়ন ওরিয়েন্টালিস্ট কাঠামো থেকে মুক্তি আনবে এবং পশ্চিমা একাডেমিয়ার তথাকথিত নিরপেক্ষতা ও অবজেক্টিভিটির মুখোশ সরাবে। কারণ ইসলামী চিন্তার মূলে থাকে হাকিকাত-নির্ভর অন্টোলোজি। সেখান থেকে সে সময়, ইতিহাস, রাষ্ট্র ও সমাজের ইসলামী ব্যাখ্যা করে। সে চায় চিন্তা যেন সামাজিক জাগরণে রূপ নেয়। তার পুনর্পঠন ও প্রতিস্থাপনে আলেম, দার্শনিক ও কর্মীর সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন। ৪. ভাষাভিত্তিক জ্ঞান-উৎপাদন ও অনুবাদ-সংস্কৃতির পরিগঠন। এক্ষেত্রে ক. বাংলা ভাষায় মৌলিক জ্ঞান রচনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজি, ফরাসি, স্পেনিশ ইত্যাদি ভাষার জ্ঞান আমাদের চাই। কিন্তু পশ্চিমনির্ভর অনুবাদ ও ধারালো ভাবনার বাইরে যে জগত, তাকেও ধারণ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে গতি পাবে বাংলা ভাষায় গবেষণা ও দর্শনচর্চার নবযাত্রা। খ. প্রাচ্য-ইসলামী ক্লাসিক পাঠের পুনর্জীবনেও কাজ করতে হবে। আরবি, ফার্সি, তুর্কি, সংস্কৃত, উর্দু ইত্যাদি উৎস থেকে মূল টেক্সট অনুবাদ আমাদের চিন্তাসম্পদকে ঋদ্ধ করবে। পাঠ্যপুস্তকে প্রাচ্যের প্রজ্ঞার অন্তর্ভুক্তি জরুরি। ৫. বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞাননীতিতে বিপ্লব এটি মূলত গভীর সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক পুনর্গঠনের প্রস্তাব। এর দুটি মুখ্য স্তম্ভ আছে। প্রথমত, বিভাগীয় কাঠামোর পুনর্গঠন। দ্বিতীয়ত পাঠক্রমে আত্মপরিচয় ও চিন্তা-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি। উভয় স্তম্ভ শিক্ষায় একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে পারে। যা পাঠদানের ধারায় যেমন বদল আনবে, তেমনই পরিচয়, মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপ্রেক্ষিত বদলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। বিভাগীয় কাঠামোর পুনর্গঠন মূল প্রস্তাব : ইসলামী দর্শন, স্থানীয় সমাজতত্ত্ব, বিকল্প অর্থনীতি, আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি নতুন ডিসিপ্লিনের সৃষ্টি। ১. বিদ্যাবিভাগের আধিপত্য বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় কাঠামো প্রায় সর্বত্র পশ্চিমা আধুনিকতাবাদী কাঠামোর অনুকরণে গঠিত। যেমন : ক. রাষ্ট্রবিজ্ঞান = কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩), থমাস হবস অব সল্সসবুরি, (১৫৮৮-১৬৭৯), জ্যাঁ-জাক রুসো (১৭১২-১৭৭৮), খ. অর্থনীতি = অ্যাডাম স্মিথ (১৭২৩-১৭৯০), জন মেইনার্ড কেইনস (১৮৮৩-১৯৪৬), গ. সমাজতত্ত্ব= এমিল ডার্কহেইম (১৮৫৮-১৯১৭), ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০), ঘ. মনোবিজ্ঞান = সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯), ইভান পাভলভ (১৮৪৯-১৯৩৬) এই কাঠামো : ক. ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে, খ. স্থানীয় চিন্তাধারাকে ভুলিয়ে দেয়, গ. নির্বিচারে ইউরোকেন্দ্রিক জ্ঞান চাপিয়ে দেয় এবং ঘ. সৃষ্টিশীল বিকল্প চিন্তার দ্বার রুদ্ধ করে। এই বাস্তবতায় বিভাগীয় কাঠামোর পুনর্গঠনের কথা আমরা বলছি। কিন্তু এটি কীভাবে ঘটবে? এটি ঘটবে তিন স্তরে। ক) নতুন শিরোনামে বিভাগ প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন রয়েছে। যেমন : ক. ইসলামী দর্শন ও সভ্যতাতত্ত্ব, খ. স্থানিক সমাজতত্ত্ব ও লোকচিন্তা (Ethnosociology), গ. বিকল্প অর্থনীতি ও ন্যায্যতা-ভিত্তিক উন্নয়নবিদ্যা, ঘ. আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞান ও আত্মগঠন বিদ্যা। খ) দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গির পুনর্গঠন আবশ্যক। কারণ এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্মবস্তুতে নিহিত। বিদ্যাবিভাগ কি কেবল বিষয় শেখাবে? না, তা দৃষ্টিভঙ্গিও গড়ে তুলবে। ফলে নতুন বিভাগের মানে হলো জ্ঞান উৎপাদনের নতুন পদ্ধতি, জগতকে বোঝার নতুন পরিপ্রেক্ষিত এবং মূল্যবোধভিত্তিক জ্ঞান কাঠামো। গ) আন্তঃবিভাগীয় সংলাপ চিন্তাকে অধিকতরো প্রয়োগযোগ্য করবে। নতুন বিভাগগুলো বিদ্যমান বিভাগকে সম্পূর্ণ বাতিল করবে না। বরং বিদ্যমান বিভাগগুলোর সাথে সে সংলাপে যুক্ত হতে পারে। যেমন আধুনিক দর্শনের পাঠের সাথে তুলনামূলক আলোচনায় ইসলামী দর্শনের ব্যবহার। যা কালাম ও ইসলামী দর্শনের নতুন ভূমিকা হাজির করবে। মূল ধারার অর্থনীতিতে ন্যায়পরায়ণতা ও মাকাসিদভিত্তিক আলোচনার সংযোজন। যা বিকল্প অর্থনীতি হাজির করবে। এই রূপান্তরের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য গভীর। কারণ এর মধ্যে রয়েছে প্রভাবের নানা মাত্রা। যেমন ক) পরিচয় ও মূল্যে ফিরতি যাত্রা। এই রূপান্তরে রয়েছে এর অপার সম্ভাবনা। কারণ ইসলামী দর্শন বা আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞান- এসব নাম কেবলই নাম নয়। এর মধ্যে নিহিত আছে জ্ঞানচর্চার দিকবদল। এগুলো পশ্চিমা materialist epistemology থেকে দিকবদল ঘটিয়ে তাওহিদি এপিস্টেমোলোজির দিকে জ্ঞানের অভিমুখ নিশ্চিত করে। খ) জ্ঞান উৎপাদনে স্থানীয় ভিত্তি ও প্রাসঙ্গিকতা জীবন্ত হবে। কারণ স্থানীয় সমাজতত্ত্ব নামের বিভাগ মানে নিজ সমাজের বাস্তবতা বোঝা। বিকল্প অর্থনীতি বিভাগের মানে গণমুখী, ন্যায়পরায়ণ উন্নয়ন মডেল। এর ফলে জ্ঞান হবে প্রসঙ্গানুগ, নৈতিক এবং জনগণের প্রয়োজনভিত্তিক। গ) জ্ঞানব্যবস্থায় আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতাকে ফিরিয়ে আনা হবে। কারণ, আধুনিক বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান নৈতিকতাবিচ্ছিন্ন। আধ্যাত্মিক মনোবিজ্ঞান এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে। জ্ঞানের পরিসরে আত্মা, দায়িত্ব, পরকাল, আত্মশুদ্ধি ইত্যাদি ধারণা কেন্দ্রীয় জায়গা পায়। বিভাগীয় কাঠামোর পুনর্গঠন হলো এক বিপ্লবী পদক্ষেপ। এটি সম্পন্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠানের অবস্থান থেকে উন্নতি করবে। সে হতে পারবে সংস্কৃতির আত্মরক্ষাকেন্দ্র, ন্যায়পরায়ণ চিন্তার কেল্লা এবং আত্মমর্যাদাপূর্ণ জ্ঞানতন্ত্রের ভিত্তি। এই পুনর্গঠন ব্যর্থ হলে বিশ্ববিদ্যালয় হবে বিদেশী চিন্তার এজেন্ট। সফল হলে বিশ্ববিদ্যালয় হবে সভ্যতার জাগরণের সূতিকাগার। পাঠক্রমে আত্মপরিচয় ও চিন্তা-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি বা সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন : ক. এটি মুখ্যত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শূন্যতার বিরুদ্ধে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া। কারণ ঔপনিবেশিক শিক্ষা কাঠামো আমাদের আত্মপরিচয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বর্তমান পাঠক্রমে ইউরোপকেন্দ্রিক তত্ত্ব ও ইতিহাস আছে। কিন্তু ইসলামী, এশীয় বা স্থানীয় ভাববাদী জ্ঞানতত্ত্ব নেই বললেই চলে। এর ফলে শিক্ষার্থী হয়ে পড়ে সাংস্কৃতিকভাবে নির্জীব এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ঔপনিবেশিত। স্থানীয় চিন্তার ঐতিহ্য ও ধাপ এবং সৃষ্টি ও দৃষ্টির ধারা ও ধরনগুলোকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার গুরুত্ব এখানেই। কারণ এই অন্তর্ভুক্তি হবে শূন্যতার প্রতিকারে একটি সক্রিয় পদক্ষেপ। খ. চিন্তা-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি মানে বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি। কারণ চিন্তার পুনর্গঠন ছাড়া জাগরণ সম্ভব নয়। পাঠ্যক্রমে যখন নিজস্ব ঐতিহ্য ও দর্শনের সংযোজন হয়, তখন শিক্ষার্থীর ভাবরাজ্যে আসে নতুন চোখ ও চেতনা। সে অন্যের মানদণ্ডে নয়, বরং নিজের ঐতিহ্যিক ও নৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করতে শেখে। এটি কলোনিয়াল এপিস্টেমোলোজিকে ভেঙে দেয়। গঠন করে পোস্ট কলোনিয়াল ইন্টেলেকচুয়াল অটোনোমি। গ. এই পুনর্গঠনে নিহিত আছে চিন্তার বহু-বিপরীত ধারার সম্মিলন। ইবনে খালদুনের সমাজচিন্তা, ইবনে তাইমিয়ার নীতিদর্শন, রুমির আধ্যাত্মিকতা, গাযালির যৌক্তিক সুফিবাদ, ইকবালের আত্মনির্ভর দর্শন কিংবা গালিবের নিয়তিভাবনা ও অভিমান, হাসন রাজার রূপতত্ত্ব, নজরুলের বিদ্রোহ ইত্যাদিকে পরস্পর থেকে ভিন্ন মনে হতে পারে। কিন্তু তারা একত্রে একটি গভীর চিন্তাজগৎ গড়ে তোলে। এই অন্তর্ভুক্তি কোনো একরৈখিক আদর্শ চাপিয়ে দেয় না, বরং জ্ঞানতত্ত্বে তর্ক, পর্যালোচনা ও পুনর্বিন্যাসের দিগন্ত উন্মোচন করে। ঘ. এই পুনর্গঠন বহন করে সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন ও জ্ঞানচর্চার পরিশুদ্ধির দিশা। কারণ এতে সাংস্কৃতিক মুক্তি ও জ্ঞানচর্চার ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা পূরণ হয়। এটি জাতির মৌলিক স্মৃতি সংরক্ষণ করে এবং জাতীয় জীবনের ভবিষ্যৎ কাঠামোতে স্থান দেয়। গাযালির নৈতিক দর্শন বা ইবনে তুফায়েলের আত্মউন্মোচন কেবল ইতিহাস নয়, বরং রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজনীতির বিকল্প দিগন্ত। ঙ. পাঠ্যপুস্তকের কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন অবধারিত। কেননা শুধু একটি অধ্যায় সংযোজন যথেষ্ট নয়, বরং পাঠ্যপুস্তকের মূল কাঠামো নতুনভাবে ভাবতে হবে। পাঠ্যক্রমে আত্মপরিচয় ও চিন্তা-ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি শিক্ষাবিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র। এজন্য কেবল বইয়ের বিষয় পরিবর্তন যথেষ্ট নয়। বরং জ্ঞান উৎপাদনের পদ্ধতি, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ উদ্যোগের বাস্তবায়ন হলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে সম্মিলিত স্মৃতি, দায়বদ্ধতা ও দিগন্ত নির্মাণের স্থান। ৫. আন্দোলন-ভিত্তিক চিন্তা ও চিন্তা-ভিত্তিক আন্দোলন : চিন্তা ও আন্দোলনে আছে দ্বিমুখী সম্পর্ক। এই সম্পর্ক সমন্বয়ী বন্ধন তৈরি করবে। চিন্তা কেবল বিমূর্ত চিন্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে যখন বাস্তব রূপ নেবে। আন্দোলন কেবল আবেগ না হয়ে গভীর দার্শনিক চিন্তার বুনিয়াদে দাঁড়াবে। এই ধারণাকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রথমত নতুন প্রজন্মকে দার্শনিকভাবে সংগঠিত করতে হবে। আজকের বিশ্ব তথ্যবহুল হলেও ন্যায়ভিত্তিক চিন্তার অনুপস্থিতি বিপজ্জনক পর্যায়ে। অন্য দিকে বাংলাদেশে শিক্ষিত শ্রেণী ও মিডিয়া পেশাজীবীরা সাধারণত পশ্চিমা ন্যারেটিভ বা ক্ষমতার ভাষ্যের পুনরুৎপাদন করেন। তারা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে ব্যর্থ। এমতাবস্থায় চিন্তা ও সত্যতালাশের আন্দোলন জরুরি। এ দার্শনিক আত্মনবীকরণের আন্দোলন বিশ্লেষণ করবে আমাদের সত্তাগত নানা ইস্যু। যেমন আমরা কী বিশ্বাস করি? কেন বিশ্বাস করি? আমাদের ঐতিহাসিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সত্য কী? চিন্তার প্রশ্নে ছাত্ররা হবে আত্মপ্রশ্ন ও প্রতিপ্রশ্নে পারদর্শী। শিক্ষকগণ শ্রেণীকক্ষে সত্য, ন্যায় ও তাওহিদের আলোকে বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরণ শেখাতে সক্ষম হবেন। গবেষক নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করবেন, ভিন্ন ধারণার বিশ্লেষণ করবেন। মিডিয়া এই চিন্তার দর্শন, ভাষা ও অনুপ্রেরণাকে জনমানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। দ্বিতীয়ত চিন্তার রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটাতে হবে। গঠন করতে হবে চিন্তার রাজনীতি। কারণ রাজনীতি কেবল ক্ষমতা দখলের খেলা নয়। বরং এক গভীর নৈতিক ও দার্শনিক অবস্থান। চিন্তার মূল ফসল হবে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা। এখানে বুনিয়াদি ভিত্তি হবে চারটি। ক. ন্যায় (Justice) : চিন্তা থেকেই আসে ইনসাফের সংজ্ঞা, যা শাসনের ভিত গড়ে। খ. আত্মমর্যাদা (Dignity) : চিন্তা-চর্চা মানুষকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেয়। যা কামনা করে চেতনার স্বাধীনতা। গ. বিকল্প নেতৃত্ব (Alternative Leadership) : চিন্তার আলোকে তৈরি হওয়া নেতৃত্ব হবে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী, নৈতিক ভিত্তিসম্পন্ন। জননেতা নয়, চিন্তানেতা প্রয়োজন, যিনি রাজনীতি করবেন দর্শনের আলোকে। ঘ. বিশ্বাসভিত্তিক রাজনীতি (Faith-rooted Politics) : চিন্তার চূড়ান্ত রূপ হলো এমন এক রাজনীতি, যা নৈতিক -মানবিক বা খলিফা হওয়ার দায় থেকে জন্ম নেয়। এ রাজনীতি ক্ষমতার জন্য নয়, বরং দায়িত্ব ও জবাবদিহির অধীনে পরিচালিত। চিন্তাকে হতে হবে আত্মবিশ্লেষণ ও সত্যনিষ্ঠতার পথ। কাজেই নতুন প্রজন্মকে দার্শনিকভাবে সংগঠিত করে নৈতিক নেতৃত্ব ও সমাজদ্রষ্টা রাজনীতিতে রূপান্তর করা আজকের চ্যালেঞ্জ। এটি সভ্যতার নবজাগরণের পূর্বশর্ত। ৬. ‘অপর’ হওয়ার আত্মসমালোচনা : ঔপনিবেশিক আধিপত্য শুধু বাহ্যিক শাসন নয়, এটি অন্তর্গত মানসিক কাঠামো, চিন্তার প্রক্রিয়া ও আত্মপরিচয়ের ভেতরেও গভীরভাবে প্রোথিত। বাঙালি মুসলিম চিন্তকদের অনেকেই পশ্চিমা পরিভাষা ও কাঠামোতেই নিজেদের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করেন। তাদের প্রধান অংশটির আধুনিকতাচর্চা পশ্চিমের অনুমোদন বা অনুকরণনির্ভর। এই প্রবণতাকে বলছি ‘অপর’ হয়ে ওঠা। অর্থাৎ নিজের চোখে নয়, ‘উন্নত’ পশ্চিমের চোখে নিজেকে দেখা। এই রোগমুক্তির পথ আত্মসমালোচনা ও পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে সেই মানসিক দাসত্ব ভেঙে ফেলা। এই ধারায় ক. ঔপনিবেশিক মানসিকতা চিহ্নিত করতে হবে। ভাষা, পাঠ্যক্রম, ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চায় কীভাবে পশ্চিম রাজত্ব করছে, তা উন্মোচন করতে হবে। খ. নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য পুনঃআবিষ্কার করতে হবে। গ. অনুবাদ বা আমদানি নয়, বরং নিজস্ব জীবন বাস্তবতা থেকে চিন্তার ফসল ফলাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আত্মনির্ভরতার পথে ঘেটো মেন্টালিটি (Ghetto mentality) পরিহার করতে হবে। অনেকেই মনে করেন, আত্মনির্ভরতা মানেই নিজস্ব গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকা। এটি এক ধরনের ঘেটো মেন্টালিটি, সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ। প্রকৃত আত্মনির্ভরতা হয় উন্মুক্ত, সংলাপমূলক, বিচারী ও গ্রহিষ্ণু এবং সত্যমুখী। আত্মনির্ভরতা মানে নিজস্ব অবস্থান থেকে কথা বলা, এক ধরনের আত্মবিশ্বাসী সংলাপ ও সমালোচনার ক্ষমতা। আত্মনির্ভর চিন্তাতত্ত্বকে একাডেমিক প্রস্তাবে সীমিত করলে ভুল করব। এটি জুলাই অভ্যুত্থানের আত্মায় নিহিত চিন্তাগত আকুতির প্রতি সাড়া। জুলাই এর বার্তা বহন করুক।
লেখক : কবি, সাহিত্যিক