ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন যেন এক নির্মম দানব, যা ক্রমাগত আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে ঢুকে পড়ে। একে আর কোনো প্রথাগত আক্রমণ বললে ভুল হবে, বরং এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শোষণ, যা শুধু সীমান্ত নয়, আমাদের হৃদয়ে, আমাদের চেতনায় প্রবেশ করছে। প্রতিটি পদক্ষেপে এই আগ্রাসন এক ধ্বংসাত্মক শক্তি, যা আমাদের পরিচয়, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের অস্তিত্বের ওপর আছড়ে পড়ে। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তি প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর যা চাপিয়ে দিচ্ছে, তা এক উগ্র আগ্রাসন, যা আমাদের শেকড় ও আত্মাকে টানটান করে ছিঁড়ে ফেলছে।
ধর্মের নাম করে, সংস্কৃতির নামে, এক মিথ্যাচারী সাম্রাজ্যবাদী নীতি শুরু হয়েছে, যেখানে প্রত্যেকটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং নিজেদের ঐতিহাসিক অস্তিত্বকে নিঃশেষিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই শক্তি শুধু ভারতীয় ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সীমানা পেরিয়ে এক প্রলয়ের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর বিরুদ্ধে আছড়ে পড়ছে, যেখানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা কিংবা নেপাল—সবখানেই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের তীব্র আগ্রাসন স্পষ্ট। এই পরিস্থিতি যেন এক দীর্ঘ, অবিরাম যুদ্ধের মতো, যেখানে প্রতিটি ক্ষত আমাদের নিজেদের আত্মায় ক্ষরণ করে যাচ্ছে। আমরা কি আজও সেই যুদ্ধে শুধু দাঁড়িয়ে দেখব, নাকি একদিন প্রতিবাদ করব, একে প্রতিরোধ করব? এই প্রশ্নই আজ আমাদের সামনে। ভারতের এই নিঃসীম অমানবিক আগ্রাসন, যা আমাদের আস্থা, মূল্যবোধ এবং ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, প্রতিটি শ্বাসে নিঃশব্দে আমাদের অস্তিত্বকে মুছে ফেলতে চায়, তা আমাদের সামনে এক করুণ প্রতিবাদ হিসেবে হাজির হচ্ছে।
ইরানে হামলায় কেন বেকায়দায় ইসরাইলইরানে হামলায় কেন বেকায়দায় ইসরাইল
ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদ একটি দীর্ঘমেয়াদি আদর্শিক ও রাজনৈতিক মতবাদ, যা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগে এর সূচনা হলেও, কালের পরিক্রমায় এটি রাজনৈতিক শক্তির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি ছিল একদিকে ধর্মীয় পরিচয়ের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি হিসেবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা।
ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে হিন্দুত্ববাদের বিকাশের পেছনে মূলত কিছু আদর্শিক ভিত্তি কাজ করেছে। এই আদর্শিক ভিত্তি প্রাথমিকভাবে বিনায়ক দামোদর সাভারকারের লেখার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৩ সালে সাভারকার তার ‘হিন্দুত্ব : হু ইজ আ হিন্দু?’ নামক বইয়ে প্রথমবারের মতো হিন্দুত্ববাদের ব্যাখ্যা দেন। তিনি হিন্দুত্বকে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এটিকে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। তার মতে, ‘যে কেউ ভারতকে পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি হিসেবে স্বীকার করে, সে-ই প্রকৃত হিন্দু।’ এই ধারণার মাধ্যমে তিনি মুসলিম, খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয় পরিচয়ের বাইরে ঠেলে দেওয়ার ভিত্তি তৈরি করেন।
সাভারকারের এই মতাদর্শ পরবর্তীকালে আরো সুসংগঠিত রূপ নেয়, যখন কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৯২৫ সালে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (R আরএসএস)’ প্রতিষ্ঠা করেন। আরএসএস ছিল এক ধরনের আধাসামরিক সংগঠন, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল হিন্দু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রাজনৈতিক শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এই সংগঠন ভারতীয় রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করে এবং ক্রমেই হিন্দু জাতীয়তাবাদের অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর আরএসএস তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে ‘ভারতীয় জনসংঘ’ (বিজিএস) গঠন করে, যা ১৯৮০ সালে ‘ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজিপি)’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯০-এর দশকে বিজিপি ‘রাম জন্মভূমি আন্দোলন’ ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মাধ্যমে প্রথমবার রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ফলে ভারতে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। এটি ছিল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি বড় বিজয়, কারণ এর মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ব্যাপক জনসমর্থন পায়।
২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আরেকটি ভয়াবহ রূপ প্রকাশ করে। গোধরা ট্রেন অগ্নিকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গুজরাট রাজ্যে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যাতে প্রায় দুই হাজার মুসলমান নিহত হয়। সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি, যার সরকার দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় বা ইচ্ছাকৃতভাবে দাঙ্গার নিয়ন্ত্রণ নেয়নি বলে অভিযোগ ওঠে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গুজরাট দাঙ্গায় মুসলমানদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হয় এবং প্রশাসনের নীরব ভূমিকা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানকে আরো সুসংহত করে। গুজরাট দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা বিজিপির মধ্যে বেড়ে যায় এবং ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজিপি নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। এর মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী আদর্শ আরো শক্তিশালী হয় এবং মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের প্রতি দমন-পীড়ন বাড়তে থাকে।
২০১৪ সালে বিজিপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতজুড়ে গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে মুসলমানদের গণপিটুনির ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ‘গো-রক্ষা বাহিনী’ নামে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায় এবং প্রশাসন এ ধরনের অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়। ২০১৯ সালে বিজিপি সরকার ‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)’ পাস করে, যার মাধ্যমে মুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। এর পাশাপাশি, জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) কার্যকর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যা মূলত মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে। ২০১৯ সালে ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার ফলে কাশ্মীর কার্যত ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়।
হিন্দুত্ববাদের প্রভাব শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার ওপর ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী প্রভাব একাধিক ক্ষেত্রে নিজেদের উপস্থিতি রেখেছে, বিশেষ করে তিস্তা নদীর পানি চুক্তি-সংক্রান্ত বিরোধ। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তি, মূলত মোদি সরকার, এই চুক্তি বাস্তবায়নে এক ধরনের অনীহা প্রকাশ করেছে, যার ফলে বাংলাদেশকে পানিসংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিস্তা চুক্তির ফাঁকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা থাকতে পারে।
এর পাশাপাশি, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী শক্তি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যাচারের ঘটনা এবং কিছু ক্ষেত্রে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড, দেশটির অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতি ধর্মীয় সংঘাতকে উসকে দেয় এবং সমগ্র সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। এ ছাড়া, সীমান্তে বিএসএফের (বাংলাদেশ সীমানা নিরাপত্তা বাহিনী) হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএসএফের হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা প্রমাণ করে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সরকারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার প্রবণতা।
কাশ্মীর ইস্যুতে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ক চরম উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে। ভারতের একতরফা পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিক এবং সামরিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দ্বন্দ্বে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির ভূমিকা লক্ষ করা যায়, যেখানে তারা কাশ্মীরের মুসলিম জনগণের অধিকার অস্বীকার করছে এবং তাদের নিজস্ব ভাবনা অনুযায়ী গোটা অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ দাবি করছে। বিশ্বব্যাপী ভারত পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। হিন্দুত্ববাদী প্রচারণা কার্যক্রমের মাধ্যমে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে পাকিস্তান বারবার অভিযোগ করে যে ভারত তাদের বিরুদ্ধে অপ্রমাণিত সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের অভিযোগ এনে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে।
নেপালের ভূখণ্ড নিয়ে ভারতীয় শক্তির দৃষ্টি পড়ে রয়েছে। নেপাল-ভারত সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসনের যে অভিযোগ উঠেছে, তা ঘিরে বেশ কিছু বিরোধ দেখা দিয়েছে। ভারতের তৎপরতা কখনো কখনো নেপালের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, বিশেষত ভারতের একতরফা নীতির কারণে এই ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। শ্রীলঙ্কায়ও ভারতীয় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। ভারত শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে চায় এবং তা শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক সুরক্ষা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দেয়।
এ ঘটনাগুলোর মাধ্যমে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী শক্তি শুধু দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর ভেতরকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে, বরং তাদের বৈদেশিক নীতিরও অংশ হিসেবে তাদের নিজস্ব প্রভাব বিস্তার করতে তৎপর রয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি শুধু দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ক্রমেই তার প্রতিবেশী দেশগুলোর স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করছে।
হিন্দুত্ববাদ শুধু একটি ধর্মীয় মতবাদ নয়, এটি রাজনৈতিক শক্তির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কূটনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মহলকে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকৃত চেহারা বুঝতে হবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায়, এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি পুরো উপমহাদেশের স্থিতিশীলতার জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পরিণত হতে পারে।
লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল : Istiak28060511@gmail