কাঠমান্ডুর অগ্নিশিখা শুধু নেপালের বোঝা নয়—এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক সতর্কবার্তা। দুর্নীতি, অভিজাততন্ত্র ও বৈষম্যের অবসান চাইতে অস্থির তরুণদের হঠাৎ বিক্ষোভ প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং নেপালের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই অভ্যুত্থান শুধু একটি অভ্যন্তরীণ সংকট নয়; এটি ভেঙে দিয়েছে ভারতের সেই স্থিতিশীলতার ভ্রম, যা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী অঞ্চলে ছড়াতে চেয়েছে।
নেপালের এই অস্থিরতা আলাদা কোনো ঘটনা নয়। এর আগে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নাটকীয় পতন (২০২৪) এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির ধস, যা রাজাপক্ষ পরিবারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, এই অঞ্চলের নতুন প্রবণতাকে সামনে এনেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক গণঅভ্যুত্থান ইঙ্গিত দিচ্ছে : প্রভাবশালী অভিজাতরা ভেসে যাচ্ছেন এক প্রজন্মের হাতে, যারা আর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা স্বৈরতন্ত্র মেনে নিতে রাজি নয়। ভারতের জন্য—যে দেশ বিশ্ব দক্ষিণের কণ্ঠ হতে চায়—এই তরঙ্গ তার ‘পেছনের আঙিনার কূটনীতি’কে ক্রমেই অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত করে তুলছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্রোহের শৃঙ্খল
আজ দক্ষিণ এশিয়া যেন এক রাজনৈতিক পরীক্ষাগার, যেখানে বৈধতা প্রতিনিয়ত পরীক্ষার মুখে। বাংলাদেশে হাসিনার একসময়ের অপ্রতিরোধ্য শাসন ভেঙে পড়েছিল দমন-পীড়ন, ইন্টারনেট বন্ধ, বিরোধীদের গ্রেপ্তার ও ছাত্রদের ওপর হত্যাযজ্ঞের ভারে। শ্রীলঙ্কায় খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের ঘাটতিতে ক্ষুব্ধ লক্ষাধিক মানুষ ২০২২ সালে কলম্বোতে নেমে আসে এবং গোতাবায়া রাজাপক্ষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এখন নেপাল—তিন কোটি মানুষের হিমালয়ী দেশ, যার ভারতের সঙ্গে গভীর সাংস্কৃতিক বন্ধন—এই তরঙ্গের অংশ হয়েছে। অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি ২০২৬ সালের শুরুতে নির্বাচনের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন।
পুরো অঞ্চলে ক্ষোভ তিনটি বিষয়ের ওপর একীভূত : দুর্নীতি, বৈষম্যের বিস্তার এবং বংশীয় ঔদ্ধত্য। দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ জনসংখ্যা—বাংলাদেশেই ৬০ শতাংশের বেশি ৩৫ বছরের নিচে—আজ বিশ্বায়িত, ডিজিটালি সংযুক্ত এবং পরিবর্তনের জন্য অস্থির।
ভারতের জন্য ফল সুস্পষ্ট। দশক ধরে দিল্লি প্রতিবেশী ব্যবস্থাপনায় অর্থনৈতিক সহায়তা, সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা ও মাঝেমধ্যে চাপ প্রয়োগের কৌশল ব্যবহার করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক অস্থিরতা প্রকাশ করেছে গভীর বাস্তবতা : প্রতিবেশীরা ভারতকে প্রয়োজনীয় হলেও কর্তৃত্ববাদী মনে করে—বাণিজ্য ও জ্বালানির সঙ্গী, তবে সংবিধান, সীমান্ত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপকারীও।
নেপালের বিদ্রোহের দীর্ঘ ঐতিহ্য
আজকের বিদ্রোহ বুঝতে হলে নেপালের গণপ্রতিরোধের ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে।
জন আন্দোলন (১৯৯০) : ব্যাপক প্রতিবাদ রাজা বিরেন্দ্রকে একনায়কতন্ত্র ত্যাগে বাধ্য করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত নীরবে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
মাওবাদী বিদ্রোহ ও জন-আন্দোলন (২০০৬) : এক দশকের গৃহযুদ্ধে ১৭,০০০-এর বেশি প্রাণহানি ঘটে। ২০০৬ সালের গণআন্দোলন দেশ অচল করে দেয়, রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। দুই বছর পর রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়।
২০১৫ সালের সংবিধান ও অবরোধ : নতুন সংবিধানপ্রণয়ন প্রান্তিক মধেশি জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ ডেকে আনে। ভারতের অনানুষ্ঠানিক অবরোধ ক্ষোভ বাড়ায় এবং নেপালকে চীনের দিকে ঠেলে দেয়।
এই আলোকে বর্তমান বিদ্রোহ হলো সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা, যেখানে নেপালি নাগরিকরা বারবার ব্যর্থ রাজনৈতিক অভিজাতদের চ্যালেঞ্জ জানায়। তবে এবার ভিন্নতা হলো তরুণদের বিপুল অংশগ্রহণ ও ডিজিটাল যোগাযোগের শক্তি। ভারতের জন্য এটি বার্তা : কাঠমান্ডুতে একক নেতা বা সরকারকে আঁকড়ে ধরা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ—কারণ জনঅভ্যুত্থান এক রাতেই পুরো খেলার নিয়ম বদলে দিতে পারে।
চীনের ছায়া
ভারতের ফেলে যাওয়া শূন্যস্থান দ্রুত কাজে লাগাচ্ছে বেইজিং। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) ইতোমধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ার চেহারা বদলে দিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থায়নে তৈরি হাম্বানটোটা বন্দর ঋণখেলাপির পর ৯৯ বছরের জন্য লিজে দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানে ৬২ বিলিয়ন ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর বেইজিংয়ের উপস্থিতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। আর নেপালে ভারতের ২০১৫ সালের অবরোধ কাঠমান্ডুকে চীনের দিকে ডিসিসিভলি (decisively) ঠেলে দেয়।
চীনের ভূমিকা শুধু অবকাঠামোতেই সীমাবদ্ধ নয়; তারা দক্ষতার সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে—ঢাকা, কাঠমান্ডু, কলম্বো ও মালে—এবং নিজেদের এমন এক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তুলে ধরেছে, যারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে না, ভারতের বিপরীতে।
বাংলাদেশে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে ইতোমধ্যেই চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন মঞ্চ তৈরি হয়েছে। ইউনূস চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। ভারত, যে হাসিনায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল, তার জন্য এটি বড় ধাক্কা।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য, যা দিল্লি থেকে ছড়ানো হয় এবং যা বাংলাদেশ, মালদ্বীপ (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ) ও শ্রীলঙ্কায় (বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ) বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। যেখানে ভারত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিয়ে সফট পাওয়ার প্রতিষ্ঠা করতে পারত, সেখানে অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদ তাকে প্রাকৃতিক মিত্রদের থেকে দূরে সরাচ্ছে।
ভারতের দ্বিধা : নেতৃত্ব না বিচ্ছিন্নতা?
ভারতের বহুল আলোচিত ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা ও যৌথ সমৃদ্ধি প্রদর্শনের জন্য নকশা করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা অনেক সময় ব্যর্থ হয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও চীনের সঙ্গে শূন্যসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপে। ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত অজনপ্রিয় নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভারত সাধারণ নাগরিকদের কণ্ঠ উপেক্ষা করেছে। আর যখন সেই নেতারা পতিত হয়েছেন, ভারতকে তাদের অজনপ্রিয়তার অংশীদার হিসেবে দেখা হয়েছে।
ভারতের দ্বন্দ্ব প্রকট : একদিকে তারা মানবিক সহায়তা দিয়েছে—২০১৫ সালের ভূমিকম্পের পর নেপালে ত্রাণ, মহামারির সময় ভ্যাকসিন, শ্রীলঙ্কায় জরুরি জ্বালানি। অন্যদিকে তারা এই সদিচ্ছা নষ্ট করেছে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ বা সীমান্তকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। নেপালের ২০১৫ সালের অবরোধ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলাদেশেও ভিসা সীমাবদ্ধতা ও সীমান্তবিরোধ জনসম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এই সাহায্য ও ঔদ্ধত্যের মিশ্রণ গভীর ক্ষোভ তৈরি করছে, যা চীনের জন্য আরো বিশ্বাসযোগ্য অংশীদার হওয়ার সুযোগ এনে দিচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার বারুদভর্তি কৌটো
মাইকেল কুগেলম্যান দক্ষিণ এশিয়াকে ‘বারুদভর্তি কৌটো’ বলেছেন। সত্যিই তাই। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখানে বাস করে, যাদের বড় অংশই তরুণ ও অস্থির। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিশ্বসচেতনার কারণে তারা দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম—কাঠমান্ডু, ঢাকা ও কলম্বো তার উদাহরণ।
ভারতের জন্য বিপদ দ্বিমুখী। একদিকে তারা জি২০ ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিশ্ব দক্ষিণের কণ্ঠ হতে চায়। কিন্তু প্রতিবেশীরা যদি ভারতকে ঔদ্ধত্যপূর্ণ, কর্তৃত্ববাদী বা শোষক হিসেবে দেখে, তবে সেই বৈশ্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা ফাঁপা শোনাবে।
ভারতকে কী করতে হবে
ভারত যদি বেইজিংয়ের কাছে পিছিয়ে পড়া ও প্রতিবেশীদের অবিশ্বাস এড়াতে চায়, তবে কূটনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। চারটি মূল পরিবর্তন অপরিহার্যÑ
১. অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান : শক্তিশালী ব্যক্তির ওপর নির্ভর না করে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে সমর্থন করতে হবে।
২. অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব : শুধু ঋণ নয়, সবুজ জ্বালানি, ডিজিটাল সংযোগ, জলবায়ু সহনশীলতা ও তরুণ উদ্যোক্তা খাতে যৌথ প্রকল্প দরকার।
৩. পররাষ্ট্রনীতিতে হিন্দুত্ব কমানো : ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতি প্রতিবেশীদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে। বহুত্ববাদী ঐতিহ্যই ভারতের কূটনীতিকে সংজ্ঞায়িত করা উচিত।
৪. বিশ্বাস দিয়ে চীনকে মোকাবিলা : চীন অর্থ দিতে পারে, বন্দর বানাতে পারে; কিন্তু ভারত দিতে পারে বিশ্বাস, খোলা সীমান্ত, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বন্ধন।
এক সংকটময় মোড়ে ভারত
ভারতের এখনো অনেক সুবিধা আছে—দ্রুততম বেড়ে ওঠা অর্থনীতি, বৈশ্বিক প্রভাবশালী প্রবাসী, বলিউড থেকে যোগ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক শক্তি। কিন্তু প্রভাব মানেই ভাগ্য নয়। ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু, কলম্বো—সব জায়গা থেকে বার্তা আসছে : ভারত নির্দেশ দিতে পারবে না—শুনতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে এবং বিনয়ের সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার তরুণরা রাজনৈতিক চিত্রনাট্য নতুন করে লিখছে। প্রশ্ন হলো—ভারত কি তা পাড়বে, নাকি সেই কাহিনির বাইরে চলে যাবে?