র্যাচেল অ্যান অ্যাকিউরসো একজন আমেরিকান ইউটিউবার শিক্ষক, সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি মিস র্যাচেল নামেই বেশি পরিচিত সবার কাছে। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি শিশুদের প্রিয় একজন শিক্ষক, যিনি ইউটিউবে সববয়সি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে আসছেন অনেক দিন ধরে। শিশুদের ভাষা শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে তার বানানো গানের ভিডিও সিরিজ ‘সংস ফর লিটলস’ মিস র্যাচেলকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। তার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা দেড় কোটির বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ পরিবারের শিশুরা তার শিক্ষামূলক ভিডিও দেখে। এ কারণে তিনি এসব পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছেন। এসব পরিবারের বাবা-মায়েরা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষাজীবন শুরু করা নিয়ে যখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভোগেন, তখন তাদের কাছে ত্রাতা বা উদ্ধারকর্তা হিসেবে নিজের শিক্ষামূলক ভিডিও নিয়ে টিভির পর্দায় হাজির হন মিস র্যাচেল। এভাবেই তিনি তাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠেছেন সবার অজান্তেই।
বিশেষ করে কোভিড-৯ বা করোনা মহামারির সময় যখন দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তখন মিস র্যাচেলের ভিডিওগুলো হয়ে উঠেছিল প্রতিটি পরিবারের শিশুদের লেখাপড়া অব্যাহত রাখার গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মিস র্যাচেল তার শিক্ষামূলক ভিডিওগুলো দিয়ে আমেরিকান অভিভাবকদের প্রিয় একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। শিশুরাও তার ভিডিওর গান শুনে এতটাই অনুপ্রাণিত হয়, অনেক সময় তারা ঘুমের ঘোরেও গেয়ে উঠে গানের কলিগুলো।
করোনা মহামারির সময়ে যখন ঘরের বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না, তখন মিস র্যাচেলের হাসিমাখা মুখ ও সুরেলা কণ্ঠের গানের সুরে ভাষা শিক্ষার পাঠদান শিশুদের পাশাপাশি অভিভাবকদের টিভি পর্দার সামনে টেনে আনত। সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন আমেরিকান জনগণের কাছে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা একজন মানুষ, একজন আদর্শ শিক্ষক।
কিন্তু গাজার শিশুদের হত্যা ও তাদের দিনের পর দিন অনাহারে রেখে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার প্রতিবাদ করার পরই মিস র্যাচেলকে নিয়ে বিরূপ প্রচারণা শুরু হয়। তার ভিডিও চ্যানেল বয়কট করার আহ্বান জানানো হয়। অভিযোগ করা হয়, মিস র্যাচেল সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, তিনি হামাসের একজন এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।
মিস র্যাচেল গাজা নিয়ে কী এমন কথা বলেছিলেন, যার জন্য তার ভিডিও চ্যানেল বর্জন এবং তাকে হামাসের এজেন্ট হিসেবে অভিহিত করা হলো? তিনি শুধু এটুকুই বলেছিলেন, বিশ্বের সব অঞ্চলের শিশুদের মতো ফিলিস্তিনি শিশুদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। গাজার শিশুদের এমন করুণ মৃত্যু কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, এটাই তার অপরাধ। যিনি আমেরিকান শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি গাজার শিশুদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় তাকে এখন সন্ত্রাসবাদের সমর্থক ও হামাসের এজেন্ট বলা হচ্ছে।
নিউ ইয়র্ক পোস্ট পত্রিকা চলতি বছরের শুরুর দিকে তাদের এক প্রতিবেদনে মিস র্যাচেলকে ‘জেগে ওঠা মগজ ধোলাইকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলপন্থি লবিস্ট গ্রুপ স্টপ অ্যান্টিসেমিটিজম র্যাচেলের ‘হামাসপন্থি প্রচার’ চালানোর বিষয়ে তদন্ত করার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।
গাজার ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ-সংক্রান্ত খবর নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করা এবং ইসরাইলি হামলায় গুরুতর আহত ফিলিস্তিনি বিশেষ করে গাজার সাংবাদিক মোতাজ আজাইজার দুই পা হারানো তিন বছরের সন্তান রাহাফ আয়াদের ছবি নিজের একটি ভিডিওতে দেওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে এমন প্রচার শুরু করে আমেরিকান ইসরাইলি লবি।
গাজা উপত্যকার জনসংখ্যার অর্ধেকেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। ইসরাইলের গত দুই বছরের সামরিক আগ্রাসনে গাজার ৫০ হাজারেরও বেশি শিশু গণহত্যার শিকার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিদিনই সেখানে বিমান হামলায় নিজেদের বিধ্বস্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। স্কুলে ও শরণার্থীশিবিরে, ত্রাণ আনতে গিয়ে এমনকি সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে গিয়েও গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে কিংবা বোমা হামলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়েও মারা যাচ্ছে শিশুরা। আবার অনেক সময় ইসরাইলি স্নাইপাররাও টার্গেট করে হত্যা করছে শিশুদের। বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জড়ো করে দাফন করছেন প্রতিনিয়ত।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস গাজা উপত্যকাকে ‘শিশুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা’ হিসেবে অভিহিত করেছে। বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের তুলনায় গাজায় অঙ্গচ্ছেদ হওয়া শিশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গাজার পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ, সেখানে বেঁচে থাকা এমন কোনো পরিবার নেই, যাদের ঘরে গুরুতর আহত বা অঙ্গহানির শিকার হওয়া কোনো শিশু নেই। ইসরাইল ও তাদের মিত্ররা পরিকল্পিতভাবে গাজার হাজার হাজার শিশুকে এতিমে পরিণত করেছে, তাদের পুরো বাবা-মাসহ পুরো পরিবারকে হত্যার মাধ্যমে।
একই সঙ্গে গাজা এখন ‘বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধার্তদের জায়গা’ হয়ে উঠেছে। খাদ্যের অভাবে অপুষ্টিতে ভুগে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে গাজার শিশুরা। ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার এমন বেদনাদায়ক ঘটনা এই মুহূর্তে বিশ্বের আর কোথাও ঘটছে না। অথচ দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ এই উপত্যকায় ত্রাণসামগ্রী অবাধে প্রবেশ করতে দেওয়া হলে শিশুদের এমন মৃত্যু ঠেকানো যেত।
গাজার শিশুদের করুণ পরিণতি দেখেই তাদের সহায়তার পক্ষে কথা বলেছিলেন মিস র্যাচেল। সেটাই হয়েছে তার বড় অপরাধ। তাকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক ও হামাসের এজেন্ট আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের আক্রমণের কারণ হচ্ছে সবার মুখ বন্ধ করে দেওয়া, যাতে গাজায় ইসরাইল ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের বর্বরতার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে না পারে।
তবে ইহুদি বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল ও তাদের মার্কিন সমর্থকদের আক্রমণের বিরুদ্ধে ঠিকই মুখ খুলেছেন মিস র্যাচেল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, যারা গাজা নিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখবে, গাজায় চলমান বর্বরতার বিরুদ্ধে কথার বলার অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেদের আড়ালে রাখতে চায়, তাদের সঙ্গে তিনি আর কখনো কাজ করবেন না।
মাতৃত্ব ও সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে অনেক নারী-পুরুষেরই ইউটিউব চ্যানেল আছে। এসব চ্যানেলে তারা শিশুদের শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে তারা নিজেদের ‘গুরু’ ভাবে। শিশুবিষয়ক এসব চ্যানেলকে ব্যবহার করে অনেকেই বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন।
তারা ইউক্রেনের সাদা চামড়ার শরণার্থীদের জন্য তহবিল ও অনুদান সংগ্রহ করতে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু এদের কেউই গাজার বাদামি চামড়ার শিশুদের ওপর ইসরাইল ও তার মিত্রদের বর্বরতা নিয়ে কথা বলেন না। গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনি শিশুদের লাশের স্তূপ বা সারি দেখে তাদের হৃদয়ে সামান্য রক্তক্ষরণও হয় না। এ বিষয়ে তারা একেবারেই নীরব।
পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মিত্র দেশগুলোর স্কুলগুলোয় শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে গাজায় ইসরাইলের বর্বরতা নিয়ে কোনো কথা বললে বা সমালোচনা করলে, তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কেউ স্কুলের ইউনিফর্মে ফিলিস্তিনি পিনব্যাজ পরলে বা ফিলিস্তিনের পক্ষে কোনো মতামত তৈরির চেষ্টা করলে, তাকে অনেক সময় সন্ত্রাস দমন পুলিশের হাতেও তুলে দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক আবহাওয়া দিন দিন জোরালো হয়ে ওঠায় এসব দেশে বাড়ছে ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষ।
বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে, তা মুহূর্তেই জেনে যাচ্ছে। ফলে গাজার গণহত্যার চিত্র তারা নিয়মিতই দেখছে। ইসরাইলের এই বর্বরতার বিষয়ে পশ্চিমাদের রহস্যজনক নীরবতা তাদের মনে একদিকে প্রশ্নের ও অন্যদিকে ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে ইসরাইলের বিরোধিতাকে ইহুদিবিদ্বেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ জন্য মনে ক্ষোভ থাকলেও প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে পারছেন না।
কিন্তু মিস র্যাচেল ভয় পাননি। তিনি গাজায় ইসরাইলের বর্বরতা নিয়ে মুখ খুলেছেন। আমেরিকান ইহুদি লবির চোখ রাঙানিকে ভয় না পেয়ে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন বুকে প্রবল সাহস নিয়ে। ইনস্টাগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, গাজার শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যদি নিজের ক্যারিয়ারকেও বিসর্জন দিতে হয়, তাও তিনি দেবেন, কিন্তু কিছুতেই নিজের অবস্থান থেকে এক চুল সরবেন না। কারণ শিশুদের নিয়ে কাজ করার জন্যই তিনি আজকের ‘মিস র্যাচেল’ হয়েছেন।
দ্য নিউ আরব থেকে ভাষান্তর :