এনবিআরের সংস্কার প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো—রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা একই কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকায় কাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা এ ধারণাকে ভিত্তিহীন বলেই মনে করছেন। তাদের মতে, রাজস্ব খাতে জবাবদিহিতার অভাবের প্রকৃত কারণ হলো অতিরঞ্জিত জিডিপি হিসাব, অযৌক্তিক কর অব্যাহতি, রাজস্ব খাতে বিনিয়োগের ঘাটতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত দুর্বলতা।
গত ১২ মে ২০২৫ সরকার এক প্রজ্ঞাপনে শতবর্ষী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে তার পরিবর্তে ‘রাজস্ব নীতি বিভাগ’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ’ নামে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেয়। এ প্রজ্ঞাপন এনবিআরের অভ্যন্তরে তীব্র অসন্তোষ ও বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে সংস্কার নিয়ে এ অচলাবস্থার পেছনের মূল কারণ কী?
সরকারি প্রজ্ঞাপনে এনবিআর বিলুপ্তির পেছনে যে তিনটি প্রধান কারণ তুলে ধরা হয়েছে, তা হলো: রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং গতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা। আপাতভাবে এগুলো যৌক্তিক ও ইতিবাচক বলে মনে হলেও এনবিআরের কর্মকর্তাদের আপত্তির কেন্দ্রে রয়েছে ঠিক এ যুক্তিগুলোই।
এনবিআরের সংস্কার প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হলো—রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা একই কর্তৃপক্ষের আওতায় থাকায় কাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এনবিআরের কর্মকর্তারা এ ধারণাকে ভিত্তিহীন বলেই মনে করছেন। তাদের মতে, রাজস্ব খাতে জবাবদিহিতার অভাবের প্রকৃত কারণ হলো অতিরঞ্জিত জিডিপি হিসাব, অযৌক্তিক কর অব্যাহতি, রাজস্ব খাতে বিনিয়োগের ঘাটতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও আইনগত দুর্বলতা।
একটি বড় সমস্যার দিকে তারা আলোকপাত করেছেন: এনবিআরের চেয়ারম্যান পদে প্রায়ই ট্যাক্স ও কাস্টমস ক্যাডারের বাইরের, বিশেষ করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। এদের অনেকেরই আয়কর, কাস্টমস বা ভ্যাট আইনে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে রাজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মনে করেন, কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত এনবিআর চেয়ারম্যান পদে বিসিএস কর ও কাস্টমস ক্যাডারের দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া।
কিন্তু ওই ঘোষিত প্রজ্ঞাপনে এনবিআরের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেয়া হয়েছে। ফলে রাজস্ববিষয়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রশাসন ক্যাডারের সরাসরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আগেও এনবিআরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্ব বজায় ছিল, তবে সাম্প্রতিক প্রজ্ঞাপনে সেই কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করা হয়েছে। সংগত কারণেই এনবিআর কর্মকর্তারা সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন।
এনবিআর নিয়ে জনমনে বহু অভিযোগ রয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব দুর্বলতার দায় কি এককভাবে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর চাপানো যাবে? এনবিআর নিজে এক অর্থে কোনো স্বশাসিত সংস্থা নয়। এর সর্বোচ্চ পদটি অধিকাংশ সময়ই প্রশাসন ক্যাডারের হাতে থাকে যাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। ফলে এনবিআরের দুর্নীতির দায় সেই নেতৃত্বের ওপরও বর্তায়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তো রয়েছেই।
তবে যে যুক্তিতে এনবিআর পৃথক করা হয়েছে সেই যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য। কারণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পৃথক থাকলে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির ঝুঁকি কমে এবং একই সঙ্গে জবাবদিহিতা ও বস্তুনিষ্ঠতাও বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের সাংবিধানিক দর্শনও এমনই। এ কারণেই বাংলাদেশের সংবিধানে নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগ নামে তিনটি বিভাগ রাখা হয়েছে। সেই আলোকে এনবিআরকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত আদর্শিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়: এক. রাষ্ট্রের অন্যান্য খাতে কি সরকার একই দর্শন বাস্তবায়ন করছে? দুই. একটি স্বল্পমেয়াদি সরকারের কাছে এ সিদ্ধান্ত কতটা অগ্রাধিকারযোগ্য এবং যৌক্তিক?
এ দুই বিষয় আলাদা হলেও এরা আসলে একই সুতায় গাঁথা।
সরকারি চাকরিজীবী তথা ক্যাডার সার্ভিসের গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্যাডার হলো বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার। এই ক্যাডার মাঠপর্যায় থেকে সচিবালয় পর্যন্ত একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী। তারা মাঠপর্যায়ে যেমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী, আবার মন্ত্রণালয়েও নীতিনির্ধারণী বিষয়েও তাদের রয়েছে একচেটিয়া প্রভাব। সরকার কি রাষ্ট্রীয় শাসনতান্ত্রিক দর্শনের সঙ্গে সংগতি রেখে প্রশাসনিক কার্যক্রমের পৃথকীকরণ করছে? প্রশাসনিক এ পৃথকীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা অতীতের প্রায় সব প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনই সুপারিশ করেছে। এ লক্ষ্যে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগে যে সুপারিশ অতীতের প্রশাসনিক সংস্কার কমিশনগুলো বারবার দিয়েছে, তা কি সরকার বাস্তবায়ন করছে? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এ বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। অথচ এটাই হতে পারত বর্তমান সরকারের সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ। কারণ অনেক বিশ্লেষকের মতে, বিগত সরকার ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার পেছনে প্রশাসন ক্যাডারের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকর ছিল। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোয় তাদের বিতর্কিত ভূমিকা প্রমাণ করেছে—নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রভাবিত করার অন্যতম হাতিয়ার প্রশাসন ক্যাডার। কাজেই প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দমন যেমন সম্ভব নয়, ফ্যাসিবাদ নিয়ন্ত্রণও সম্ভব নয়। বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হওয়া সম্ভব নয়।
যদি সত্যিকারের ‘জুলাই অভ্যুত্থান’কে একটি যথার্থ বিপ্লবে রূপ দিতে হয়, ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করতে হয়, তবে এনবিআরের পৃথকীকরণ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, প্রশাসনের নীতি ও বাস্তবায়ন কর্তৃত্বের পৃথকীকরণ তার চেয়েও বেশি জরুরি। বিশেষ করে উপসচিব পদে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে—এটাই হওয়া উচিত সরকারের সংস্কার কর্মসূচির এক নম্বর অগ্রাধিকার। অথচ সরকার তা না করে তুলনামূলক গৌণ ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসায় অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছেন। আর এনবিআরের কর্মকর্তারাও বিষয়টিকে দেখছেন বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে।
তাদের অভিযোগ, সরকারের অন্যান্য সংস্কার উদ্যোগে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা হলেও এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এককভাবে রাতের আঁধারে। ফলে এটি অংশীজনকে উপেক্ষা করে এক বিশেষ গোষ্ঠীর অভিরুচি বাস্তবায়নের অপচেষ্টা বলেই তারা মনে করছেন। অথচ সরকার অন্য সব সংস্কারের ক্ষেত্রে ঐকমত্য পরিষদের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনার এক শুভ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাও মানা হয়নি।
এনবিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সর্বজনীন মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম চালানোই হবে দীর্ঘস্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য পথ। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবে প্রশাসনিক সংস্কারে এমন পদক্ষেপ নেয়া যা ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণে সহায়ক হয়, একক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে দেয় এবং রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক কাঠামোর পথে এগিয়ে নেয়।
সফিক ইসলাম: লেখক ও শিক্ষক