ইসরাইলের সংবাদপত্র হায়োমে সম্প্রতি একটি নিবন্ধ লিখেছেন শেই গাল। তার লেখাটি নিয়ে অনেক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নিবন্ধের শিরোনাম ‘নর্দার্ন সাইপ্রাস ইজ অলসো অ্যান ইসরাইলি প্রবলেম’। অর্থাৎ উত্তর সাইপ্রাস ইসরাইলেরও একটি সমস্যা। এই লেখার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে টার্কিশ রিপাবলিক অব নর্দার্ন সাইপ্রাস (টিআরএনসি) ও তুরস্ক। গাল একসময় ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ইসরাইল সরকারের মন্ত্রীদের জন্য সিনিয়র উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। তার লেখায় তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও সাইপ্রাসে নেতানিয়াহু সরকারের নীতি মূল্যায়নের চেষ্টা করেছেন।
নিবন্ধে বেশ কিছু হাস্যকর দাবি করেছেন গাল। যেমন বলেছেন, তুরস্ক নাকি সাইপ্রাসে আগ্রাসন চালিয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, ইসরাইল যদি তুরস্কে হামলা চালায়, তাহলে ন্যাটো পঞ্চম অনুচ্ছেদের অধীনে তুরস্ককে সুরক্ষা দেবে না। তিনি বলেছেন, গ্রিস আর গ্রিস-নিয়ন্ত্রিত সাইপ্রাসের প্রশাসন তুরস্কের বাহিনীকে টিআরএনসি থেকে সরিয়ে দেবে। তিনি এমনকি এটাও বলেছেন, রাশিয়া আক্কায়ু পারমাণবিক প্ল্যান্ট পরিত্যাগ করছে। এগুলো এতটাই হাস্যকর যে সেগুলো নিয়ে আলোচনারও কিছু নেই।
কিন্তু টিআরএনসি নিয়ে যেসব দাবি তোলা হয়েছে, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। এসব মিথ্যা বিবৃতির পেছনে কী লুকানো, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। এক কলামে গাল টিআরএনসি’কে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, এই অঞ্চলটা বিশৃঙ্খল ও অনিয়ন্ত্রিত। তিনি বলেছেন, এটা পথিকের সরাইখানা বা গুন্ডাদের ঘাঁটির মতো জায়গা। তিনি দাবি করেছেন, এই অবস্থার কারণে তুরস্ক, হামাসের মতো ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ এবং ইরানের কুদস বাহিনী অবাধে কাজ করতে পারছে।
তিনি আরো বলেছেন, টিআরএনসির হোটেল, বিশ্ববিদ্যালয় ও বন্দরগুলো গোয়েন্দাগিরির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। তিনি দাবি করেছেন, এগুলো ব্ল্যাকমেইল বা গোয়েন্দা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি বলেছেন, তুরস্কের নিরাপত্তা বাহিনী এবং অপরাধ নেটওয়ার্ক এগুলো চালাচ্ছে। ‘গার্ডিয়ান অব দ্য ওয়ালস’ ও ‘আইরন সোর্ডস’-এর মতো গ্রুপগুলোর তথাকথিত গোপন বার্তার দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি। এই বার্তাগুলো যারা তৈরি করেছে, তারা ছাড়া কেউই সেগুলো শোনেনি। তিনি বলেছেন, হামাস ও ইরানের কুদস বাহিনী টিআরএনসিতে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য নাকি ইউরোপে ইসরাইলিদের ওপর হামলা চালানো।
এই অঞ্চলে ইসরাইলের যে পরিকল্পনা, সেখানে সাইপ্রাস যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে এ ধরনের মিথ্যা ও আজগুবি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, ইসরাইল আসলে সাইপ্রাস নিয়ে কী করতে চাচ্ছে?
সাইপ্রাসের অবস্থানটা গুরুত্বপূর্ণ। কৌশলগত জায়গায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। এটা বিশ্ববাজারে জ্বালানি পরিবহনের অন্যতম রুট হতে পারে। এই এলাকার নিরাপত্তাকেও তারা প্রভাবিত করে। ইসরাইলের জন্যও এই দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইল এই অঞ্চলে শীর্ষ শক্তি হতে চায়। ইস্টমেড পাইপলাইনের মতো প্রকল্প দিয়ে সেটা বোঝা গেছে। ইস্টার্ন মেডিটেরানিয়ান গ্যাস ফোরামের মাধ্যমেও সেটা বোঝা গেছে। এই প্রকল্পগুলোর উদ্দেশ্য হলো ইউরোপে জ্বালানি পাঠানো। এভাবে জ্বালানি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলে ইসরাইলের লাভ হবে। তারা তুরস্ক আর টিআরএনসি’কে এর বাইরে রাখতে চায়। কারণ তুরস্কের কারণে ইসরাইলের বৃহত্তর পরিকল্পনা আটকে যাবে।
গ্রিক সাইপ্রাসের প্রশাসন ছোট ও দুর্বল। ইসরাইলের জন্য টার্গেট হিসেবে তারা সহজ। সেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা আছে। তাদের নেতারাও তেমন শক্তিশালী নন। গ্রিক সাইপ্রাসের নেতা নিকোস ক্রিস্টোডুলাইডস ইসরাইল আর যুক্তরাষ্ট্রকে একটু বেশিই পছন্দ করেন। তাদের ওপর তাকে নির্ভর করতে হয়। সে কারণে তার দেশটা এই অঞ্চলের দুর্বলতম সংযোগবিন্দু হয়ে গেছে। গ্রিক সাইপ্রাসের নাগরিকরা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে তুর্কিদের ঘৃণা করে। তারা মনে করে, শত্রুর শত্রু হলো তাদের বন্ধু। এসব মিলিয়ে গ্রিক আর ইহুদিদের মধ্যে অশুভ জোট গড়ে উঠেছে।
২০১০ সালে তারা এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) নিয়ে চুক্তি করেছে। এতে প্রতিরক্ষা সম্পর্কও জোরদার হয়েছে। তারা গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে, যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নেয়। নেতারা একে অন্যের দেশে উচ্চ পর্যায়ের সফরে যায়। যুক্তরাষ্ট্র গ্রিসের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। গ্রিক প্রশাসন ইসরাইল থেকে আয়রন ডোম সিস্টেম কিনতে চায়। সব মিলিয়ে দুইয়ের জোট বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি আরেক ধাপ এগিয়েছে। গ্রিক সাইপ্রাস লারনাকা ও পাফোসে ইসরাইলি গোয়েন্দাদের বিমানবন্দরে নিরাপত্তা দিয়েছে। গ্রিক সাইপ্রাসের সংবাদপত্রগুলো এজন্য ক্রিসটোডুলাইডসের কঠোর সমালোচনাও করেছে। তারা বলেছে, তিনি দেশের সার্বভৌমত্ব ইসরাইলের হাতে তুলে দিয়েছেন। গ্রিক সাইপ্রাস এখন আগের চেয়ে আরো বেশি ইসরাইলের ওপর নির্ভর করছে। গ্রিক সাইপ্রাসে যে ব্রিটিশ ঘাঁটি রয়েছে, তারা ইসরাইলকে লজিস্টিক্স দিয়ে সাহায্য করছে। ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের অভিযানে তারা সহায়তা করছে।
এই জোটের আরেকটি লক্ষ্য হলো টিআরএনসি’কে ব্লক করে দেওয়া। তারা এই অংশের স্বীকৃতিও দেয় না এবং তাদের অবস্থানও পছন্দ করে না। তুর্কি সাইপ্রাসেরও যে দ্বীপের সম্পদের ওপর অধিকার আছে, সেটা তারা মানতে চায় না। গ্রিক সাইপ্রাসের যে দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বমঞ্চে, সেটাকেই সমর্থন করে ইসরাইল। টিআরএনসি’কে স্বীকৃতি দেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টা তারা বন্ধ করে দেয়।
টিআরএনসিতে নিজেদের অবস্থান সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছে ইসরাইল। নির্মাণাধীন বিভিন্ন জায়গা ও মেরিন অঞ্চলকে তারা ব্যবহার করেছে। এতে অস্থিরতা আরো বেড়েছে। ২০২৩ সালে বিদেশিদের সম্পদ কেনার ব্যাপারে টিআরএনসি নতুন নিয়ম করে। এরপর সেই তৎপরতা বন্ধ হয়।
ইসরাইলিরা এরপর দক্ষিণ সাইপ্রাসে সরে গেছে। প্রায় ১৫ হাজার ইসরাইলি ইসরাইল ছেড়ে গেছে। তেল আবিব যখন ইরানের ওপর হামলা করল, তখন এই ইসরাইলিরা দক্ষিণ সাইপ্রাসে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। গ্রিক সাইপ্রাসের সংবাদপত্রগুলোয় শিরোনাম ছিল এ রকম—‘ব্যাকইয়ার্ড হিসেবে সাইপ্রাসকে কিনে নিচ্ছে ইসরাইলিরা।’ আরেকটি শিরোনাম ছিল— ‘এটা যেন প্রতিশ্রুত ভূমি। কেন সাইপ্রাসে জমি কিনছে ইহুদিরা?’ সেখানকার দ্বিতীয় বৃহত্তর দলের নাম প্রগ্রেসিভ ওয়ার্কিং পিপলস পার্টি (একেইএল)। ইসরাইলের জমি কেনা নিয়ে তারা উদ্বেগ জানিয়েছে। তারা কৌশলগত জায়গাগুলোকে টার্গেট করেছে, যেটা নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। একেইএল বলেছে, ‘আমাদের দেশটা হারিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল আমাদের দখল করছে।’ দলের নেতা স্টেফানোস স্টেফানু প্রশ্ন তুলেছেন, ক্রিস্টোডুলাইডসের এমন কি দায় আছে নেতানিয়াহুর কাছে, তিনি এসব ঘটতে দিচ্ছেন? ইসরাইলের প্রতি ক্রিস্টোডুলাইডসের পূর্ণ সমর্থন নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি পুরোনো মিত্র ব্রিটেনও এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এই জোট ইসরাইলের বৃহত্তর পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করছে। তারা গ্রিক অংশের ‘শত্রুর শত্রু’ যুক্তিটাও গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর একটা সীমা আছে। গ্রিক সাইপ্রাসের প্রশাসন ইসরাইলের স্বল্পকালীন মিত্র। ইতিহাসে আরো বহু শক্তিকে ইসরাইল এভাবে ব্যবহার করেছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে তাদের কাজে লাগিয়েছে। গ্রিক সাইপ্রাসের ইইজেডের ১২নং ব্লকের একটা অংশ হলো আফ্রোদিতি ফিল্ড। সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় রিজার্ভ রয়েছে। ইসরাইল দাবি করেছে, এটা উপচে ইইজেডে প্রবেশ করেছে। তারা তখন গ্রিক পক্ষকে চাপ দিয়েছে। তারাও নতি স্বীকার করেছে। বোঝা গেছে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব লাগলে ইসরাইল কাউকেই সত্যিকারের বন্ধু মনে করে না। ইতিহাসও মনে রাখা দরকার। ইহুদি আর গ্রিকদের মধ্যে বহু লড়াই হয়েছে। ১১৭ এডিতে ইহুদিরা সালামিসে দুই লাখের বেশি গ্রিক সাইপ্রিওটদের হত্যা করেছিল। সাইপ্রাসের ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে বড় হত্যাকাণ্ড।
ইসরাইলের ওপর গ্রিক সাইপ্রাসের নির্ভরতা খুবই পরিষ্কার। ক্রিস্টোডুলাইডস ইসরাইলের নৃশংস নীতিকেও পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ইসরাইলের অস্ত্র কিনছে। ইসরাইলকে বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করতে দিচ্ছে। দক্ষিণের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় ইসরাইলের বসতি নির্মাণকেও তারা অগ্রাহ্য করছে।
এই নির্ভরতা আড়ালে রাখার শর্তে ইসরাইলও তাদের কিছু সাহায্য করছে। সেগুলো অনেকটা অবশ্যই কথার মধ্যেই সীমিত। যেমন গালের লেখায় ‘পোসেইডন’স র্যাথ’-এর প্রশংসা করা হয়েছে। গ্রিকদের সাগরবিষয়ক দেবতার নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। এভাবে ইসরাইল তাদের আগ্রাসী পদক্ষেপ আড়াল করছে। ফিলিস্তিনে গণহত্যাকে আড়াল করছে। নেতানিয়াহু শুধু এই অঞ্চলকে নয়, বরং সারা বিশ্বকে যে হুমকি দিচ্ছেন, সেটাকেও এর আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি সাইপ্রিওটদের ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করা যাবে। তাদের ধারণা ভুল। তুর্কি সাইপ্রিওটরা একা নন, তারা শক্তিশালী। তারা তাদের অধিকার আর রাষ্ট্রকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্ষা করবে। টিআরএনসি মন্টিভিডিও কনভেনশনের সব নিয়ম মেনে চলছে। এটাই ঠিক করেছে রাষ্ট্র কেমন হবে। আন্তর্জাতিক নিয়মের সবচেয়ে বড় দিকনির্দেশনাও এই ঘোষণা থেকে এসেছে।
টিআরএনসি পুরোপুরি গণতান্ত্রিক ও নিরাপদ। দ্বীপের সবচেয়ে বড় ও ভালো বিমানবন্দর রয়েছে তাদের। চারটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে সেখানে, যেগুলো বিশ্বের শীর্ষ এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। অরগানাইজেশন অব টার্কিক স্টেটসের মতো গ্রুপগুলো সেখানে কাজ করছে। ইকোনমিক কোঅপারেশন অরগানাইজেশন এবং অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি) সঙ্গে মিলে তারা কাজ করছে। তাদের পূর্ণ স্বীকৃতি শিগগিরই আসছে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। শিগগিরই দ্বীপের সত্যিকারের তথ্যগুলোই জয়ী হবে। এটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হবে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনটা দ্রুত হওয়া দরকার।