কয়েক দিন আগে জাপানে এক প্রবাসী বাংলাদেশি তরুণ মারা যান অনাহারে। জার্মানিতে আরেকজন আত্মহত্যা করলেন। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে জার্মানিতে বাংলাদেশি তিনটি প্রাণ ঝরে গেল অকালে। প্রশ্ন জাগে—আমরা কি আসলেই জানি, এই তথাকথিত উন্নত জীবনের বাস্তবতা কতটা কঠিন হতে পারে?

জার্মানি বহু শিক্ষার্থী ও তরুণের কাছে একটি সোনার হরিণ। বিনা টিউশন ফিতে উচ্চশিক্ষা, ইউরোপে পা রাখার সুযোগ এবং ভবিষ্যতে বসবাস ও চাকরির স্বপ্ন—সব মিলিয়ে এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু এই স্বপ্নের পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্যগুলো প্রায়ই অজানা অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষিত। যারা জানেন, তারা চুপ থাকেন অপবাদ বা কটাক্ষের ভয়ে। আর যারা বলার চেষ্টা করেন, তাদের ‘নেগেটিভ মাইন্ডসেট’-এর তকমা দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।

এর চেয়েও দুঃখজনক হলো—প্রবাসজীবনের চমকপ্রদ এবং অনেক সময় ভিত্তিহীন সুন্দর চিত্র তুলে ধরা ইউটিউবার বা ভ্লগারদের কথাই বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। জার্মানি তথা প্রবাসে এসে শিক্ষার্থীরা যে ধাক্কাগুলো খায়, তা নির্মম এবং বেদনাদায়ক। ভাষার উচ্চমান, কঠিন কারিকুলাম, সীমিত চাকরির সুযোগ, সামাজিক বৈষম্য, রেসিজম—সব মিলিয়ে এক কঠিন মানসিক যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় প্রবাসী তরুণদের।

অনেকেই মাস্টার্স শেষ করতে গিয়ে তিন-চার বছর সময় নেন আর সেই দেরির কারণে পড়তে হয় ফরেন অফিস বা ভিসা অফিসের হেনস্তার মুখে। কেউ হয়তো শুধু একটি ব্লকের টাকা বা আর্থিক অক্ষমতার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা হারাতে বসেন, কেউ আবার ভাষাগত দুর্বলতার কারণে চাকরি না পেয়ে দেশে ফেরার দুঃসংবাদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন পরিবারের সামনে—মুখ দেখানোরও শক্তি হারিয়ে।

বিশেষ করে নন-ইংলিশ স্পিকিং দেশে এই ভাষাগত বাধা প্রবল। উদাহরণস্বরূপ, কয়েক বছর আগেও জার্মানির আইটি সেক্টরে জার্মান ভাষা না জানলেও চাকরি পাওয়া সম্ভব ছিল। এখন সেই সেক্টরেও কমপক্ষে বি-টু লেভেলের ভাষাজ্ঞান চায় অধিকাংশ কোম্পানি। অথচ জার্মান নাগরিকত্বের জন্য আবশ্যক ভাষা দক্ষতা মাত্র বি ওয়ান!

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাও অনেক সময় বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমন অনেক কোর্স আছে, যেখানে অসংখ্য শিক্ষার্থী ফেল করেন—প্রফেসরের লেকচার বোঝা তো দূরের কথা, অনেক সময় তার পড়ানোর ধরনও বোধগম্য হয় না। ছয় বছরের বেশি সময় জার্মান একাডেমিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থেকে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে—এখানে নিয়মিত ক্লাস না করলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। প্রশ্ন এমনভাবে করা হয়, যেখানে মুখস্থ বিদ্যার চেয়ে বিশ্লেষণী জ্ঞানকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

এই বাস্তবতা তুলে ধরলে শুনতে হয়—‘তুমি পড়ালেখায় খারাপ, তাই এসব বলছ’, ‘তুমি দেশের বদনাম করছ’, বা ‘তুমি হতাশা ছড়াচ্ছ’। অথচ হতাশা ছড়ানো আর বাস্তবতা জানিয়ে সাবধান করা এক জিনিস নয়। এখনো সোশ্যাল মিডিয়ায় একদল মানুষ স্বপ্ন বিক্রি করে চলে : আইইএলটিএস দাও, বিদেশে যাও, জীবন বদলে ফেলো!’—এই চমকপ্রদ কথার আড়ালে থাকে বিপুল ঝুঁকি, মানসিক চাপ আর একাকিত্বের ঘন ছায়া।

প্রশ্ন হলো, আর কত প্রাণ ঝরে গেলে আমরা সতর্ক হব? আর কতজন হতাশায় ডুবে আত্মহননের কিনারায় গিয়ে পৌঁছালে আমরা বলব—‘থামো, আগে বাস্তবতা জানো?’

জার্মানিতে এসে কেউ কেউ ভালো অবস্থানে যেতে পারেন, এটি অস্বীকারের জায়গা নেই। কিন্তু সেটিকে ‘নিয়ম’ ধরে, অপরের দুর্ভোগকে ‘অযোগ্যতা’ বলে চালানো খুব বড় ভুল। কারণ সিস্টেমিক সমস্যা যেমন আছে, তেমনি প্রতিকূলতাও একেকজনের জন্য একেক ধরনের। যে শিক্ষার্থী ধার-দেনা করে প্রবাসে এসেছে, তার কাছে সেই দেনা শোধ করাটাই মুখ্য। আর যে ছেলেটা কঠিন পারিবারিক কাঠামো থেকে হঠাৎ বের হয়ে এসেছে, সে যদি নতুন জায়গা ঘুরে দেখা বা প্রবাসের নাইট লাইফে ডুবে যায়, তবে তার ভবিষ্যৎ ধ্বংস অনিবার্য। এখানে প্রতিটি বিষয়ে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত প্রয়োজন এবং কঠিন।

এই বাস্তবতায় দরকার ‘সস্তা মোটিভেশন’ বন্ধ করা। পরিবর্তে দরকার তথ্যভিত্তিক, পরিপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা। জার্মানিসহ যেকোনো নন-ইংলিশ স্পিকিং দেশে আসতে হলে সে দেশের ভাষায় দক্ষতা অর্জন আবশ্যক। মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে দীর্ঘ, কঠিন পথের জন্য। এই যাত্রা সহজ নয়, তবে সতর্কভাবে এগোলে সফলতা সম্ভব।

দেশের তরুণদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যদি তারা নিজ দেশেই নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে না পায়, তবে এর দায় শুধু প্রবাসীদের নয়, দেশের নীতিনির্ধারকদেরও। দেশের এমন এক ব্যবস্থাপনা তৈরি করা দরকার, যেখানে প্রবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি হবে পছন্দ, বাধ্যবাধকতা নয়।

পরিশেষে বলব—হ্যাঁ, জার্মানি তথা প্রবাসে ভালো করার সুযোগ আছে, তবে সে পথ কণ্টকময়। স্বপ্ন দেখুন, তবে চোখ বন্ধ করে নয়। উৎসাহ দিন, তবে সতর্কতা নিয়ে। আর সবচেয়ে জরুরি, হতাশ হয়ে পড়লে যেন পাশে একজন থাকে, যার সঙ্গে বলা যায় : ‘আমি আর পারছি না।’

জীবন হারানো নয়, তাকে রক্ষা করাই হোক আমাদের সবার দায়িত্ব।

লেখক : কৃষি গবেষক, ডিএএডি স্কলার, সাবেক রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইউনিভার্সিটি অব বন এবং ইউনিভার্সিটি অব গিসেন, জার্মানি

সূত্র, আমার দেশ