ইতিহাস এক অদ্ভুত চক্রের মতো। সময়ের পরিক্রমায় এর পুনরাবৃত্তি ঘটে, কখনো ভিন্ন আবরণে, কখনোবা একই রূপে। যখন কোনো জাতির জীবনে দ্রোহ আর বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে, তখন ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ অনেক মহানায়ক আর নন্দিত ব্যক্তিত্বের স্থান বদলে যায়।
যারা একসময় ছিলেন জাতির গর্ব, বিপ্লবের প্রতীক, তারাই নতুন প্রজন্মের কাছে হয়ে ওঠেন ঘৃণার পাত্র, নিপীড়নের প্রতিচ্ছবি। তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনাগুলো পরিণত হয় জনরোষের নিশানায় আর মূর্তিগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা হয়। এই ঘটনাপ্রবাহ শুধু একটি নির্দিষ্ট দেশের নয়, বরং বিশ্বজুড়েই এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। রুশ বিপ্লবের মহানায়ক লেনিন থেকে শুরু করে তুরস্কের জাতির পিতা কামাল পাশা, এমনকি বাংলাদেশের জাতির জনক খেতাবে ভূষিত শেখ মুজিব পর্যন্ত—অনেক আইকনিক ফিগারই সময়ের বিবর্তনে ভিন্ন প্রজন্মের কাছে ভিন্ন অর্থ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন।
সময়ের সঙ্গে বদলায় মন
রুশ বিপ্লবের কথা ধরা যাক। ভ্লাদিমির লেনিন, যিনি অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে জারতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিলেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, তিনি একসময় ছিলেন রাশিয়ার আপামর জনতার কাছে মুক্তির প্রতীক। তার মুখচ্ছবি ছিল প্রতিটি ঘরের দেয়ালে, তার নাম ছিল প্রতিটি শিশুর মুখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, বিশেষ করে ‘নব্বইয়ের দশকে, লেনিনের প্রতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক আমূল পরিবর্তন আসে। মুক্তিকামী নতুন প্রজন্ম তাকে আর শুধু বিপ্লবের নায়ক হিসেবে দেখেনি, বরং সোভিয়েত আমলের নিপীড়ন ও একনায়কতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করে। ফলে, রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে লেনিনের অসংখ্য মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়, তার স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই একই ঘটনা ঘটেছিল জোসেফ স্ট্যালিনের ক্ষেত্রেও, যিনি একসময় ছিলেন জাতীয় বীর হিসেবে নন্দিত। তার কঠোর শাসনের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়ন শিল্পোন্নত হলেও, তার পরিচালিত দমন-পীড়ন ও গ্রেট পার্জ-এর কারণে তিনি গণমানুষের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন।
তুরস্কের আধুনিক রূপকার মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, যাকে তুরস্কের জাতির পিতা হিসেবে গণ্য করা হতো, তিনিও একসময় ছিলেন দেশটির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতি একসময় তুরস্কের জনগণের অগাধ শ্রদ্ধা থাকলেও, বর্তমান সময়ে তুরস্কের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। যদিও তার মূর্তি বা স্মারকগুলোয় সরাসরি হামলার ঘটনা তুলনামূলকভাবে কম, তবে তার আদর্শিক ভিত্তির ওপর আঘাত হানার চেষ্টা চলছে।
এই প্রবণতা শুধু বিশ্বের ঐতিহ্যমণ্ডিত দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যখনই কোনো নতুন বিপ্লব বা ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের ঝড় উঠেছে, তখনই পূর্ববর্তী শাসনামলের আইকনদের প্রতি নতুন প্রজন্মের ঘৃণা ও অনাস্থা প্রকাশ পেয়েছে। এর পেছনের কারণগুলো জটিল এবং বহুস্তরীয়। প্রায়ই, নতুন প্রজন্ম যখন দেখে যে, তাদের পূর্ববর্তী নেতারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, স্বৈরাচারী শাসন চালিয়েছেন, অথবা নিজেদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, তখন তাদের প্রতি এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভ জন্মায়। এ ক্ষোভই পরে দ্রোহের আকার ধারণ করে এবং অতীতের সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার একটি প্রবণতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশেও একই ধরনের এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন দেখা গেছে। একসময় যাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক, জাতির জনক ও বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল সেই শেখ মুজিবুর রহমানও স্বর্গচ্যুত হয়ে ভূতলে পতিত হয়েছেন। তিনি দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি একসময় দেশের কোটি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেওয়া অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিলেন। তার ৭ মার্চের ভাষণ জাতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তিনি অনুপস্থিত থাকলেও তার নামেই স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হয়। কিন্তু ‘চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের’ পর তার প্রতি নতুন প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে এক নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।
‘চব্বিশের জুলাই বিপ্লব’ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই বিপ্লব দীর্ঘদিনের একটি ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছে, যা শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। এই শাসনকাল ছিল হত্যা, গুম, দুর্নীতি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনের এক নিকৃষ্ট উদাহরণ। এই শাসনব্যবস্থা এত দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল যে, একটি পুরো প্রজন্ম এই নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের অধীনেই বেড়ে উঠেছে। তারা দেখেছে কীভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভিন্নমত দমন করা হয়েছে, কীভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে এবং কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দেশ রসাতলে গেছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণদের ‘চব্বিশের জুলাই বিপ্লব রোধে আন্দোলনকারী যেখানেই পাওয়া যায়, সেখানেই তাদের গুলি করে মারার ব্যাপারে হাসিনার একটি স্বকণ্ঠ নির্দেশ প্রচার করেছে। তারা ফরেনসিক পরীক্ষায় দেখেছে, কণ্ঠটি হাসিনারই। নকল কিংবা এডিটেড নয়। ওই প্রতিবেদন দেখিয়েছে, পরাজিত হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিনেও একটি মাত্র স্পটে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে আধা ঘণ্টার মধ্যে ৫২ জন রাজপথের নিরস্ত্র সংগ্রামীকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। ফ্যাসিস্ট রেজিম এসব পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে প্রয়াত মুজিবের আদর্শ রক্ষার নাম করেই।
ফলে, যখন ‘চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে’ এই শাসনব্যবস্থার পতন ঘটে, তখন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও হতাশা একযোগে বিস্ফোরিত হয়। তাদের কাছে, শেখ মুজিবুর রহমান আর শুধু স্বাধীনতার আইকন হিসেবে থাকেননি, বরং তার কন্যা শেখ হাসিনার পরিচালিত ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রতীক এবং প্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে যুক্তি হলো, শেখ হাসিনা যে ধরনের স্বৈরাচারী শাসন চালিয়েছেন, তার ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেই। গণতন্ত্র হত্যা করে মুজিব-প্রবর্তিত একদলীয় শাসন, তার শাসনামলের দুর্ভিক্ষ এবং অন্যান্য বিতর্কিত পদক্ষেপ, ব্যর্থতা, হত্যা ও নিপীড়নের কারণে, তরুণ প্রজন্মের অনেকেই শেখ মুজিবকে তার কন্যার শাসনামলের সঙ্গে এক করে দেখতে শুরু করে।
এই পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবের প্রতিমূর্তি ভাঙা থেকে শুরু করে রাজধানীরতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত তার বাড়ি এবং অন্যান্য স্মৃতিস্তম্ভ ও ম্যুরালে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাগুলো শুধু ভাঙচুর ছিল না, বরং ছিল একটি গভীর প্রতীকী প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ ছিল বছরের পর বছর ধরে চাপা থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যেখানে নতুন প্রজন্ম অতীতের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছে এবং একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। তারা মনে করছে, তাদের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করতে হলে অতীতের সেই আইকনদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যারা কোনো না কোনোভাবে বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী।
বিপ্লব ও স্মৃতির পুনর্বিবেচনা
এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দেয়, ইতিহাস কখনো স্থির থাকে না। প্রতিটি প্রজন্ম তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইতিহাসকে নতুনভাবে মূল্যায়ন করে। যখন একটি নতুন বিপ্লব বা সামাজিক পরিবর্তন আসে, তখন অতীতের ‘মহানায়ক’ বা ‘জাতির পিতা’দের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন ওঠে। যারা একসময় ছিলেন অদম্য শক্তির প্রতীক, তারাই হয়ে ওঠেন বিতর্কের বিষয়। এই পরিবর্তনগুলো অস্থিরতা ও সংঘাতের জন্ম দিলেও, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্গঠনের একটি অপরিহার্য অংশ।
এই প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, কোনো নেতাই ইতিহাসের সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। এমনকি যারা একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তারাও যদি পরে এমন পথ অবলম্বন করেন, যা জনস্বার্থের পরিপন্থী, তাহলে তাদের স্থান ইতিহাসে ভিন্নভাবে নির্ধারিত হতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, শেখ মুজিবের প্রতি তরুণ প্রজন্মের এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যেখানে স্বাধীনতা ও স্বৈরাচারের সংজ্ঞায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে এবং অতীতের গৌরবময় অধ্যায়কেও নতুন করে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো আমাদের শিখিয়ে দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বৈরাচারী শাসন শেষ পর্যন্ত জনরোষের জন্ম দেয়। আর সেই জনরোষ যখন বিপ্লবের রূপ নেয়, তখন তা শুধু বর্তমান শাসনব্যবস্থার পতন ঘটায় না, বরং ইতিহাসের আইকনদের প্রতিও মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। এই পরিবর্তনগুলো বেদনাদায়ক হলেও, একটি জাতির অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। এটি নতুন প্রজন্মের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে, যেখানে তারা তাদের নিজস্ব ইতিহাস তৈরি করতে পারে এবং এমন একটি সমাজ গঠন করতে পারে, যা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক