দেড় হাজারের অধিক ছাত্র-জনতার জীবন এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতার পঙ্গুত্ববরণের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের নিরাপত্তা কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে? যে আধিপত্যবাদের ছায়ায় দানব হয়ে উঠেছিল হাসিনা ও আওয়ামী সরকার, সেই আধিপত্যবাদের নিপাত করতে আমরা কতটুকু সমর্থ হয়েছি, তার হিসাব এখনোই কষা দরকার। আধিপত্যবাদের সেই হুমকিগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আবার আমাদের বুকে চেপে বসতে পারে ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা। আরো একবার যদি আধিপত্যবাদীরা সুযোগ পায়, তখন আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হারানোর সমূহ-সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নিরাপত্তা বিষয়ে সার্বক্ষণিকভাবে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে সজাগ থাকতে হবে।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া পাক-ভারত এবং ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ দুটি আধুনিক বিশ্বের নিরাপত্তা এবং যুদ্ধের খোলনলচে বদলে দিয়েছে। সৈন্যে-সৈন্যে যুদ্ধের বদলে অস্ত্র-অস্ত্রের যুদ্ধের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। একজন সৈন্যও প্রবেশ না করিয়ে প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে ভয়াবহ আক্রমণ চালানো হয়েছে। টার্গেট করা দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য বা স্বার্থ চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যই হলো এই আধুনিক যুদ্ধের লক্ষ্য। আক্রমণ চালিয়ে শত্রুদেশের ভূমি বা অঞ্চল দখলের প্রয়োজন নেই। শুধু ভয় দেখিয়ে বা ধ্বংসযজ্ঞ চাপিয়ে দিয়েই বিজয় নিশ্চিত করার মিশন পরিচালনা করা হয়। সুতরাং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার ধারণা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমাদের তাই প্রতিরক্ষার জন্য নতুন ধারণা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাস্তবতায় আমাদের প্রতিরক্ষানীতি নতুন করে নকশা করতে হবে। ১৬ বছরে হাসিনা সরকারের ন্যায় আধিপত্যবাদের কাছে আমাদের আর আত্মসমর্পণ করা সম্ভব হবে না। কাজেই স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতির সম্মান নিশ্চিত করার জন্য আমাদের নিজস্ব কৌশল এবং সামর্থ্যকে সমৃদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই।

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিশ্বমঞ্চে দুর্বলের ওপর সবলের আক্রমণ শুরু হয়েছে। ভুয়া গোয়েন্দা তথ্য রচনা করে মিথ্যা বয়ান দিয়ে এই আক্রমণগুলো করা হয়েছে। আফগানিস্তান ও ইরাকে পশ্চিমা দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি দেখেছে বিশ্ব।

বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে ভারতের পাকা ধানে মই পড়েছে! হাসিনার পতনে এই দেশে ভারতের ভূরাজনৈতিক, কূটনৈতিক, আর্থবাণিজ্যিক ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই মারাত্মক বিপর্যয় ঘটেছে। ফলে ভারত কোনোভাবেই এই হাসিনার পতন হজম করতে পারছে না। তাই তারা হিন্দু নির্যাতনের মিথ্যা ন্যারেটিভ দিয়ে তাদের জাতীয়, প্রাইভেট, আন্তর্জাতিক এবং সামাজিক সব মিডিয়া সয়লাব করে দিয়েছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্লকেড সৃষ্টি করছে। সীমান্তে বিএসএফ অকাতরে বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করছে। কলকাতা এবং ত্রিপুরায় বাংলাদেশ মিশনে ভারতীয়রা আক্রমণ করেছে। ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলিম নাগরিককে বাংলাদেশি বলে পুশইন চালিয়ে যাচ্ছে। সব ধরনের কূটনীতি, আন্তর্জাতিক আইন, সভ্যতা, প্রথা, ঐতিহ্য—সবকিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ভারত বাংলাদেশবিরোধী অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।

ভারত দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আঞ্চলিক মিত্র। আমরা মুসলিম দেশ হওয়ায় ভারতের যেকোনো অন্যায় আধিপত্যবাদে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের সহমর্মিতা বা সহযোগিতা কতটুকু পাবে, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অথচ ভারত তার অন্যায্য আধিপত্যবাদ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অনন্ত প্রচেষ্টা চালিয়েই যাবে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব একটি নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে ভারতের কেউ কেউ আমাদের মানচিত্রের রংপুর বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিভাগের চিকেন নেক নিয়ে বিরূপ মন্তব্য ছুড়েছে। ফলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দরকার কৌশলগত এবং রণকৌশলগত নতুন পরিকল্পনা। তাদের ‘এয়ার সুপিরিয়রিটি’ বা আকাশ শ্রেষ্ঠত্বের বিপরীতে আমাদের নিরাপত্তা কৌশল কী হবে, সেটাই হবে আসল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

ভারতের সাম্প্রতিক আক্রমণকে পাকিস্তান শক্তিমত্তার সঙ্গে রুখে দিয়েছে। কারণ তারা পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং নিরাপত্তা কৌশল। পাকিস্তানের ‘সাইবার ওয়ার’ প্রস্তুতি ছিল অত্যন্ত নিখুঁত। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাদের জাতীয় ঐক্য এবং চীনের সঙ্গে কৌশলগত সামরিক বন্ধুত্ব।

অন্যদিকে ইসরাইলের প্রাথমিক আক্রমণে ইরান বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তাদের যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে এবং তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল গোয়েন্দা ক্ষেত্রে। ইসরাইলের মোসাদের গোয়েন্দা জাল পুরো ইরানব্যাপী বিস্তৃত ছিল অথচ ইরান এ বিষয়ে একেবারেই ঘুমিয়ে ছিল। ইরানের আরেকটি ব্যর্থতা ছিল তাদের অঞ্চলে কোনো বন্ধু গড়ে তুলতে না পারা। অবশ্য পরে দ্রুতই ইরান ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং ইসরাইলকে যথোপযুক্ত শিক্ষা দিতে পেরেছে। এমনকি ভয়াবহ মার্কিন আক্রমণেও টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে ইরান। এগুলো সম্ভব হয়েছে ইরানের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্ব, জাতীয় ঐক্য, ইরানি জনগণের সাহস। তা ছাড়া ইরানের কৌশলগত যুদ্ধাস্ত্রের প্রস্তুতিও ছিল চমৎকার!

আমাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা অত্যাধুনিক ‘এয়ার সুপিরিয়রিটি’ এবং ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ব্যবস্থা দ্রুত অর্জন করতে পারব না। কিন্তু আমাদের অন্যসব বিকল্প কৌশল এবং পরিকল্পনা গ্রহণ করা অসম্ভব হবে না। প্রথমত. থাকতে হবে ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য, যা আমরা ফ্যাসিস্টকে পরাজিত করতে রচনা করেছিলাম। দ্বিতীয়ত. আমাদের বিকল্প প্রতিরক্ষা কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। আর ভূরাজনৈতিক কৌশলের কাঠামোতে সামরিক কৌশল এবং রণকৌশলকে সাজাতে হবে। অর্থাৎ আমাদের আঞ্চলিক শুভাকাঙ্ক্ষীদের বন্ধুত্বের বন্ধনে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সাজাতে হবে।

আমাদের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকির সমুদয় প্রস্তুতিই সম্পন্ন করে রেখেছে আধিপত্যবাদীরা। ১৫ বছরে একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জন্য আমাদের দেশ ছিল সর্বৈব উন্মুক্ত! বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শিরা-উপশিরায় তারা পৌঁছে এখনো তারা রক্তপ্রবাহের মতো অপারেট করছে। আমাদের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদর দপ্তরেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশন সেল স্থাপন করা হয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছে। বিদেশিরা যে এখনো তৎপর রয়েছে, তার নিদর্শন স্পষ্ট বিভিন্নভাবে। ইসরাইল ১৩ জুন প্রথম রাতের বিমান হামলার পাশাপাশি তাদের গোয়েন্দারা ইরানে প্রথমসারির ১০ জন জেনারেল এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল। যে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইরানের দীর্ঘদিন লাগবে। কাজেই আমাদের বর্তমান গোয়েন্দা হুমকিই সবচেয়ে মারাত্মক রূপ ধারণ করতে পারে।

একই সঙ্গে বর্তমানে আমাদের বিরাজমান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী ট্রমা থেকে এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেরিয়ে আসতে পারেনি। রাষ্ট্রের নেতৃত্বে রয়েছে সীমাহীন দুর্বলতা। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে দু-একজন মাত্র নেতৃত্বে গতিশীলতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন! আবার অভ্যুত্থানকালীন ঐক্যে ধরেছে শত ফাটল। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিভক্ত বিভিন্ন ইস্যুতে। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভঙ্গুর পর্যায়ে রয়েছে। থানা-পুলিশ এখনো তাকিয়ে থাকে সম্ভাব্য ক্ষমতাসীন নেতাদের দিকে। আমলারা কাজে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে; কারা সামনে ক্ষমতায় আসছে সেটি বিবেচনা করতে গিয়ে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়ে গেছে ফ্যাসিবাদের দোসররা। এমন পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার জন্য আমাদের পুলিশে অবশ্যই পুনর্গঠন দরকার। একই সঙ্গে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পুনর্গঠন অত্যন্ত জরুরি। এগুলো অবিলম্বে ভারতীয় সংস্থার প্রভাবমুক্ত করার পরিশুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। ভিনদেশি এজেন্টরা একবার ঢুকে পড়লে শিরা-উপশিরায় রক্তের মতো প্রবাহিত হতে থাকে টার্গেট করা সংস্থাগুলোয়। কাজেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সংস্থাগুলো বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালিত করতে হবে।

লেখক : নিরাপত্তাবিশ্লেষক

সূত্র, আমার দেশ