বিশ্ব এই সাজানো চিত্রনাট্য আগেও দেখেছে। এখানে অস্তিত্বের ওপর হুমকি তৈরি হচ্ছে—এ রকম একটা বয়ান তৈরি করা হয়। সংবাদমাধ্যমগুলো সম্মিলিতভাবে এটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না। রাজনীতিবিদেরা রণবাদ্য বাজায়, নিরাপত্তার কথা বলে আগ্রাসনের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়।

আগেরবার ছিল ইরাক। আর এবারে ইরান।

কিন্তু দৃশ্যপটে স্পষ্ট করে ভেসে থাকা একটা জ্বাজল্যমান সত্য সবাই দেখেও দেখছে না। ইসরায়েলের কাছে পারমানবিক অস্ত্র আছে, অথচ কেউ তাদের জবাবদিহি করছে না।

এবার আসুন বাস্তবতাগুলো স্পষ্ট করে বলা যাক—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্যরাষ্ট্র। তারা আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) অনুমতি দিয়েছে। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সব সময় নজরদারির মধ্যে থাকে। শুধু সম্ভাব্য পারমাণবিক সক্ষমতার অভিযোগেই ইরানের ওপর বিধ্বংসী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

অন্যদিকে ইসরায়েল এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি। ইসরায়েল কখনো আইএইএকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি। এটা ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, ইসরায়েলের কাছে প্রায় ৯০টি পারমাণবিক ওয়্যারহেড রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর দেশ ইসরায়েল। দীঘদিন ধরেই তারা বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রাণঘাতী কৌশল অবলম্বন করে আসছে। তারা ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে আসছে।

বিস্ময়কর ভণ্ডামি

এই মুহূর্তে ইসরায়েলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তদন্ত চলছে। এটা কোনো তত্ত্ব কিংবা জল্পনা নয়, এখনো সেটা চলমান।

গাজা এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। শিশুদের দেহ খণ্ডবিখণ্ড হচ্ছে। গোটা পরিবার ধরে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। গোটা পাড়া পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর এসব ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞের জন্য যে রাষ্ট্র দায়ী, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত সেই রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রকে নজরদারির মধ্যে আনার দাবি জানাচ্ছে।

এ ঘটনা আমাদের সেই তথাকথিত ‘নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা’ সম্পর্কে কী ধারণা দেয়?

এটি আমাদের বলে, নিয়মকানুন শুধু দুর্বলদের জন্য প্রযোজ্য। এটি আমাদের বলে, কিছুর রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের বাইরে যেকোনো কিছু করতে পারে। এ কাজে সেই রাষ্ট্রগুলো ভূরাজনৈতিক জোটের প্রশ্রয় পায়, তাদের মদদদাতারা নীরব থাকে।

এটি আরও বলে, যেসব সংবাদমাধ্যমে ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান একসময় দাবি করেছিল, ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে (যা পরে চরমভাবে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল), সেসব সংবাদমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান এখনো সবচেয়ে অনিবার্য প্রশ্নগুলো তুলতে ব্যর্থতা দেখাচ্ছে।

ইসরায়েল যদি এভাবে তাদের সহিংসতা ও পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের জন্য প্রশ্নহীন সমর্থন পেতেই থাকে, তাহলে এনপিটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। আইএইএ নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর ভবিষ্যতে তারা যে ‘রেড লাইন’ বা বিপদের সীমারেখা টেনে দেবে, সেটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।

ইরানের ক্ষেত্রে বা অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়, সেটা কেন ইসরায়েলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় না?

একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারাধীন। কেন সেই দেশ জরুরি বৈশ্বিক উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু নয়?

ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার আছে, সেটা আতঙ্কের বিষয় নয়, অথচ ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে—এমনটা কল্পনা করে আমরা কেন আতঙ্কিত হচ্ছি?

এই দ্বিচারিতা বিস্ময়কর। বাকি বিশ্বের মানুষেরা এটা ভালো করেই বুঝে ফেলেছে।

ইরাকের চিত্রনাট্য

বৈশ্বিক দক্ষিণ এই ভণ্ডামি দেখছে। মুসলিমরাও এটা দেখছে। আর ফিলিস্তিনের জনগণ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি প্রতিদিন ভোগ করছে।

পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকেরা তাদের নেতাদের এই দ্বিচারিতা সম্পর্কে ক্রমেই সচেতন হয়ে উঠছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের নৈতিক কর্তৃত্ব ক্রমে ধ্বংস হচ্ছে।

এটি ইরানের পক্ষে দাঁড়ানোর বিষয় নয়। এটি আন্তর্জাতিক নিয়মকানুনের ধারাবাহিক ও বিপজ্জনক অবক্ষয়ের বিষয়।

যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সত্যিই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে সব পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে; বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্রের কোনো স্বচ্ছতা নেই, যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত এবং আঞ্চলিক অস্থিরতা উসকে দেয়।

ইসরায়েল যদি এভাবে তাদের সহিংসতা ও পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের জন্য প্রশ্নহীন সমর্থন পেতেই থাকে, তাহলে এনপিটি অর্থহীন হয়ে পড়বে। আইএইএ নখদন্তহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আর ভবিষ্যতে তারা যে ‘রেড লাইন’ বা বিপদের সীমারেখা টেনে দেবে, সেটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই হবে না।

বিশ্বের যেকোনো নৈতিকতাবোধসম্পন মানুষ স্পষ্টভাবে বলতেই পারে, ইসরায়েলকে শুধু গাজা ও পশ্চিম তীরে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য নয়, তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডারের জন্যও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

মিথ্যা অজুহাত কারও ক্ষেত্রে নিয়মের দোহাই, আর কারও ক্ষেত্রে দায়মুক্তি—এই পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান থেকে বিশ্বকে আরেকটি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া আমরা সহ্য করতে পারি না।

ইরাকে ব্যবহার করা সেই পুরোনো চিত্রনাট্য বহু আগেই বাতিল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি যদি আবার ফিরিয়ে আনা হয়, তবে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধও গড়ে তুলতে হবে।

এই দ্বিচারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কোনো চরমপন্থা নয়; বরং এটি উপেক্ষা করাটাই সাধারণ নিয়মে পরিণত করা ঠিক নয়।

উমর সোলায়মান ইয়াকিন ইনস্টিটিউট ফর ইসলামিক রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি

সূত্র, প্রথম আলো