আটা-ময়দা, সুজি কিংবা কখনো চিনি-লবণ দিয়াও ঔষধ বানানো যায়! যায় বটে। সেই যে গল্পের জামাল বলিয়াছিল কামালকে, জানিস! আমার মামা ১০ তলা দালানের উপর হইতে লাফ দিতে পারে! শুনিয়া কামাল বলিয়াছিল, লাফ দিয়াছিল! তাহার পর কী হইল? জামাল বলিল, কী আর হইবে, মামা মারা গেল।
তেমনি আটা-ময়দা-সুজি-চিনি-লবণ দিয়া জীবনরক্ষাকারী ঔষধ কেহ কেহ তৈরি করে বটে, তবে তাহা জীবন রক্ষা না করিয়া হরণ করে। বলা যায়, বাংলাদেশে ভেজাল ও নকল ঔষধের বিস্তার আজ জনস্বাস্থ্যের এক ভয়ংকর সংকটরূপে দেখা দিয়াছে। সম্প্রতি বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক বিশদ প্রতিবেদন মারফত জানা গিয়াছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে ঔষধ বাজারে নকল ও ভেজালের পুনরুত্থান ঘটিয়াছে। প্রকৃত অর্থে, দেশের শহর হইতে গ্রাম-প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ভেজাল ঔষধের সহজলভ্যতা প্রমাণ করে যে, এই সমস্যা এখন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নহে, বরং এক গভীর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। চিকিৎসকগণ পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে আসল ও নকল ঔষধ পার্থক্য করিতে পারিতেছেন না। 'অ্যালবুমিন ইনজেকশন'সহ একাধিক জীবনরক্ষাকারী ঔষধ নকল হইয়া থাকায় রোগীর প্রাণহানি ঘটিতেছে, কিংবা হইতে পারে। বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন, গ্যাস্ট্রিক ও অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ঔষধের মধ্যে নকল ও নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করা হইতেছে। আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচারে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় বিক্রীত ঔষধের ১০ শতাংশ এবং ঢাকার বাহিরের ঔষধের প্রায় ২০ শতাংশ নকল বা ভেজাল।
এতদ্ব্যতীত, নকল ঔষধ উৎপাদন ও বিপণনের পেছনে যে একটি সুসংগঠিত অপরাধ চক্র সক্রিয় রহিয়াছে, তাহা উল্লিখিত প্রতিবেদন হইতেই স্পষ্ট। কেরানীগঞ্জ ও কামরাঙ্গীরচরের মতো এলাকাগুলিতে গোপনে কারখানা পরিচালিত হইতেছে বলিয়া ব্যবসায়ীরা জানান। এমনকি অনলাইন ও কুরিয়ারের মাধ্যমে এই সকল প্রাণঘাতী পণ্য ছড়াইয়া পড়িতেছে সমগ্র দেশে। পুলিশ ও প্রশাসনের ঘাটতি, বিশেষত জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হইয়াছে।
ভেজাল ঔষধের এমন সমস্যা বিশ্বের নানান দেশে নানান সময় ঘটিয়াছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৩৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'এলিক্সির সলফানিলামাইড' নামক এক ঔষধে টক্সিক সলভেন্ট মিশানোর ফলে শতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। নাইজেরিয়ায় ২০০৮ সালে শিশুদের জন্য প্রাপ্ত কাশির সিরাপে 'ডায়েথিলিন গ্লাইকল' নামক বিষাক্ত উপাদান মিশানো হয়, ফলে ৮৪ জন শিশু মারা যায়। ভারতে, পাকিস্তানে, এমনকি ২০২২ সালে গাম্বিয়াতেও কিডনি-বিধ্বংসী কাশির সিরাপে বহু শিশুর মৃত্যু হয়। ভেজাল ঔষধের সমস্যা বিশ্বের নানান দেশে দেখা গেলেও পার্থক্য শুধু এইখানে যে, উন্নত দেশে একবারের ঘটনার পর রাষ্ট্র কঠোর হইয়া উঠে, আর আমাদের দেশের অবস্থা হয়-হায়রে কপাল মন্দ, চোখ থাকিতেও অন্ধ। আমরা যেন দেখিয়াও দেখি না। বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত ২০২৩ সালের আইন অনুসারে ভেজাল ঔষধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রহিয়াছে। তবে বাস্তবে কাহাকেও সেই দণ্ড দেওয়া হয় নাই। অপরদিকে, অশিক্ষিত, দারিদ্র্যপীড়িত জনগণ ২০ টাকার ঔষধ আট টাকায় পাইয়া 'খুশি' হয়। যদিও সেই খুশি কপূরের মতো মিলাইয়া যাইতে সময় লাগে না। যাহারা আরোগ্যের আশায় ঔষধ ক্রয় করেন, তাহাদের অনেকেই জানেন না, ঔষধের ভিতর হয়তো প্লাজমার পরিবর্তে প্লাস্টার অব প্যারিস রহিয়াছে।
একটি রাষ্ট্রের ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব হইল, নাগরিক যেন চিকিৎসা করাইয়া আরও অধিক অসুস্থ না হন; কিন্তু আমরা যেন পিছনের দিকে হাঁটিতেছি। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যেইখানে মানুষ মঙ্গলে যাইবার প্রস্তুতি লইতেছে, হরদম চাঁদে রকেট পাঠাইতেছে, সেইখানে আমরা আটকাইয়া রহিয়াছি আটা-ময়দার বড়ির মধ্যে! ইহা এক নিদারুণ প্রহসন এবং এই প্রহসনের করুণ শিকার হইতেছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।