২০২৫-২৬ বাজেট বর্ষের বাজেট প্রস্তাব পেশকালে রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনার প্রসঙ্গটি উঠে আসবে, প্রসঙ্গটির প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা নিয়ে ইদানীং বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এটি একটি ভালো লক্ষণ যে, রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবং মূসক ও আমদানি শুল্কের অগ্রগতির তুলনায় প্রত্যক্ষ কর আয়কর আয়ের প্রবৃদ্ধির মাত্রা কেমন যেন ধীর, মিশ্র ও নৈরাশ্যজনক, অথচ অর্থনীতির সার্বিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনুযায়ী ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করের মুখ্য ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা।
পর্যালোচনায় দেখা যায়- ক্রমশ কোম্পানি ও কোম্পানি ব্যতীত কর আয়ের অনুপাত ৭০:৩০ থেকে ৫৫:৪৫-এ পৌঁছেছে। দেশে করপোরেট ব্যবসায়-বাণিজ্য বাড়লেও কোম্পানি প্রদত্ত আয়করের প্রবৃদ্ধি সেভাবে বা সেহারে বাড়েনি বা বাড়ছে না। অন্যদিকে কোম্পানি ব্যতীত করদাতার মধ্যে ব্যক্তি করদাতা, পার্টনারশিপ ফার্ম, অ্যাসোসিয়েশন অব পারসন, আর্টিফিশিয়াল জুরিডিক্যাল পারসনস রয়েছেন- তাদের করনেটের আওতায় আনার উদ্যোগ আরো জোরদার অবকাশ থাকলেও তা ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে বলে প্রতীয়মান।
ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা (টিআইএনধারীর হিসাব অনুযায়ী) নিকট অতীতেও যথাযথভাবে শুমার ও সংরক্ষণ করা না হলেও যখন থেকে এসবের অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচিত হচ্ছে তখন থেকে অগ্রগতির ধারা বেগবান করার প্রয়াস চললেও যারা আয়কর নথি খুলেছেন তাদের ২৫-৩০ শতাংশ করদাতা নিয়মিত কর দিচ্ছেন, বাকিদের উপযুক্ত অনুসরণের উদ্যোগ জোরদারের আবশ্যকতা রয়েছে। আয়কর বিভাগের লোকবল বাড়ানো ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি বিদ্যমান লোকবল ও কাঠামোকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো এবং দেশিক দায়িত্বশীলতার সাথে প্রত্যক্ষ কর প্রশাসন-ব্যবস্থাপনা প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। ধার্য ও আদায়কৃত আয়কর যথাসময়ে ও প্রকৃত পরিমাণে কোষাগারে আসার ব্যাপারে নজরদারি ও পরিবীক্ষণ যেমন জরুরি তেমনি করারোপ, হিসাবায়ন ও জমাদান পদ্ধতি প্রক্রিয়াকে যতটা সম্ভব করদাতাবান্ধব বা সহজীকরণ করা যাবে; তত দূরত্ব কমবে করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যে। আর এভাবে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হলে করনেটের সম্প্রসারণ ঘটতে থাকবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সার্বিক রাজস্ব আয়ের পরিবারে প্রত্যক্ষ করকে মোড়লের ভূমিকায় আসার যথেষ্ট অবকাশ ও সুযোগ রয়েছে।
গতবারের বাজেট বক্তৃতার ২৪৪ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছিল- বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশটি নতুন মলাটে আইন হিসেবে প্রণয়ন করা হয়েছে। আয়কর আইনের সংস্কারের এ আয়োজন উদ্যোগ সহসা সচকিত নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছিল পরিকল্পনা আর প্রাজ্ঞ পরামর্শকদের প্রয়াস পারঙ্গমতা। রাজস্ব আইন সংস্কারের সব উদ্যোগের আগ্রহ অভিপ্রায়ে কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু বিদ্যমান আইনে ‘শতেক শতাব্দী ধরে নামা শিরে অসম্মানভারের’ লাঘব প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটেনি, সংস্কার করা আইন কতটা বাস্তবায়নসম্মত, আয়কর আহরণকারী এবং দাতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও বাধ্যবাধকতার প্রয়োজনীয়তা সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে কি না সেটি দেখা দরকার হয়ে পড়েছে।
কেননা, গত বছর মন্ত্রিপরিষদ সভায় নতুন আয়কর আইন-২০২৩ এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের সময় মন্ত্রিপরিষদ থেকে যা জানানো হয়েছিল, ‘এই আইনের ফলে আয়কর নির্ধারণে কর্মকর্তার ক্ষমতা কিছুটা কমানো হয়েছে। সেই সাথে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন প্রদান আরো সহজ করা হবে। ব্যবসায়ীদের আয়কর নির্ধারণে আগে ২৯টি বিষয় মানদণ্ড ছিল। এখন তা কমিয়ে ১২টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। মানুষ যাতে ট্যাক্স দিতে উৎসাহিত হয় এবং ট্যাক্সের পরিধি যাতে বাড়ে সেজন্য এই আইনটি করা হয়েছে উল্লেখ করে আরো বলা হয়, করদাতার করের পরিমাণ আয়কর কর্মকর্তার নির্ধারণ করে দেয়ার ক্ষমতা থাকছে না এ আইনে। করদাতার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কর নির্ধারিত হবে। ফলে কর্মকর্তার চাপিয়ে দেয়া করের পরিমাণ ঠিক করার ফলে আপিলের পরিমাণ কমবে, কমবে করদাতার হয়রানি।’ এখানে প্রশ্ন রয়ে গিয়েছিল যে, আইনটি সংসদে বিশেষ করে সংসদীয় কমিটিতে পরীক্ষা পর্যালোচনা করে গৃহীত হয়নি। খসড়া আয়কর আইনে আরো অনেক অভিনবত্ব ছিল। কিন্তু আরো করদাতাবান্ধব করার বিষয়টি সামনে আনার মাধ্যমে আইন প্রণয়নকারীরা আইনটিকে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপে মন দিয়ে ছিলেন তা বোঝা যায়। নির্বাচনী বাজেটবর্ষে সংসদে কণ্ঠভোটে আয়কর আইন পাস এবং জাতিকে উপহার দেয়ার উপায়-উপলক্ষ নির্মাণে যেন সময়সীমা সেভাবে সাজানো হয়েছিল বহু বছর ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টি।
রাজস্ব আহরণের অন্যতম আইন, প্রত্যক্ষ করের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহনকারী আয়কর আইনটির প্রয়োগ পদ্ধতিটি যতটা যুক্তিযুক্ত ও জটিলতামুক্তকরণ সম্ভব, সে দাবি ও প্রত্যাশা থেকে দৃষ্টি সরানোর সুযোগ না থাকা ভালো ছিল। লক্ষণীয় হলো আইনটির মুসাবিদা হয়েছে যারা এটি বাস্তবে প্রয়োগ করবেন তাদের হেঁসেলে। যাদের জন্য এ আইন, যারা এর দ্বারা রাষ্ট্রকে কর প্রদানে প্রণোদিত হবেন, দায়িত্বশীল হবেন তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কতটা এখানে প্রশমিত হবে সেটি দেখতে তাদের সাথে আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময়, সুপারিশ-পরামর্শ পর্যালোচনার সুযোগ সীমিত করে বা রেখে আইনটি জাতীয় সংসদে তড়িঘড়ি পাস করানো হয়। আইনটির কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে সব কিছু দেখা দরকার ছিল। এটি যেন ২০১২ সালের নতুন ভ্যাট আইনের মতো জন্মিয়াই প্রবর্তনে বিলম্ব ও ব্যাপক পরিবর্তনের অথবা আজীবন নিবর্তন কিংবা পারস্পরিক দোষারোপের খোটা খাওয়ার ভাগ্য বরণ করবে না।
২০১২ সালে মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন পাসের প্রেক্ষাপট এবং এর প্রয়োগ প্রবর্তনে প্রায় দুই হালি বছরের টানাটানির অভিজ্ঞতা থেকে প্রসঙ্গটি স্পষ্টীকরণের অবকাশ তৈরি হয়েছে। স্মর্তব্য যে, ২০১২ সালে আইএমএফের ‘ইসিএফ এর কিস্তি পাওয়ার ট্রিগার বা শর্ত পালনের প্রেক্ষাপটে বিদেশের বেস্ট প্রাক্টিস আমদানি করে প্রণীত মূসক আইনের খসড়া স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলাপ-আলোচনা মতবিনিময় করে সংসদে পাস করা হয়েছিল, সংসদে তখনো প্রায় ৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী বা মূসকের স্টেকহোল্ডার ছিলেন, তারা এটি পাস করেছিলেন, আইনটি পাস হওয়ার পরপর স্টেকহোল্ডাররা এটি প্রবর্তনে দ্বিমত প্রকাশ করায় বারবার পিছিয়ে যায় এর প্রবর্তন। সুতরাং ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ পরিস্থিতির উদ্ভব আয়কর আইনের ক্ষেত্রে যাতে না হয় তা যথা বিবেচনায় আনা বা রাখার দায়িত্ব আমজনতা করদাতাদের পক্ষে তাদের প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে আইন প্রণেতাদের। নির্বাহী বিভাগের মুসাবিদা করা আয়কর আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করা আইন হতে হলে জনমত যাচাইয়ের সুযোগ কাজে লাগানো এবং নির্বাহী-নিরপেক্ষ যাচাই-বাছাইয়ের অবশ্যই অবকাশ থেকে যাবে। এটি উপেক্ষা করে পাস করা আইন অতীতের বহু আইনের মতো অপ্রয়োগ যোগ্য কিংবা অপ-প্রয়োগের সুযোগ সন্ধানে বারবার সংশোধনের জিকির, ফন্দি ও দাবি উঠতে থাকবে।
মূসক আইনটি জন্মিয়াও জন্মলাভ করতে পারে নাই, প্রবর্তনের আগে সংশোধনের দাবি উঠেছিল। স্টেকহোল্ডাররা বলেছিলেন, আমাদের সাথে পর্যাপ্ত আলোচনা হয়নি, আমাদের সব অভিমত অনুরোধ পরামর্শ গ্রহণ করা হয়নি। এখনো বাজারে গুঞ্জন ছিল যে, আয়কর আইনের ওপর আলাপ-পরামর্শ সভা ছিল অতি নির্বাহী পরিবেষ্টিত পরিবেশে, সেখানে যেসব স্বাধীন অভিমত সুপারিশ উঠে এসেছিল, সেগুলোর সবটা খসড়ায় প্রতিফলিত হয়নি, এমনকি সেটি জানার সুযোগ অবারিত ছিল না। মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত খসড়া আইনটি সবার দৃষ্টিগোচর করা না হলে এটি সংসদে অনুমোদনের আগে গণঅবহিতির ক্ষেত্রে ‘গোপনীয়তা’র নীতি অবলম্বন করা হলে এর গ্রহণ ও প্রয়োগ যোগ্যতা নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়ে চলেছে।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে বিদ্যমান কাস্টমস ভ্যাট ও আয়কর আইনের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হলে দেখা যাবে- এসব আইন জন্মগতভাবে ব্রিটিশ, দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রয়োগিক দিক থেকে জটিল, নিবর্তন ও প্রতিরোধাত্মক। এদেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে চলে এলেও আধুনিক আয়কর প্রবর্তিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে।
আমরা জানি, এদেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। পরবর্তী ১০০ বছরে এদেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণ কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কোম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতে প্রথম ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-৬০) তার বাজেট বক্তৃতায় এদেশে প্রথম আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। আয়কর আইন প্রবর্তনের দু’মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে কলকাতাতে মারা যান উইলসন। প্রথম থেকে আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতাদের প্রতি বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকিজুকি প্রতিরোধাত্মক ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রাধান্য পায়। করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধি-বিধানের ভাষা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে ওঠে।
‘তোমার আয় হোক আর না হোক অর্থাৎ বাঁচো-মরো, রাজস্ব আমার চাই’ এ ধরনের আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে কর আদায়কারী বিভাগের সাথে করদাতাদের সম্পর্ক জবরদস্তিমূলক, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখী হয়ে পড়ে। পরস্পর অবিশ্বাসের ও প্রতিদ্ব›দ্বী পরিবেশে কর নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার এবং সে লক্ষ্যে অনৈতিক আঁতাতের মাধ্যম রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতিরও সূত্রপাত ঘটে। দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে আইনের মধ্যে যেন রয়ে যায় পরোক্ষ প্রেরণা বা সুযোগ। এমন অনেক আইন আছে যা বেআইনি আচরণকে উসকে দেয়।
সুষ্ঠু বাস্তবায়নের প্রশ্নে শুল্ক ভ্যাট ও আয়কর আইন হবে এদেশের আবহমান অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক, হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। তবেই বাড়বে এর গ্রহণ এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা। করদাতা যেন নিজে নিজের কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত করদাতারা যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে কর প্রদানে দায়িত্বশীল হতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয় কর আহরণে করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যেকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা করনেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এরূপ পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার মতো স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে। এ পরিস্থিতি থেকে জবাবদিহি, করনেয়া প্রতিষ্ঠা এবং ছোট-বড় নির্বিশেষে সব করদাতা যাতে সমান আচরণে নিষ্ঠাবান হন।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান
সূত্র, নয়া দিগন্ত