৩৬ জুলাই একটি প্রতীকী তারিখ। এ প্রতীকের গভীরতা অনেক। এটি সংরক্ষিত থাকবে ইতিহাসের পাতায়।

৩৬ জুলাই একটি প্রতীকী তারিখ। এ প্রতীকের গভীরতা অনেক। এটি সংরক্ষিত থাকবে ইতিহাসের পাতায়। ৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্ট সেই রক্তে লেখা ইতিহাস যা ভোলা যায় না। ১৭৫৭, ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ ইতিহাসের একেকটি অনন্য মাইলফলক। আমাদের সংস্কৃতির জনপ্রিয় প্রতীক হিসেবে উঠে আসে ৩৬ জুলাই যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টকে অলঙ্কৃত করে।

২০২৪ সালের ৫ জুন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন সরকারি চাকরিতে কোটা-ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দিলে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়। ১৬ জুলাই আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনাকে জুলাই গণহত্যা আখ্যা দিয়ে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত থাকে। আন্দোলনকারীরা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত জুলাই মাস গণনার ঘোষণা দেন। এভাবে তারা ১ আগস্ট তারিখটিকে ৩২ জুলাই হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। আন্দোলন নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ৪ আগস্ট (৩৫ জুলাই) থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৫ আগস্ট (৩৬ জুলাই ২০২৪) ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আন্দোলনের সফলতাকে আন্দোলনকারীরা দ্বিতীয় স্বাধীনতা এবং এই দিনটিকে ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে অভিহিত করেন।

শেখ হাসিনা প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে হত্যাকারীদের একত্রিত করে জনগণের বিরুদ্ধে জঘন্যভাবে ব্যবহার করেছেন। তার কোনো রেহাই নেই, না তার, না তার ঘনিষ্ঠ খুনে বাহিনীর। গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। বাকরুদ্ধ হয়ে যাই যখন দেখি, দুই-একটি দল আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার আছে বলে বক্তব্য দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ গত ৫৪ বছরে যা করেছে তার মধ্যেই আছে দলটি বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার রাখে কি না এমন প্রশ্নের যথার্থ উত্তর। বেগম খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে বের করে দেয়া হয় ন্যক্কারজনকভাবে। প্রচার করা হয়- ঘরে নাকি মদের বোতল পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে এমন অপমানজনক নাটক হয়েছিল সে দিন। বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে শেখ হাসিনা এমন কোনো অশ্রাব্য বাক্য নেই যা বলেননি। বেগম জিয়াকে পদ্মায় ‘টুপ’ করে ফেলে দেয়ারও হুমকি দেন।

৭৫ বছর বয়সের একজন রাজনৈতিক নেত্রী যিনি তখনো একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য! হ্যাঁ, এটি এ দেশেই সম্ভব হয়েছিল। নির্মম পরিহাসই বটে। তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে চাইলেও সুযোগ দেয়া হয়নি। আরো নিষ্ঠুরতার নমুনা আছে। বেগম জিয়ার এক ছেলে মারা গেলেন, আরেক ছেলে (তারেক রহমান) প্রায় ১৭ বছর ধরে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন লন্ডনে। শেখ হাসিনা প্রায়ই বলত- সাহস থাকলে দেশে আয়। এসব কথার জবাব দেয়ার মতো সাহস ও রুচি কারো ছিল না। কারণ শেখ হাসিনার নিজস্ব সৃষ্ট ভয়ের সংস্কৃতি। এসব ব্যাপারে বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান কিংবা রুমিন ফারহানার মুখে কোনো প্রতিবাদ ছিল না। আজ তারা নানা বিষয়ে বেজায় সোচ্চার, কিন্তু এসব প্রসঙ্গে কথা বলেন না। মানুষ কত দ্রুত ইতিহাস ভুলে যায়!

ভারতের আসক্তি এড়িয়ে যাওয়া বিএনপির জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এটি খুব সহজে সম্ভব হবে না। তবে এটি ঝেড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর ও চব্বিশের আস্থা অর্জন করতে হবে দলটিকে। বিএনপির ভেতরে অনেকে এমনভাবে কথা বলেন, তারা আওয়ামী লীগের না বিএনপির লোক- বোঝা যায় না। তাহলে কি জুলাই বিপ্লব ভুল ছিল। এই তরুণরা কি কেবল কারো মুখে স্লোগান তুলে দিতে জীবন দিয়েছে।

মাঝে মধ্যে আমাদের মনে হয়, এই দেশটায় শেখ হাসিনা আর আওয়ামী লীগই যদি কেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে অন্তত ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের মতো আরো কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হতো। বোঝা যেত কারা আদতে কোন পাড়ায় খেলা করে। ফজলুর রহমান বা রুমিন ফারহানার তো কোনো সমস্যা ছিল না তখন। আজ তারা তারেক রহমানের রাজনীতি শেষ করে দেয়ার কাজ করছে।

জুলাইয়ের ৩৬ দিন দেশে কিভাবে দানবীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তা মনে রাখা জরুরি। এক হাজার ৬০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা, ৪০০ ছাত্র-জনতার চোখ অন্ধ, ২৫ হাজার মানুষের আজীবন পঙ্গুত্ববরণ (আহত) ভুলে গেলে চলবে না। তার আগে পিলখানায় ৫৭ চৌকস সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে হত্যাকাণ্ড, বীভৎস বিশ্বজিৎ হত্যা, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা, বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নৃশংসভাবে হত্যা, মসজিদে ঢুকে মানুষ হত্যা, দেশকে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা, গুম, খুন এবং ২৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের অর্থ পাচার কী করে ভুলব!

আয়নাঘর, নারায়ণগঞ্জে নির্মমভাবে সাতজন খুন। সরকারি-বেসরকারি সব দফতরে গণহারে চরম দুর্নীতিই পরিণত হয় আইনসিদ্ধ নিয়মে, ব্যাংক লুট, সব মন্ত্রণালয় দলীয়করণ, একাধিক মিডিয়া যেমন- আমার দেশ, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি, পিস টিভি, চ্যানেল ওয়ান ইত্যাদি প্রচারমাধ্যম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, অবশিষ্ট গণমাধ্যম দলীয় মোড়কে আবদ্ধ করে সংবাদ প্রচার করা, এক কথায়- বাংলাদেশটাকে শেখ হাসিনার পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছিল। ভিন্নমত, ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন আদর্শ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে একটি ভয়ের সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল। ভারতে মুসলিম নিধনে শেখ হাসিনা কখনো প্রতিবাদ করেননি। এ ব্যাপারে মোদি সরকারকে সমর্থন দেয়া যেন একটি আদর্শিক আওয়ামী চেতনায় পরিণত হয়েছিল। একটি আশ্রিত রাজ্যের চরিত্র ধারণ করলে যা হয়, সে দিকেই ধাবিত হয়েছিল বাংলাদেশ।

১৬ বছরে নির্বাচনের ভাষা হলো- ১০টি হুন্ডা, ২০টি গুণ্ডা, ৪০টি ডাণ্ডা, নির্বাচন ঠাণ্ডা। কথায় কথায় হুঙ্কার। পদ্মাসেতু থেকে বেগম জিয়া ও ড. ইউনূসকে ‘টুপ’ করে ফেলে দিয়ে হত্যার হুমকি। এমন কোনো ঘৃণ্য কাজ নেই যা শেখ হাসিনা করেননি। তিক্ততায় বিষাক্ত অন্তর নিয়ে জনগণের টাকায় চষে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। যেখানেই গেছেন দেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করেছেন। কলকাতার বইমেলায় কপালে তিলক কেটে বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী বলে ঘোষণাকে অকাতরে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হাসিনার প্রতি উদারতা দেখিয়ে দেশে নিয়ে আসেন, বিনিময়ে তিনি শহীদ হন। দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করল জাতীয় পার্টি- বিনিময়ে জাতীয় পার্টি আজ বিলুপ্তির পথে। জামায়াতে ইসলামীও আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছে, ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পথ খুলে দিয়েছে- বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সেই জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে। চতুর্থবার ওয়ান-ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করেছিল সেনাবাহিনী- যার বিনিময়ে ৫৭ জন চৌকস সেনা অফিসারকে অকালে অপঘাতে জীবন দিতে হয়েছে। ভুলের খেসারত যে কত ভয়ানক হতে পারে, বাংলাদেশের ইতিহাস তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। তাই বলব, পঞ্চমবার কেউ যেন আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের হঠকারিতা না করেন। বিষয়টি সব রাজনৈতিক দলেরই গভীরভাবে উপলব্ধি করা জরুরি।

লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক

সূত্র, নয়া দিগন্ত