কয়েক বছর ধরে প্রায়ই শুনে আসছি, দেশের গণমাধ্যম ভালো অবস্থায় নেই, ভালো নেই সংবাদ কর্মীরা। এই আক্ষেপ করেন পরিস্থিতির শিকার সাংবাদিকরা এবং ন্যাকামির সুরে একই কথা বলেন গণমাধ্যমের অধঃপতনের সময়ে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরাও।

এ পরিস্থিতির জন্য কেউ না কেউ বা কিছু বিষয় তো নিশ্চয়ই দায়ী, কিন্তু নিজেদের বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুর দিকে আঙুল তোলাই হয় তাদের পক্ষে পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ কাজ। নব্বইয়ের দশক থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা গণমাধ্যম একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে যে রাজনৈতিক ও নৈতিক অধঃপতনের মুখোমুখি হবে, তা তরুণ বয়সে আমরা কল্পনা করতে পারিনি; কোনো কোনো মুরুব্বি হয়তো বাস্তবতা আগেভাগে বুঝে আত্মসমর্পণের মঞ্চের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাংবাদিকদের আড্ডায় রাজা-উজির মারা, বাঁচানো এবং ভাসানো-ডোবানোর বাইরেও নিজেদের পেশা ও শিল্পের করুণ দশা কেন হলো, সে প্রশ্ন করাটা আজ অযৌক্তিক কিছু নয়।

হেরে যাওয়া লোকেরা নিজেদের দায় চাপাতে পারেন অন্যত্র, সান্ত্বনাও পেতে পারেন তাতে। এই ধরুন ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অতি ব্যস্ত জীবনধারা—এসব কারণে অধিকাংশ মানুষ খবরের কাগজ পড়ে না এবং টেলিভিশন দেখে না। ঠিক, কিন্তু তার মানে দাঁড়ায় ছাপা কাগজ না পড়লেও এবং টেলিভিশন না দেখলেও তাদের চলে।

আবার অনেকে বিশেষ করে তরুণরা লিখিত খবর পড়া ও ছবিনির্ভর প্রতিবেদন দেখতে ডিজিটাল মাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাহলে কি খবরের চাহিদা আছে এখনো? সেই খবর যা ঘটেছে; অথবা সেই সত্য, যা আড়াল করা বা গোপন রাখা হয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে, তা-ই জানতে চায় মানুষ, তা জানার মাধ্যম যা-ই হোক।

অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হয়তো সেই খবর দিচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীন পরিসরে। সে তুলনায় প্রিন্ট শুধু ধীর গতিরই নয়, যুগের নতুন চাহিদা তৈরি ও প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতেও ব্যর্থ। কেউ অভিযোগ করতে পারেন, অনলাইনে পাঠক-দর্শকের মনোযোগ সময়কাল খুব অল্প। তবে সেখানেও জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি রয়েছে। সব ডটকমও যে এক নয়, সে মূল্যায়ন করা হয় প্রচলিত গণমাধ্যমের আদলেই।

বিশ্বের অন্যত্র যা-ই ঘটুক, আমাদের প্রেক্ষিতে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের ধস নামার জন্য দায়ী প্রধানত অন্য কিছু। কী জবাব দেবেন যদি একজন পাঠক বা দর্শক সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্ন করেন—‘নিকট অতীতে আপনারা কি মানুষের খবর সঠিকভাবে দিয়েছেন বা দিতে পেরেছেন, যাতে মানুষ পত্রিকা বা টেলিভিশনের খবরে আকৃষ্ট থাকবে এবং এর ওপর আস্থা রাখবে?’

মূলধারার গণমাধ্যম থেকে জনতা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং অবশ্যই ইন্টারনেটের কল্যাণে সরে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যেখানে আবার হরেক রকমের খবর ছাড়াও নিজের চেহারা দেখানো যায়, নিজস্ব কণ্ঠের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শোনা যায়। স্বৈরাচারী শাসনের নিয়ন্ত্রিত বা স্ব-নিয়ন্ত্রণ-আরোপিত মিডিয়া থেকে বাঁচতে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সেখানে। ব্রেকিং নিউজ নামক জিনিসটি পৃথিবী থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেছে সামাজিক নেটওয়ার্ক ও প্ল্যাটফর্মের গতি এবং সহজ প্রাপ্যতার কারণেই।

প্রযুক্তির প্রভাব মোকাবিলা বাদ দিন : সাংবাদিকতা চর্চা করতে গিয়ে সাধারণ জ্ঞান কতটা অনুসরণ করা হয়েছে আমাদের প্রেক্ষিতে, তা গবেষণার দাবি রাখে। বাংলাদেশের মানুষের চাহিদা, পছন্দ, সাংস্কৃতিক বোধ ও বিশ্বাস এবং এদেশে গণতন্ত্র বিকাশের নিমিত্তে আমরা সাংবাদিকতার নিজস্ব মানদণ্ড দাঁড় করাতে পারিনি এবং প্রতিবেদন, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য লেখা ও টিভি/ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরিতে আন্তর্জাতিক মান অর্জনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব একটা সচেষ্ট হইনি।

অস্বীকার করা যাবে না দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশে তথাকথিত গণমাধ্যম—আসলে ক্ষেত্রভেদে দালাল ও পণবন্দি মিডিয়া—পেশাদারত্বের ধারেকাছে থাকেনি। নিজেরা গণতন্ত্র হত্যায় স্বেচ্ছায় (ভলান্টিয়ারিং) শরিক হয়েছে এবং ফলে নিজেরাও আত্মহননের শিকার (ক্যাজুয়াল্টি) হয়েছে।

সত্যনিষ্ঠতা নিয়ে জনগণের সঙ্গে না থাকার প্রক্রিয়ায় এদেশের কথিত গণমাধ্যমের ষোলো কলা পূর্ণ হয়েছিল প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী এবং ঠিক পূর্ববর্তী এক-এগারো সরকারের শাসনামলে। জনগণের বিষয়ে জনগণের জন্য কারবার না করলে তা ‘গণমাধ্যম’ হয় বা থাকে কী করে, বোঝা মুশকিল।

আপনি সেবা করবেন দেশি-বিদেশি প্রভুদের এবং অবস্থান নেবেন মিথ্যা ও অন্যায়ের পক্ষে, কী আহ্লাদের কথা, জনগণ তাদের পকেটের পয়সা খরচ করে আপনার কাগজ কিনবে এবং মূল্যবান সময় ব্যয় করে আপনার বিরক্তিকর ইলেকট্রনিক বাক্স বা ডিজিটাল জানালার সামনে রাত জেগে বসে থাকবে!

মানুষ যে পত্রিকার গ্রাহক হয় না বা যে টেলিভিশনের খবর বিশ্বাস করে না, সেই ধরনের গণমাধ্যমের লাইসেন্স দেওয়া-নেওয়ার একটা হিড়িক পড়েছিল ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসনামলে এবং এগুলোর কর্ণধাররা মনে করেছিলেন, অর্থায়নকারীদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও নানা কারবারের পাহারাদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রভুদের রাজনৈতিক বয়ান ও জনমত ঠিক করার মালিক হবেন একমাত্র তারাই, যেন—‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’

পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরবারে কাকুতি-মিনতি করা একদল ভাঁড় ও তাদের অনুসারীরা এটাও আশা করেছিলেন, জনগণ তাদের মিডিয়ার কথাই চূড়ান্ত সত্য বলে ধরে নেবে কিয়ামত পর্যন্ত এবং সমাজ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের রাজস্ব দিয়ে ভরিয়ে দেবে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে খাতির নয়, বরং মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিজ্ঞাপনের স্রোত যে নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার জনপ্রিয়তা-দর্শকপ্রিয়তা, সেই ধারণা বদলে দিতে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। কিন্তু এর পরিণতি ছিল ভিন্ন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বিপ্লবের জোয়ারে সেসব মিডিয়া হাউস জনরোষের লক্ষ্যবস্তু হয় এবং অতি-চালাক মিডিয়া কান্ডারিরা নেত্রী হাসিনার পলায়নের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরপর পরিস্থিতির চাপ এবং কোনো কোনো অলিগার্ক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীদের স্বার্থ রক্ষায় কিছু আগাছা নিধন কর্মসূচি নেওয়া হলেও সাবেক আমলের মিডিয়ার চরিত্র ও সংস্কৃতিতে তেমন কোনো পরিবর্তনই আসেনি। ফ্যাসিবাদের সমালোচনা ও গণতন্ত্রের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করা বেশ কিছু সাংবাদিককে বছরের পর বছর বেকার বানিয়ে রাখা হয় এবং তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও দেখা যায়নি ফ্যাসিবাদমুক্ত সময়ে।

একটি বিপ্লবোত্তর পরিবেশে অতীত অন্যায় সংশোধনে প্রয়োজনীয় সরকারি হস্তক্ষেপের অভাব, মিডিয়া পুনর্গঠনে প্রায়োগিক উদ্যোগ নিতে অনীহা এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা কাগুজে রূপে রাখার প্রয়াসই গণমাধ্যমের চলমান স্থবিরতায় অবদান রেখেছে।

একই সঙ্গে মোটাদাগে মিডিয়া হাউসের আর্থিক স্বাস্থ্যের উন্নতি তো হয়ইনি, বরং নতুন অনিশ্চয়তা যুক্ত হয়েছে। এজন্য বিজ্ঞাপন বাজারের সংকট ও ব্যবসায়িক পরিবেশকে দোষ দেওয়া হলেও অধিকাংশ মিডিয়ার বর্তমান দুরবস্থার আসল কারণ তাদের গণবিচ্ছিন্নতা।

দেশের মূলধারার গণমাধ্যমের আনুমানিক ৭০ শতাংশ এখন মৃত্যু পথযাত্রী। এদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই এবং জনসমাজে এদের বাস্তবিকই কোনো প্রভাব তো দূরের কথা, প্রাসঙ্গিকতাও নেই।

জুলাই ’২৪-এর বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে খ্যাত গণমাধ্যম ঠিকঠাক করতে যে ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল, তা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং অংশীজনেরা। তার ওপর মিডিয়া সংস্কারের তোড়জোড় ভাটার দিকে থাকায় নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে স্লোগান শুনতাম—‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’ তার কারণ হয়তো এই যে, বিপ্লব আসলে ক্ষুদ্রজীবী, অথবা বর্গা দেওয়া হয়, অথবা বেহাত হয়ে যায়। উপরন্তু যে বিপ্লব বাংলাদেশের মিডিয়ার বড় অংশ সমর্থন ও ধারণ করেনি, তার সুবিধাভোগী কী করে হবে সেই একই গণমাধ্যম এবং এর কর্মীরা, যারা নিজেদের প্রমাণ করতে পারেনি স্বাধীনচেতা প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক হিসেবে?

সাধারণভাবে দলীয় পক্ষপাত দোষে অনেকটা দোষী এবং ফ্যাসিবাদী শাসনে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বনসাই হয়ে যাওয়া হাসিনার অনুসারী পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো বিপ্লবের আঘাতে কুপোকাত হয়েছে, কিন্তু আত্মসমালোচনা করে ও জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন যাত্রার পথ বেছে নেওয়ার মতো উদারতা ও দূরদর্শিতা দেখাতে পারেনি।

তাই এই মিডিয়া জনপ্রিয়তার বিচারে পতনশীল, আর্থিক সাফল্যের নিরিখে সংকোচনশীল (কন্ট্রাকশনারি) এবং নিজস্ব অস্তিত্বের বিবেচনায় ভেতর থেকে ক্ষয়ে ধসে পড়ার (ইমপ্লোশন) উপক্রম।

হাসিনার আমলে ধ্বংস হওয়া আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো অবস্থায় অনেক মিডিয়া হাউস এখনো টিকে আছে শিল্প সক্ষমতা দিয়ে নয়, ভিন্ন কোনো কারণে এবং অদূর ভবিষ্যতে এদের পতন জেনেও স্থিতাবস্থা টিকিয়ে রাখার একটা কায়েমি স্বার্থের প্রচেষ্টা আছে। এগুলোর অবলুপ্তি এতটাই অনিবার্য যে, গণমাধ্যমের চলমান অবস্থাও যেন প্রকৃত নয়, এক ভৌতিক বাস্তবতা। সাংবাদিকতার সংস্কৃতি, শিল্পের অবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি এবং সুস্থ নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও প্রতিষ্ঠান তৈরির ঐতিহাসিক সুযোগ এরই মধ্যে হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

তবে কি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা ও শিল্প এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কোনো ভবিষ্যৎ নেই? নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেটা ফ্যাসিবাদী যুগের তাঁবেদার মিডিয়া নয়, হতে হবে নতুন কিছু। বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে আমরা এক ক্রান্তিকাল পার করছি সত্যি, তবে এক কঠিন সম্ভাবনার যুগে উত্তরণের অপেক্ষায়ও আছি।

রাজনৈতিক সংকট ও নিদেনপক্ষে সুশাসনের অনিশ্চয়তা আমাদের ছেড়ে এখনই চলে যাচ্ছে না। গণবিপ্লবের ঢেউ গণমাধ্যমকে পাল্টে না দেওয়ারও আরেক অর্থ হচ্ছে গণমাধ্যমকে নিজস্ব বেদনা বহন করেই নতুন করে বিকশিত হতে হবে।

সূত্র, আমার দেশ