মার্কিন সাংবাদিক জন রিড লিখেছিলেন ‘দুনিয়া কাঁপানো ১০ দিন। এটি ছিল ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ওপর লিখিত জন রিডের সাড়া জাগানো গ্রন্থের নাম। সেই অনুসারে আমরা এখন জুলাই-আগস্ট বিপ্লবকে অভিহিত করতে পারি ‘দুনিয়া কাঁপানো ৩৬ দিন’। সত্যিই এটি দুনিয়া কাঁপানোই ছিল। দুনিয়ার সব প্রান্তের মানুষই জানে, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা কীভাবে জীবন দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিস্ময়কর এক বিজয় লাভ করেছিল।
দেখতে দেখতে সেই রক্ত ঝরা বিপ্লবের একটি বছর পার হয়ে গেল। এখনো স্বজন হারানো পরিবারগুলোর কান্না থামেনি, এখনো আহতরা কাতরাচ্ছে বিছানায়। তাদের ক্ষতস্থান এখনো দগদগে ঘায়ে পরিণত হয়েছে। যারা পঙ্গু হয়েছে, তাদের ভবিষ্যৎ এখনো অজানা। সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর দেয়াল লেখনী এখনো জ্বলজ্বল করছে। অথচ আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই নিষ্ঠুর হত্যাকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিহাসের জঘন্য গণহত্যাকে ‘শিল্পে রূপ’ দেওয়ার চেষ্টা করছে! ভাবখানা এমন, তারা এই গণহত্যা নিয়ে আনন্দ দিবস পালন করতে চায়। শুনেছি লিবিয়ায় এমন একটি দিবস সরকারিভাবে পালন করা হতো, যে দিবসে লিবিয়া সরকার নিষ্ঠুরভাবে ভিন্ন মতাবলম্বীদের হত্যা করেছিল। সরকারিভাবে পালন করার মূল লক্ষ্য ছিল জনগণকে এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, সরকারের বিরুদ্ধে গেলে এ রকমই পরিণতি ভোগ করতে হবে। জুলাই হত্যাকারীদের কথাবার্তা শুনে ও ভাবগতি দেখে সেটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুনছি তারা বিদেশে বসে টেলিফোনে জুলাই বিপ্লবীদের হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে।
সার্কের পতন ও নতুন আঞ্চলিক জোটসার্কের পতন ও নতুন আঞ্চলিক জোট
পরে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির কি করুণ পরিণতি হয়েছিল, তা সবাই জানেন। তাকে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। এ জন্য আমরা দায়ী করি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল বিচারবহির্ভূত খুন ও অনৈতিক নিষ্ঠুর শাসনের অবধারিত ফল। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা ভবিষ্যতে হয়তো জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের দিনগুলো সেভাবেই পালন করবে, যেভাবে লিবিয়ায় পালিত হতো।
কারণ এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীর মুখ থেকে ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সামান্যতম অনুশোচনার কথা শোনা যায়নি। বরং এই গণহত্যাকে তারা বিদেশি টাকায় পরিচালিত একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এটি সত্য, আজ পর্যন্তই পৃথিবীর কোনো দেশের ফ্যাসিস্টরা পতনের পর তাদের নিষ্ঠুর কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করেছেÑএমন কোনো নজির নেই। এই নজির জার্মানির একনায়ক হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, পর্তুগালের সালাজাসহÑএ রকম আরো অনেক একনায়কের পতনের পর তাদের অনুসারীদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা কখনোই লক্ষ করা যায়নি। কারণ হৃদয় থাকলে, ভালোবাসা থাকলে কিংবা মানবিকতার সামান্যতম রেশ থাকলেই শুধু কৃত অপরাধের জন্য মানুষের হৃদয়ের অনুশোচনা জাগে। যাদের হৃদয়ে মনুষ্যত্ব নেই, ভালোবাসার অনুরণ নেই, নেই মানবতার সামান্য রেশ, যারা চূড়ান্তভাবে শক্তি প্রয়োগকে শ্রেষ্ঠ উপায়ে ভাবে, যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করে নিঃশেষ করতে চায়, যারা হামলা, মামলা, গুম-খুনকে প্রধান হাতিয়ার করে নেয়, তাদের কাছে অনুশোচনা প্রত্যাশা করা বোকামি ছাড়া আর কী হতে পারে।
যেমন আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়ে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে বাকশাল নামে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল, যা ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। কারণ আমাদের দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধটা হয়েছিল মূলত একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। সুতরাং স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে শুধু দলের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ যেভাবে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল, যা ছিল খুবই হতাশাজনক একটি ঘটনা। কারণ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনে যে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ নেতারা সেটা না করে একদলীয় শাসন কায়েম করে যে মারাত্মক ভুল করেছিলেন, এ ব্যাপারে পরে কখনোই তাদের অনুশোচনা করতে দেখা যায়নি। বরং এখনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বাকশাল সৃষ্টিকে সঠিক মনে করেন এবং এটি বলে থাকেন, জনগণের কল্যাণের জন্য বাকশাল সৃষ্টি করা হয়েছিল। সুতরাং আওয়ামী লীগ নেতারা ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের জন্য অনুশোচনা করবে এটি ভাবাই যায় না।
এখন যেমন আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকে উন্নয়নের কথা বলে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠিত সব ফ্যাসিস্ট সরকারই উন্নয়নের কথা বলে জনগণকে মহবিষ্ট করতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে বাংলাদেশ তো স্বাধীনই হয়ে গেল। তখন আইয়ুব খানের সরকার তার সময়কালকে উন্নয়নের দশক হিসেবে অভিহিত করত। প্রতি মাসের শুরুতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিত, যাকে বলা হতো মাস পহেলা ভাষণ। তার নামে যে কত কিছু হয়েছিল দেশে, তার ইয়াত্তা নেই। আজকের শেরেবাংলা নগর, পাকিস্তান আমলে তার নাম ছিল আইয়ুবনগর। আসাদগেটের নাম ছিল আইয়ুবগেট। এখন কোথায় সেসব নাম? দুঃশাসনের অনিবার্য পরিণতি এ রকমই।
ইতিহাস পুনর্বিবেচনার শিকার মুজিব ও বত্রিশের বাড়িইতিহাস পুনর্বিবেচনার শিকার মুজিব ও বত্রিশের বাড়ি
তবে যে বিষয়টি অবাক করার মতো, সেটি হচ্ছেÑএদেশের কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও ঐক্যের বিষয়গুলো। তারা নিজেদের স্বার্থে পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হয়, আবার অভিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় সব ভেদাভেদ ভুলে। এ ব্যাপারে ১৯৭১ সালে নকশাল আন্দোলনের মূল নেতা চারু মজুমদারের তার এক নিবন্ধে বুর্জোয়াদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সখ্য নিয়ে নিয়ে চমৎকার উপমা দিয়েছিলেন। সম্ভবত নিবন্ধটি ওই সময় পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ব তরঙ্গ’ নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। নিবন্ধটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ঠিক এ রকম : ছোটবেলায় যারা যাত্রাপালা দেখতে যেত, তারা স্টেজে গদা হাতে দুই ভীম পুরুষের লড়াই দেখে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু তারা জানত না যে, গ্রিনরুমে ওই গদাধারী দুজন পরস্পর বন্ধু।
অর্থাৎ বুর্জোয়া কিংবা কায়েমি স্বার্থবাদীরা হোক, তারা রাজনৈতিক মঞ্চে পরস্পর শত্রু, অন্যকে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না। এমনকি প্রয়োজনে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতেও কোনো কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু নতুন কোনো শক্তি যদি তাদের স্বার্থে আঘাত আনে, তাহলে উভয়ই সব দ্বন্দ্ব ভুলে অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যেতে সামান্য দ্বিধা করে না। যেমন : ৯০-এর আন্দোলনের সময় জেনারেল এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে পরস্পরবিরোধী বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত ইত্যাদি রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেভাবেই জুলাই বিপ্লবের পর কায়েমি স্বার্থবাদীরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে।
যদিও জুলাই বিপ্লব-উত্তর অনেকগুলো প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে; কিন্তু চেষ্টা থেমে থাকেনি। বর্তমানে নতুনভাবে, নতুন কৌশলে একটি প্রতিবিপ্লব গঠনের প্রচেষ্টা চলছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা স্পষ্টত মুখ্য হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে কয়েকটি বিবৃতি সবার দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে, যা মূলত ফ্যাসিবাদের পক্ষের শক্তিকে উৎসাহ জোগাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
বিষয়:
জুলাই গণঅভ্যুত্থান