আরব ও ইসলামি বিশ্বের হৃদয়ের একেবারে মাঝখানে ইহুদি প্রকল্প প্রোথিত করার পর কেটে গেছে ৭৭ বছরের বেশি সময়। এই দীর্ঘ সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অকল্পনীয় রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা এবং সমর্থন পেয়ে আসছে ইহুদি বর্ণবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের অস্তিত্ব এখনো ভঙ্গুর অবস্থাতেই রয়েছে। সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে নিজেকে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দেশ হিসেবে তুলে ধরতে ইসরাইলের বাগাড়ম্বর সবসময়ই শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশটির টিকে থাকা এখনো বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপের ওপরই নির্ভর করে।

১৯৪৮ সাল থেকেই পশ্চিমা শক্তিগুলো রাজনীতি, পুঁজি, বিজ্ঞান ও সামরিক শক্তিসহ সব ধরনের সহায়তা দিয়ে বসতি স্থাপনকারী এই ঔপনিবেশিক প্রকল্পটিকে পরিপুষ্ট করে তুলেছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার ইহুদি বিশেষজ্ঞ এবং পেশাজীবীদের ইসরাইলে নিয়ে আসা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলের আদিবাসী ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রতিষ্ঠা করা ইহুদি বর্ণবাদী এই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে দেওয়া হয় শত শত বিলিয়ন ডলার। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হয়। কেননা, ফিলিস্তিনিদের গায়ের রঙ ‘যথেষ্ট সাদা নয়’।

বিগত দশকগুলোয় ইসরাইল বিপুল অস্ত্রের সমাহার ঘটিয়েছে তাদের সমরাস্ত্রের ভান্ডারে। এগুলোর মধ্যে আছে-বেআইনি পরমাণু অস্ত্র, আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও নজরদারি প্রযুক্তি। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের নিপীড়ক সরকারগুলোর কাছে নজরদারির এই প্রযুক্তি রপ্তানি করা হয়ে থাকে। ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে দখলদারিত্বকে নিয়ন্ত্রণের একটি বৈশ্বিক মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু তারপরও ইসরাইলের অবস্থান দিন দিন নড়বড়ে হয়ে আসছে।

২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরাইলে হামাস পরিচালিত সামরিক অভিযানের পর থেকেই এদেশটির ভঙ্গুর অবস্থা সবার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। এটা এখন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ইসরাইল কোনোক্রমেই আত্মনির্ভরশীল একটি আঞ্চলিক শক্তি নয়, এটি পুরোপুরিই পরনির্ভরশীল একটি প্রজেক্ট। আমেরিকার সামরিক সহায়তা, ইউরোপের রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও পশ্চিমাদের অব্যাহত অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ইসরাইলের দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার কোনোই সম্ভাবনা নেই।

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় সর্বশেষ সামরিক আগ্রাসনে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের গোলাবারুদ, বিমান সহায়তা এবং মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছে। সর্বশেষ ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, আমেরিকার সহায়তা ছাড়া ইসরাইল এককভাবে এই যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না। এ জন্য ১৩ জুন ইরানে হামলার পর থেকেই ইসরাইল বারবার চেষ্টা করেছে যুদ্ধে আমেরিকাকে জড়িয়ে ফেলতে।

শেষ পর্যন্ত এতে তারা সফল হয়েছে। মার্কিন দূরপাল্লার বোমারু বিমানগুলো ইসরাইলের হয়ে ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু কেন্দ্রে বাংকারবিধ্বংসী বোমা হামলা চালায়। বিশেষ করে ফোর্দো পরমাণু স্থাপনায় হামলা করতে ইসরাইলের পক্ষ থেকে আমেরিকাকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। আমেরিকার বিপজ্জনক এই হামলা আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠেÑএটা কেমন ‘আঞ্চলিক শক্তি’, যারা তাদের যুদ্ধ করে দেওয়ার জন্য একটি বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারের কাছে ধরনা দিতে হয়? এটা কোন ধরনের সার্বভৌম দেশ? কেমন তাদের সার্বভৌমত্ব?

এদিকে, অধিকৃত পশ্চিমতীরে ইসরাইল সহিংস উচ্ছেদ, হত্যা, বাড়িঘর ধ্বংস, গণগ্রেপ্তার এবং কারাবন্দি ফিলিস্তিনি ও তাদের পরিবারগুলোকে নানাভাবে শাস্তি দিচ্ছে। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলছে গণহত্যা, পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, দখল এবং জীবন ও অবকাঠামোর নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ।

জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করছে ইহুদিরা। এই মসজিদ কম্পাউন্ডকে প্রায়ই বন্ধ করে দিয়ে ফিলিস্তিনিদের ইবাদতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি রাতে মসজিদের ভেতরে নামাজের জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনা, পুলিশ ও বসতি স্থাপনকারীরা। সেখানে পবিত্র কোরআনের অবমাননা করা হচ্ছে। আটক করা হচ্ছে নিরাপত্তা প্রহরীদের। আর এ সবকিছু দেখেও নীরব ভূমিকা পালন করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। সবকিছু দেখে তারা হয়তো আত্মতুষ্টিতেও ভুগছে।

কিন্তু এত কিছু করেও ইসরাইল যেটা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, তা হলো, ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধকে দমাতে পারেনি তারা। এই প্রতিরোধ শুধু রকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি আদর্শ, যা বিশ্বাসের গভীরে প্রোথিত। এই আদর্শ ও বিশ্বাস ইসরাইলের শত নিপীড়নের মধ্যেও বেড়েই চলেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হচ্ছে। গাজা থেকে পশ্চিমতীর, সানা থেকে তেহরানÑএভাবেই গড়ে উঠছে নতুন জোট। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে লাখো কণ্ঠস্বর আজ উচ্চারিত হচ্ছে শিকাগো থেকে কেপটাউন পর্যন্ত।

হ্যাঁ, ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আছে, কিন্তু দেশটির নৈতিক কোনো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নেই। তারা প্রিসিশন গাইডেড বিমান হামলা চালাতে সক্ষম, কিন্তু এর মাধ্যমে তারা মুক্তির আদর্শেও ধারণাকে ধ্বংস করতে পারবে না। কারণ এটি লাখ লাখ মানুষের হৃদয়ের গভীরে বাস করে। প্রতিষ্ঠার ৭৭ বছর পরও ইসরাইল এখনো বখে যাওয়া, বেআইনি একটি শিশু, যেটি তার নিরাপত্তার জন্য আজীবনই চেয়ে থাকে তার শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকের দিকে। এই রাষ্ট্রটির সত্যিকারের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ঘাটতি আছে। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তারা সর্বদাই শঙ্কিত।

অস্ত্র ও পরাশক্তির ওপর নির্ভর করে টিকে থাকা ইহুদি রাষ্ট্রটির কোনো বৈধতা নেই। তারা টিকে আছে শুধু ভীতি প্রদর্শন ও প্রোপাগান্ডার ওপর। আর এ কারণেই এই রাষ্ট্রটির পতন ঘটবে। কেন না আদর্শের কখনো মৃত্যু হয় না। ফিলিস্তিনিরা আজ ধ্বংসস্তূপে, ক্যাম্পে, স্মৃতিতে এবং ভবিষ্যতের মাঝে বেঁচে আছে, থাকবে। কাজেই যে ‘রাষ্ট্র’ কখনো ম্যাচিউর হয়নি, তার পতন ও ফিলিস্তিনিদের বিজয় অনিবার্য। সত্য কখনোই বিবর্ণ হয়ে যায়নি।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, আল আরব ইন ইউকে

মিডল ইস্ট মনিটর থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী

সূত্র, আমার দেশ