ইন্টারনেট মানুষের জন্য অবারিত তথ্যপ্রবাহের দ্বার খুলে দিয়েছে। কিন্তু অজস্র তথ্যের ভিড়ে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, তা যাচাই করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানে বিশ্বজুড়ে বহু ফ্যাক্ট-চেকিং বা তথ্য যাচাইয়ের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য সোর্সের চেয়ে নির্ভরযোগ্য মনে হলেও সব সময় তা নাও হতে পারে। ঐতিহ্যবাহী মিডিয়াগুলোর মতো এগুলোও হয়ে উঠতে পারে ক্ষমতা উৎপাদনের হাতিয়ার।
১৭ ও ১৮ শতকে সাংবাদিকতার উত্থানপর্বে সাংবাদিকদের দ্বারাই ভুয়া তথ্য ছড়ানো একটা সাধারণ বিষয় ছিল। তখন সাধারণত প্রতিযোগী সংবাদমাধ্যমগুলো একে অন্যের ভুয়া সংবাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরতেন। ১৯২০-এর দশকে দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনটি প্রথমবারের মতো ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ দেয়। এর অল্পদিনের মধ্যে টাইম ম্যাগাজিন ও লাইফ ম্যাগাজিনও তাদের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর তথ্য যাচাইয়ের জন্য লোক নিয়োগ দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাংবাদিকতার ধারণা ও চর্চা বেশ সংহত রূপ লাভ করলেও ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের বিষয়টি খুব একটা জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। তবে ৯০ দশক ও শূন্য দশকে মানুষের হাতে ইন্টারনেট আসতে শুরু করলে তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ অল্পকিছু প্রতিষ্ঠান থেকে কিছুটা বেরিয়ে আসে এবং ব্যক্তিপর্যায়ে তথ্য আদান-প্রদান বাড়তে থাকে। এরপর ২০০৩ ও ২০০৭ সালে দুটি স্বতন্ত্র ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানের দেখা মেলে। তবে এদের কাজের পরিধি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
২০১০ সালের পর থেকে ফেসবুক ও টুইটার হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। বিপুল পরিমাণে ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনাগুলো তখন থেকেই ঘটতে থাকে। কিন্তু ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচন ও ২০১৯ সালের কোভিডের সময় ভুয়া তথ্য ছড়ানো ব্যাপারটি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সীমা ছাড়িয়ে যায়। এ সময় থেকেই ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের বিষয়টি জনপ্রিয় হতে থাকে এবং ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করে। বিশেষ করে কোভিডের সময় ফ্যাক্ট-চেকাররা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে অতিদ্রুত আবার এই জনপ্রিয়তায় ধস নামে। ফ্যাক্ট-চেকারদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে পক্ষপাতের অভিযোগ আসতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের ওপর প্রথম ধাক্কাটি আসে এক্স-এর পক্ষ থেকে। ২০২২ সালে সাবেক টুইটারের ‘ট্রাস্ট অ্যান্ড সেফটি কাউন্সিল’ বাতিল করে দেন ইলন মাস্ক। প্রায় ১০০টি স্বাধীন সংগঠনের সমন্বয়ে এই কাউন্সিলটি গঠিত হয়েছিল। এর বদলে ইলন মাস্ক ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের দায়িত্ব ছেড়ে দেন ব্যবহারকারীদের ওপর। কোনো তথ্যের ব্যাপারে ব্যবহারকারীদের আপত্তি থাকলে ‘কমিউনিটি নোটের’ মাধ্যমে তা উত্থাপন করার সুযোগ আছে।
এ বছরের প্রথমদিকে মার্ক জাকারবার্গও একই পথে হাঁটলেন। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের পদ্ধতি বাতিল করে দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ফ্যাক্ট-চেকাররা অতিরিক্ত পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন। তারা যতটুকু বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি হারিয়েছেন।’ তিনিও এক্স-এর মতো ‘কমিউনিটি নোট’ ধরনের কিছু চালু করতে চান।
মাস্ক ও জাকারবার্গের এই উদ্যোগ যে খুব সাদরে গৃহীত হয়েছে, তা নয়। বহু সাংবাদিক ও ফ্যাক্ট-চেকাররা এর ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রভাবেই মার্ক জাকারবার্গ আর ইলন মাস্ক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে ফ্যাক্ট-চেকিং যে চরমমাত্রায় একপক্ষীয় হতে পারে, তার উদাহরণ অসংখ্য। তাই, কে ফ্যাক্ট চেক করছেন, কোন ফ্যাক্টটি চেক করছেন, এমনকি কোন ধরনের ফ্যাক্ট চেক করা হচ্ছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কারণ সত্য তথ্য উপস্থাপন করেও জনমানসে ভুল বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, যদি তা বিশেষ ধরনের ও একপক্ষীয় সত্য হয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ রয়েছে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধের ঘটনায়। এ যুদ্ধে ইরান ও ইসরাইল উভয় পক্ষ থেকেই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোয় ব্যাপক ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয়েছে। যুদ্ধের শেষপর্যায়ে এসে ডয়চে ভেলে যুদ্ধকালে এআইয়ের মাধ্যমে ছড়ানো তিনটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে। এর মধ্যে তিনটি ভিডিওই ইরানের বিপক্ষে যায়। ৬ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের এই ভিডিওটি দেখলে মনে হতে পারে, ভুয়া তথ্য শুধু ইরানই ছড়ায়। অথচ ইসরাইলের পক্ষ থেকেও বহু ভুয়া ভিডিও বানানো হয়েছিল। এমন নয় যে ডয়চে ভেলে পৃথক কোনো ভিডিওতে ইসরাইলের পক্ষ থেকে ছড়িয়ে দেওয়া অপতথ্যগুলোর ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
কার্যত ফ্যাক্ট-চেকিং আসলে কতটা ‘ফ্যাক্ট’ উপস্থাপন করছে, তা প্রধানত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পক্ষের ওপর নির্ভর করে। আবার ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের প্রাথমিক বিষয় হচ্ছে ছড়িয়ে পড়া সংবাদ বা কনটেন্টের ওপর সন্দেহের সৃষ্টি হওয়া। তবে সাধারণত কোনো তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পক্ষে গেলে সে সম্পর্কে তিনি সন্দিহান হন না। ফলে বিষয়টি খতিয়ে দেখার চিন্তাও উদ্রেক হয় না।
এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ফ্যাক্ট-চেকিং শব্দটি জড়িত থাকলে জনমানসে তার সম্পর্কে একটু বেশি আস্থার সৃষ্টি হয়। এ আস্থাই এসব প্রতিষ্ঠানের শক্তি এবং ক্ষমতা উৎপাদনের হাতিয়ার।
কিন্তু তাই বলে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ দিনশেষে প্রকৃত ঘটনাই আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে ফরেন ইনফরমেশন ম্যানুপুলেশন অ্যান্ড ইন্টারফিয়ারেন্স বা এফআইএমআইয়ের ব্যবহার বাড়ছে। এর মাধ্যমে ভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করা হয়। এই কৌশল প্রয়োগে রাশিয়া বেশ সিদ্ধহস্ত। ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে দেশটির বিরুদ্ধে। এক্স-এর মাধ্যমে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মতামত উৎপাদন করে থাকে দেশটি। এমনকি ইউক্রেনে হামলার আগে অনলাইনে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে নিয়েছিল রাশিয়া। তবে শুধু রাশিয়া নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, সৌদি আরব, চীনসহ আরো কিছু দেশ নিয়মিত এই কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।
ইসরাইলি স্পেশাল ফোর্সের সাবেক এক সদস্যের দ্বারা পরিচালিত ‘টিম জরগে’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো প্রভাবিত করাই এর মূল কাজ। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান তাল হানান খুব গর্ব করে বলেছিলেন, ২০২৩ সালে কেনিয়ার নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ও তার উপদেষ্টাদের নির্বাচনী কৌশল ফাঁস করে দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।
২০২৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চীনও ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল। অন্যান্য সময়ের মতো সেবার আর সামরিক হামলার হুমকি দেয়নি চীন। বেছে নিয়েছিল অনলাইন প্রচারের মাধ্যম। নির্দিষ্ট প্রার্থীদের যোগ্যতা সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে তাদের বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশেরও প্রস্তুতির দরকার আছে। অসংখ্য ভুয়া তথ্যের ভিড়ে দ্রুত সত্য তথ্যটি নির্ণয় করে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ফ্যাক্ট-চেকিং লাগবেই। একদিকে যেমন ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য ও মতামত উৎপাদনের সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, তেমনি জনপরিসরে মতামত উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্ট-চেক করার মতো নিজস্ব মেকানিজম থাকা উচিত। নিদেনপক্ষে প্রকৃত তথ্য কোনটি, তা বের করার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দরকার।
লেখক : সাংবাদিক
সূত্র, আমার দেশ