বাংলাদেশের চামড়া শিল্প অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। কোরবানির ঈদের সময় এই শিল্পে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আসে, যা সারা বছরের কাঁচা চামড়ার একটি বড় অংশ পূরণ করে। প্রতি বছর প্রায় এক কোটি পশু কোরবানি দেওয়া হয়, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক গরু এবং বাকিগুলো খাসি, ছাগল ও উটসহ অন্যান্য পশু। কোরবানির এই চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে দেশ থেকে বছরে প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এটি বাংলাদেশের একটি মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রতিবছর অসচেতনতা, অব্যবস্থাপনা এবং সঠিক সংরক্ষণের অভাবে এই কাঁচা চামড়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নষ্ট হয়ে যায়, যার ক্ষতি সরাসরি জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিফলিত হয়।

গত বছর কোরবানির সময় প্রায় ২০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। এই ক্ষতি শুধু ব্যবসায়িক খাতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সমাজের দরিদ্র, এতিমখানা, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উপরও এর গভীর প্রভাব পড়ে। কারণ, অনেক কোরবানি দাতা তাদের পশুর চামড়া এসব প্রতিষ্ঠানকে দান করেন এই আশায় যে, এটি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সহায়তা পাবে। কিন্তু চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ না হওয়ায় বা সময়মতো বাজারজাত না করতে পারায় এসব প্রতিষ্ঠান তাদের প্রত্যাশিত সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়।

আমি একজন লেদার ইঞ্জিনিয়ার এবং বাংলাদেশের লেদার ইঞ্জিনিয়ারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে এই বিষয়ে কথা বলাকে আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করি। আমাদের সংগঠনের সদস্যরা সরাসরি চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণের সাথে যুক্ত। আমরা প্রতি বছর কোরবানির মৌসুমে লক্ষ্য করি, অসচেতনতা ও প্রস্তুতির অভাবে মানুষ কাঁচা চামড়া রোদে ফেলে রাখে, পানিতে ডুবিয়ে রাখে, কিংবা উপযুক্ত লবণ প্রয়োগ না করেই রেখে দেয়। এতে চামড়ার উপর জীবাণু বাসা বাঁধে এবং হেয়ার স্লিপ বা গ্রেইন অফ জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হয়, যা চামড়ার গুণগতমান একেবারেই নষ্ট করে ফেলে।

ট্যানারির মালিকরা এই নষ্ট হওয়া চামড়া কিনতে অনাগ্রহী হন, কারণ এটি প্রক্রিয়াকরণযোগ্য নয়। অনেক সময় দেখা যায়, একজন ট্যানারি মালিক একটি পিচে ১,০০০ টাকা খরচ করে চামড়া কিনছেন, কিন্তু প্রক্রিয়াজাত করার পর বুঝতে পারছেন সেটি বিক্রির যোগ্য নয়। এর ফলে বিদেশি ক্রেতারাও বাংলাদেশি চামড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং আমাদের বাজার হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, যার প্রতিকার আমাদের সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে না এলে সম্ভব নয়।

জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ অভিযোগ হচ্ছে—গত কয়েক বছর ধরে কোরবানির কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন, গরুর একটি চামড়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বেশি বিক্রি করা যাচ্ছে না। এই অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। তবে এর একটি বড় কারণ হচ্ছে চামড়ার গুণগত মান ঠিক না থাকা এবং সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করা। যদি আমরা সবাই সচেতন হই এবং কোরবানির পশুর চামড়া সঠিকভাবে সংরক্ষণ করি, তবে এর ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব।

প্রথমত, কোরবানি দাতাদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা রয়েছে। পশুর চামড়া ছাড়ানোর সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে যাতে সেটিতে কোনো কাটাকাটি বা ছেঁড়া না হয়। অতিরিক্ত মাংস যেন না লেগে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর পর তা কখনোই রোদে বা পানির মধ্যে রাখা যাবে না। বরং ছায়াযুক্ত ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে। যদি ছয় ঘণ্টার মধ্যে এতিমখানা বা কোনো সংগ্রহকারী না আসে, তাহলে অবশ্যই নিজ উদ্যোগে যথাযথভাবে লবণ দিতে হবে। একটি গরুর চামড়ার জন্য সাধারণত ৮ থেকে ১০ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়, যা চামড়ার প্রতিটি অংশে ঘষে লাগাতে হবে। চামড়ায় লবণ দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি ইউটিউব বা অনলাইন মাধ্যম থেকে দেখে নেওয়া যেতে পারে।

এদিকে, এতিমখানা বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব আরও বেশি। যেহেতু তারা সাধারণ মানুষের দানকৃত চামড়া গ্রহণ করে, তাই সেগুলো সংরক্ষণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। চামড়া সংগ্রহ ও লবণ দেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা টিম গঠন করতে হবে, যেন কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। সরকার এবার যে বিনামূল্যে লবণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং যুগান্তকারী। এই সুবিধা যাতে যথাযথভাবে কাজে লাগে, সে জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। পাশাপাশি মসজিদে মসজিদে প্রচারণা চালাতে হবে, যেন কেউ চামড়া নষ্ট না করে এবং যথাসময়ে তা দান বা বিক্রি করে।

চামড়া সংগ্রহের পর লবণ দেওয়া হলে তা অন্তত ৩০ দিন সংরক্ষণযোগ্য থাকে। তাই বিক্রির জন্য তাড়াহুড়ো না করে, যাচাই-বাছাই করে ট্যানারির প্রতিনিধিদের সাথে দরদাম করে বিক্রি করতে হবে। সরাসরি ট্যানারির কাছে বিক্রি করলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় হচ্ছে প্রতিটি জেলার শহরে একটি নির্দিষ্ট চামড়া হাট বা বাজার থাকা, যেখানে ট্যানারির প্রতিনিধিরা সরাসরি চামড়া কিনতে পারবেন।

সরকারের প্রতি আমাদের কিছু অনুরোধ রয়েছে। প্রথমত, বিনামূল্যে লবণ সরবরাহের কার্যক্রমটি আরও বিস্তৃত করা হোক এবং তাতে যাতে কোনো অনিয়ম না ঘটে, সেজন্য বাজার মনিটরিং করা হোক। দ্বিতীয়ত, জেলা শহরগুলোতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চামড়া সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণ করা হোক। তৃতীয়ত, স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মসজিদের ইমাম ও সমাজসেবীদের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালানো হোক, যেন চামড়া নষ্ট না হয়। চতুর্থত, বানিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির পরপরই ট্যানারি মালিকদের সাথে সমন্বয় করে ৮ বিভাগে ৮টি বিশেষ চামড়ার হাটের আয়োজন করতে পারে, যেখানে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সরাসরি চামড়া বিক্রি করতে পারবে। এবং অবশ্যই, চাঁদাবাজি রোধে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন।

আমাদের লেদার ইঞ্জিনিয়ারস অ্যাসোসিয়েশন প্রায় ১,৩০০ সদস্য নিয়ে গঠিত, যাদের মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ জন প্রশিক্ষিত কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ প্রশিক্ষক রয়েছেন। আমরা যদি সরকারের অনুমতি এবং সহযোগিতা পাই, তাহলে ৬৪টি জেলাতেই একযোগে প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে পারি। আমরা দেশের জন্য, শিল্পের জন্য, এবং মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করতে প্রস্তুত, বিনা পারিশ্রমিকে হলেও।

চামড়া শুধু একটি পণ্য নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি পশুর চামড়ার সঠিক সংরক্ষণ যেমন একজন গরীব ছাত্রের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারে, তেমনি দেশের রপ্তানি খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তাই আসুন, কোরবানির এই ঈদে প্রতিজ্ঞা করি—একটি চামড়াও নষ্ট হতে দেব না। আমাদের সচেতনতা, সদিচ্ছা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই বাংলাদেশের চামড়া শিল্প পুনরুজ্জীবিত হবে এবং দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।

লেখক: সভাপতি, লেদার ইঞ্জিনিয়ারস অ্যাসোসিয়েশন

সূত্র, আমার দেশ