ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলিতে রাজনীতি নিষিদ্ধের কর্তৃপক্ষীয় ঘোষণাটি উদ্বেগজনক তো বটেই, বিস্ময়করও। রবিবার প্রকাশিত সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ আবাসিক হলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কমিটি গঠন করিলে শুক্রবার রাত্রিতেই ক্যাম্পাসে কয়েক শত শিক্ষার্থী বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ইহারই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলগুলিতে রাজনীতি নিষিদ্ধের ঘোষণা প্রদান করে– গত বৎসরের ১৭ জুলাই ঢাবির হলগুলিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আগামী দিনগুলিতেও বহাল থাকিবে।
প্রসঙ্গত, গত বৎসরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগের হামলার পর শিক্ষার্থীরা ১৭ জুলাই একজোট হইয়া হলগুলি হইতে সংগঠনটির নেতাকর্মীকে বিতাড়িত করে। আন্দোলনকারীদের দাবি মানিয়া প্রশাসনও হলগুলিকে রাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি বদলাইবার পরও বহাল থাকে কীভাবে? বিশেষত সিদ্ধান্তটি যখন মস্তকপ্রদাহের উপশমে মস্কক কর্তনেরই শামিল। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা-সংক্রান্ত ১৯৭৩ সালের আদেশ অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি সম্পূর্ণ বৈধ।
হলগুলিতে সক্রিয় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ঐ বিক্ষোভকারীদেরই ন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈধ শিক্ষার্থী। আলোচ্য সিদ্ধান্তের কারণে তাহাদের সংবিধানস্বীকৃত অধিকার খর্ব হইতে চলিয়াছে। তাহারা সকলেই প্রাপ্তবয়স্ক এবং আইনানুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য পছন্দের রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করিবার অধিকার রাখেন। ইহাও স্মরণে রাখিতে হইবে, আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতাউত্তর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত। সেই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন গত বৎসরের গণঅভ্যুত্থান। এই সকল আন্দোলন শুধু জাতিকেই মুক্ত করে নাই; বহির্বিশ্বেও দেশ ও জাতির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করিয়াছে। আর শিক্ষার্থীদের এহেন ভূমিকার নেপথ্যে ছিল রাজনীতি সচেতনতা। ছাত্র রাজনীতির উপর আলোচ্য নিষেধাজ্ঞা সেই গৌরবোজ্জ্বল ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটাইবার নামান্তর।
স্বীকার্য, মূল ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হয় নাই। অর্থাৎ ছাত্র রাজনীতির উপর আংশিক নিষেধাজ্ঞা আসিয়াছে। কিন্তু যেই যুক্তিতে উক্ত সিদ্ধান্ত লওয়া হইয়াছে, তাহার সহিত সম্পর্ক ছাত্র রাজনীতির নহে, বরং দুর্বৃত্তপনার– এই কথাটিও স্বীকার করিতে হইবে। তদুপরি একই যুক্তি তুলিয়া কোনো একদিন ক্যাম্পাসেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা হইবে না– তাহার নিশ্চয়তাই কে দিতে পারে? এই সিদ্ধান্ত হলগুলিতে এক প্রকার গুপ্ত রাজনীতিকে উৎসাহ দিতে পারে– এমন সংশয়ও কিন্তু অমূলক নহে। গুপ্ত রাজনীতি শুধু বৈষম্যমূলক নহে, কখনও কখনও দুর্বলের উপর সবলের নীরব জবরদস্তি ও নির্যাতনকেও প্ররোচিত করে।
প্রতিবেদনেই বলা হইয়াছে, অতীতে হলে আসন বরাদ্দে প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপকারী ছাত্রলীগ এখন না থাকিলেও কোনো কোনো হলে এহেন হস্তক্ষেপ বন্ধ হয় নাই। উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে নবীন শিক্ষার্থীদের মেসেঞ্জার গ্রুপে আসন বরাদ্দের আশ্বাস দিয়াছেন একজন ছাত্র, যিনি গুপ্ত রাজনীতিতে অভ্যস্ত একটি ধর্মবাদী সংগঠনের সহিত সংশ্লিষ্ট বলিয়া অভিযোগ রহিয়াছে।
সেবামূলক কর্মসূচির নামে একই সংগঠন গত বৎসরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময় হইতেই হলগুলিতে সক্রিয় বলিয়া শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যদিও আনুষ্ঠানিক কোনো সাংগঠনিক কমিটি উক্ত সংগঠন প্রকাশ করে নাই। এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আলোচ্য বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি দ্রুত পুনর্বিবেচনা করিবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। হলগুলিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সুরক্ষায় প্রশাসন বরং সকল ছাত্র সংগঠনের সহিত কথা বলিয়া রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বিষয়ে আচরণবিধি প্রণয়ন করিতে পারে, যাহা লঙ্ঘনের শাস্তি হইবে দৃষ্টান্তমূলক।