সম্প্রতি লালমনিরহাটের পাটগ্রাম রেলস্টেশনে দেখা গেছে এক দুঃখজনক দৃশ্য। সেখানে ভারতের আসাম রাজ্য থেকে পুশ ইনের মাধ্যমে পাঠানো দুই অশীতিপর বৃদ্ধ মুসলিম ব্যক্তি চুপচাপ বসে আছেন। তারা জানেন না কোথায় এসেছেন, কীভাবে ফিরবেন, এমনকি আদৌ কেউ তাদের দায়িত্ব নেবে কি না। একই সঙ্গে কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তেও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ উদ্বাস্তুদের আগমন থেমে নেই। এ ঘটনাগুলো দেখে মনে হয়, যেন বাংলাদেশের চারপাশে এক নীরব চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, যা শুধু মানবিক সংকট নয়, বরং সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সক্ষমতার কঠিন পরীক্ষাও বটে।

আমাদের দেশের সীমান্তের সবদিকে ‘পুশ ইন’ হচ্ছে, এমন নাজুক সময় আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত ও মিয়ানমার কর্তৃক অবৈধ পুশ ইন ঠেকানো সম্ভব নয়।’ তার এই বক্তব্যে অনেকে হতাশ হয়েছেন। মতামতের ব্যাখ্যায় কিছু বলা না হলেও বোঝা যায়, বাংলাদেশের ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ এবং অনেক ক্ষেত্রে দুর্গম সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত পুরোপুরি সুরক্ষিত রাখা কঠিন, বিশেষ করে পাহাড়ি ও জঙ্গলে ঢাকা অংশগুলোয় নজরদারি সীমিত। এই অবস্থায় অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। এতে এটি বোঝায়, শুধু সীমান্ত পাহারা বা কূটনৈতিক প্রতিবাদ দিয়ে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। বরং প্রয়োজন বহুপক্ষীয় কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খোঁজা, যেখানে মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা—সবকিছুই বিবেচনায় রাখতে হবে। তবে তরুণরা বলছেন, যদি রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায় থেকে বলা হয়, ‘পুশ ইন ঠেকানো যাবে না’, তাহলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার মনোবল ভেঙে পড়ে। এতে তারা নিজ দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারাতে পারে, যা ভবিষ্যতে সীমান্তকে আরো দুর্বল করে তুলবে।

‘পুশ ইন’ বলতে বোঝায়, যখন কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে জোরপূর্বক বা গোপনে অনুপ্রবেশকারী, রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী বা অবাঞ্ছিত নাগরিকদের ঠেলে পাঠিয়ে দেয়। এটি একটি অঘোষিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অপকৌশল, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। প্রতিবেশী রাষ্ট্র তাদের অভ্যন্তরীণ জটিলতা, জাতিগত বৈষম্য কিংবা রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি পেতে এ ধরনের পন্থা অবলম্বন করে। আর সহজ টার্গেট হয় শান্তিপ্রিয়, মানবিক এবং অপেক্ষাকৃত নীরব প্রতিবেশী বাংলাদেশ।

বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি নানা সময়ে নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন, এনআরসি কার্যক্রম ও সম্প্রদায়গত উত্তেজনার ফলে অনেককে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়েছে বা হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এসব ‘অবাঞ্ছিত’ মানুষের অনেকে পাচারকারীদের সহায়তায়, আবার অনেককে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়।

মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা বিদ্যমান। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বরাবরই সে দেশের সরকার রাষ্ট্রবিহীন বলে বিবেচনা করে। ২০১৭ সালে এক ভয়াবহ সামরিক অভিযান থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। আজও সেই বোঝা বহন করছে বাংলাদেশ। আর এখন নতুন করে শোনা যাচ্ছে রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকজনও পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে।

বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই মানবিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ১৯৭১-এ নিজেই শরণার্থী সংকটের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা জাতির মনে গেঁথে আছে। তাই ২০১৭ সালে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে উদারতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল এদেশ। কিন্তু একের পর এক পুশ ইনের ঘটনায় বাংলাদেশের কাঁধে বাড়ছে শুধু মানবিক দায়, আন্তর্জাতিক চাপ ও নিরাপত্তাঝুঁকি, যার দায়ভার প্রতিবেশীরা নিচ্ছে না।

এখানে আমাদের ভাবতে হবে, সীমান্ত রক্ষা শুধু সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কাজ নয়, এটি একটি বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ। যখন একের পর এক পুশ ইন ঘটে, তখন শুধু সীমান্ত নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, সামাজিক ভারসাম্য ও অর্থনীতি। আমরা কি অনন্তকাল ধরে একতরফা মানবিকতার ভার বহন করে যাব, না কি কূটনৈতিকভাবে আরো সক্রিয়, কঠোর ও কৌশলী হব?

বাংলাদেশ সরকারকে একদিকে যেমন সীমান্তে মানবিকতা বজায় রাখতে হবে, অন্যদিকে তেমনই কূটনৈতিক কণ্ঠস্বরকে আরো দৃঢ় করতে হবে। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহল, জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক ফোরামগুলোতেও পুশ ইনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা জরুরি।

বাংলাদেশ অতীতে বহুবার ভারতের এ ধরনের আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবু সমস্যার কোনো কার্যকর সমাধান হয়নি। পুশ ইন যেন একরকম নীরব কূটনৈতিক ‘বার্তা’, যার মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্র দায়িত্ব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি প্রতিবারই শুধু মানবিকতার দোহাই দিয়ে মৌন প্রতিক্রিয়া দেখাবে?

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূমিকা হতে হবে দৃঢ় কিন্তু মানবিক। দুই বৃদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ যেমন আবশ্যক, তেমনি ঘটনাটির সুস্পষ্ট নথিবদ্ধকরণ এবং ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এর সুরাহা খোঁজাও জরুরি। এ ঘটনা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা অথবা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার নজরে আনাও প্রাসঙ্গিক হতে পারে।

বর্তমানে যখন দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন সীমান্তে এমন মানবিক সংকট কোনো একক ঘটনার প্রতিফলন নয়, এটি একটি বৃহত্তর সমস্যার অংশ। বাংলাদেশকে অবশ্যই মানবিকতা বজায় রেখেই কূটনৈতিকভাবে অধিক সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাস মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্তে ভরপুর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় লাখ লাখ বাঙালি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েই বাংলাদেশ আজও বিভিন্ন সংকটে উদ্বাস্তুদের প্রতি মানবিক আচরণ করে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া তারই বড় প্রমাণ। তবে এই মানবিকতা যে একতরফা দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, তা বলাই বাহুল্য। যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো বারবার এ সুযোগ নিচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে এই মানবিকতা কি দুর্বলতার নামান্তর হয়ে যাচ্ছে?

পুশ ইন একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। আন্তর্জাতিক আদালত, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা অথবা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার নজরে আনার মাধ্যমে বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরা যেতে পারে। এতে একদিকে বাংলাদেশ তার ন্যায্য অবস্থান তুলে ধরতে পারবে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হবে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর ওপর। ভারত ও মিয়ানমার দুই প্রতিবেশীর সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সংলাপের মাধ্যমে একটি স্পষ্ট সীমান্ত নীতি গড়ে তোলা দরকার। এসব আলোচনায় জাতিসংঘ, সার্ক, বিমসটেক কিংবা আসিয়ানের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।

বিজিবি ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে উন্নত নজরদারি সরঞ্জাম, ড্রোন, সেন্সর এবং ক্যামেরা দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে তথ্যভিত্তিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। পুশ ইন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ মোকাবিলায় একটি সুস্পষ্ট জাতীয় নীতিমালা থাকা জরুরি। এতে স্পষ্টভাবে বলা থাকবে। কোন পরিস্থিতিতে কাকে আশ্রয় দেওয়া যাবে আর কাকে সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়ে দিতে হবে।

মানবিকতা ও সার্বভৌমত্বÑএই দুটি বিষয়কে মাথায় রাখতে হবে। একজন বৃদ্ধ মানুষ যখন পুশ ইনের শিকার হয়ে দেশের মাটিতে এসে দাঁড়ায়, তখন আমরা তাকে ফেরাতে পারি না, মানবিক কারণে। আবার তাকেই চিরকাল আশ্রয় দিয়ে রাখলে আমরা একটি অন্য রাষ্ট্রের ভুলের দায় কাঁধে তুলে নিই, যা বাস্তবতা ও নিরাপত্তার পরিপন্থী।

সুতরাং বাংলাদেশকে আরো দৃঢ়, বিচক্ষণ এবং কৌশলী হতে হবে। অবৈধ পুশ ইন ঠেকানো সম্ভব নয়, এ ধরনের মন্তব্য একজন রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মুখ থেকে আসা শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, বরং নীতিগত, কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকেও অনুচিত। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব তার সীমান্ত রক্ষা করা। কোনো রাষ্ট্র যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়, সে তার সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অক্ষম, তাহলে এটি সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের দুর্বলতার প্রকাশ।

এতে শত্রুরাষ্ট্র কিংবা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে একটি নরম ও অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা হতে পারে। ‘পুশ ইন ঠেকানো সম্ভব নয় বা ঠেকানো যাবে না’ বললে রাষ্ট্র নিজেই একটি অবৈধ কাজের বৈধতা দেওয়া হয়। এই দায়িত্বহীন, দুর্বল ও কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক বক্তব্য, যা জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলতে পারতেন ‘পুশ ইন একটি অবৈধ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড। বাংলাদেশ সর্বোচ্চ কূটনৈতিক ও সীমান্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করছে, যাতে এর পুনরাবৃত্তি না হয়। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও বিষয়টি অবহিত করছি।’ কারণ, যেকোনো দেশের সীমান্ত রক্ষায় ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় সে দেশের দায়িত্বশীলদের গাফিলতির কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

বিষয়:, সীমান্ত পুশইন