‘দো নাথিং ক্যান ব্রিং ব্যাক দি আওয়ার/ অব স্প্লেনডার ইন দি গ্রাস, অব গ্লোরি ইন দি ফ্লাওয়ার/ উই উইল গ্রিভ নট, রাদার ফাইন্ড/ স্ট্রেংথ ইন হোয়াট রিমেইন্স বিহাইন্ড’—উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা থেকে এই উদ্ধৃতি। এর অনুবাদ আমি এভাবে করছি—‘যদিও কিছুই পারে না ফেরাতে ক্ষণ/ ঘাসের ঔজ্জ্বল্য আর পুষ্প মহিমার মন/ আমরা হই না শোকাচ্ছন্ন, বরং খুঁজি/ শক্তি যা কিছু পেছনে রয়ে গেল বুঝি।’
চলুন, জুলাই বিপ্লবের সেই ৩৬ দিনের দিকে আবার একটু ফিরে তাকাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ সে সময় একক ও ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে জান-প্রাণ দিয়ে লড়াই করেছিল। চাকরির জন্য তাদের এই পলিটিক্সই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবদলের পলিটিক্সে রূপান্তরিত হয়। কোটার সংস্কার রাষ্ট্রসংস্কারে রূপ নেয়। কোটার পলিটিক্স পৌঁছে যায় ফ্যাসিবাদ উৎখাতের পলিটিক্সে। বোধের জগৎ উজ্জ্বল হয় যে, রাষ্ট্রই সকল ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, সিদ্ধান্ত ও বরাদ্দের কেন্দ্র। তাই রাষ্ট্র ও ‘ফ্যাসিনা’র আইডেনটিফাইড হালত ভাঙতেই হবে। আওয়াজ ওঠে—দফা এক দাবি এক/ শেখ হাসিনার পদত্যাগ।
শুধু তা-ই নয়। পুরোনো রাষ্ট্রবন্দোবস্ত ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা বদলে ফেলে নতুন রাষ্ট্রবন্দোবস্ত ও সাংবিধানিক ব্যবস্থার তথা রাষ্ট্রের আমূল সংস্কারের দাবি ওঠে। এভাবে কোটার আন্দোলন ৩৬ দিনের মধ্যে সারা দেশে কেবল ছাত্রদের মাঝেই নয়, ছড়িয়ে পড়ে পুরো জনসমাজে। সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ পথে নেমে আসে। কোটার বৈষম্য ও বঞ্চনা, অসাম্য ও অনাচার বাংলাদেশের জনভূগোলকে তাদের জীবনবঞ্চনা-বোধের সঙ্গে এক মোহনায় মিলিয়ে দেয়। সারা দেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিদ্রোহ আর বিপ্লব তখন রাজধানীসহ সারা দেশে উত্তাল সাগরের ঢেউ তোলে।
এই ৩৬ দিনে কোটা নিয়ে যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও লড়াই চলছিল, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কোটা নিয়ে যত আওয়াজ উঠেছে তার মাঝেই উপ্ত ছিল নতুন দিনের আহ্বান, নয়া বন্দোবস্তের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আর রাষ্ট্র সংস্কারের স্পষ্ট উচ্চারণ। ছাত্ররা স্পষ্ট করে জানিয়েছে, তারা কোটা নয়, মেধা দিয়েই চাকরি চায়, যোগ্যতা নিয়েই দাঁড়াতে চায়। কেননা বাংলাদেশে কোটার চরম অপব্যবহার ও দুর্নীতি সব ক্ষেত্রে মেধাকে কবর দিয়েছিল।
ফ্যাসিস্ট মুজিবের আমলে যেমন ছিল তোফায়েল ক্যাডার, তেমনি ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯-২০২৪ পর্যায়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার ছিল সোনার ছেলে পূজারি-গোপালি ক্যাডার। কোটার নামে সংকীর্ণ স্বার্থ, উৎকোচ বাণিজ্য, আত্মীয়করণ ও দলীয়করণ তথা আওয়ামীকরণ সারা দেশকে প্রায় শতভাগ গ্রাস করে ফেলেছিল। মেধার কোনো জায়গাই ফ্যাসিস্ট হাসিনা রাখেনি। কোটা মূলত আওয়ামী থেকে শুরু করে বিশেষ ধর্মাবলম্বী হয়ে একেবারে গোপালিতে পৌঁছেছিল।
এজন্যই ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের যথার্থ নামটি হয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন। অর্থাৎ বৈষম্যই নিষ্ঠুরতম বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিসিএস চাকরিসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে। এ কারণে জনগণ তাদের না পাওয়া, ফ্যাসিস্ট কর্তৃক চাপানো পক্ষপাত, অসাম্য, অনাচার, বেইনসাফি ও বৈষম্যের বাস্তবতাকে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী দাবির সঙ্গে এক করে দেখতে পেরেছিল এবং এভাবে যে সংহতি, ঐক্য ও একাত্মতা তৈরি হয়েছিল, তার ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান, যাকে আমরা বলি জুলাই ৩৬।
কিন্তু এত বড় ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান, জীবনদান ও ত্যাগ স্বীকারের পরও আমরা কি ভুলে গেলাম আমাদের নিশানা, আরাধ্য মনজিল? সবকিছুই কি আগের মতো, পুরোনো অচলায়তনে, নিগড়ে রয়ে গেল? কোটা আর বৈষম্য শুরু থেকেই রাক্ষুসে মুখ দেখাল। আমরা কি ভুল বাছাই করলাম? আমরা কি গোলাপ ভেবে ঘেঁটুকেই গ্রহণ করলাম? যদি তা-ই না হবে, তবে জুলাইয়ের ৩৬ দিন আগস্টের ৫ থেকে মাত্র তিন দিনের মাথায় যা চেপে বসল ৮ আগস্ট, তাতে করে কোটা আবর্জনা ও বৈষম্যের কালকূট উলঙ্গভাবে ফিরে এলো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা কী দেখল? মহামানবের মিথ নিমেষেই মরীচিকা হয়ে গেল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলো সম্পূর্ণ কোটার ভিত্তিতে। এখানে থাকল সবচেয়ে বেশি করে এনজিও কোটা। আবার এনজিওর ভেতর অতিমূল্যবান বিশেষ এনজিও কোটা, ১/১১-র কোটা, বিশেষ জেলা কোটা, সংকীর্ণ ব্যক্তিক ও পারিবারিক সম্পর্কের কোটা। বৈষম্য গেল না, সাম্য-সমতা এলো না। ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও ফ্যাসিস্ট খুনিদের এবং গণশত্রু ও দোসরদের কোনো বিচার হলো না! ঐকমত্য সংলাপের কচকচানি ও ছেলেভোলানো পরস্পরবিরোধী দায়সারা বোলচাল চললেও বাস্তবে প্রকৃত সংস্কার আজও অধরা।
জনগণকে অন্ধকারে রেখে জাতীয় নিরাপত্তা, চুক্তির বিষয়াদি, বন্দর, মানবিক করিডোর, সেন্টমার্টিন গমন নিষিদ্ধকরণ, জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস চুক্তি, এলজিবিটিকিউ প্রভৃতি সিদ্ধান্ত একতরফা হয়ে গেল। বিচার ও সংস্কার উভয় ক্ষেত্রেই ছাত্রজনতা নিরুপায় দর্শক এখন।
আর এ উভয় ক্ষেত্রেই খায়খাতির ও দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে কোটার উলঙ্গ বাস্তবায়ন দেখল দেশবাসী—কাউকে পালাতে দেওয়া, কাউকে পুনর্বাসন; কাউকে ছাড়া, কাউকে ধরা। কিন্তু প্রকৃত ও দ্রুত বিচার একটিও দেখল না জনগণ। সেই পুরোনো পথে ব্যক্তিসম্পর্ক, স্বজন, গোত্র, গোষ্ঠী, অস্ত্র, টঙ্ক, লেনদেন প্রভৃতি প্রপঞ্চ কোটাকেই সর্বত্র সর্বাধিকভাবে বহাল করল। সরকার এত অকেজো, অথর্ব অবস্থায় গেল যে এমনটা আগে কেউ দেখেনি। বড় বেশি দুর্বল ও তালগোল পাকানো হালত তাদের—আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বাজার পরিস্থিতি প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত। তবে কথামালা ও প্রতিশ্রুতির ফানুস রয়েই গেল। আর রাষ্ট্রের জনমালিকানা, নতুন বন্দোবস্ত, মানবিক সাম্য, নাগরিক অধিকার, গণভোট ও নির্বাচন কি পথ হারাল? স্পষ্ট বোধগম্য, প্রলম্বিত কালোমেঘ আমাদের সামনে। দৃশ্যত উপদেষ্টা পরিষদ আর কমিশনগুলো কোটা ও বৈষম্যের একচোখা যাত্রা-পালাতেই আটকে থাকছে। সচেতন মানুষের আশাভঙ্গ হয়েছে।
যে ছাত্রীরা ও নারীরা এত ত্যাগ স্বীকার করল, তারা এখন কী ভাবছে? এক নারী কমিশন। সেটার সদস্য, কাঠামো, পুরো কার্যক্রম ও রিপোর্ট কোটা ও বৈষম্যের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। অথচ এর রিপোর্ট প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ, প্রচার, বিলি, পোস্টার, সর্বত্র অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রমে ঢুকিয়ে বাস্তবায়ন করার উচ্ছ্বসিত নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার। ভেতরে কী আছে দেখলেনও না। মুহূর্তের মাঝেই ঘোষণা। আর সব সমস্যা বাদ দিলেও নারী কমিশন তাদের সুপারিশে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য আরো ৩০০ আসন সংরক্ষণের কোটা ঢোকাল। উচ্চকক্ষে ৫০ ভাগ নারী কোটা। দলে এতদিনকার ৩৩ ভাগ নারী কোটা। উপজাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবর্তে ‘আদিবাসী’ উচ্চারণের মাত্রাতিরিক্ত পৌনঃপুনিকতার সয়লাব দৃশ্যমান। তাদের বিশেষ সুবিধা ও কোটার সুপারিশ করা হলো। ইউনিফর্ম ফ্যামিলিকোড, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রশ্নে তাদের নিজস্বতার রিজার্ভেশন থাকল।
কিন্তু ৯২ ভাগ মুসলিমের পরিবার, ধর্ম ও সংস্কৃতি কোটার কুঠারে মারাত্মক আহত হলো। মন্ত্রণালয়, আমলাতন্ত্র, স্থানীয় প্রতিনিধিত্ব, স্থানীয় সরকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অর্থনীতি, শিক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতিসহ সব ক্ষেত্র ও সেক্টরে নারীদের জন্য অর্ধেক, এক-তৃতীয়াংশ রিজার্ভেশন ও কোটা ঢুকানো হলো। যৌনকর্মী, বীরাঙ্গনা, এমনকি নারী সংগঠনের জন্য নানারূপ নতুন কোটার সুপারিশ দেখতে পেল জাতি। নারী কমিশন নিজেও এনজিও কোটাধীন। আবার ঐকমত্যের সংলাপের ক্ষেত্রেও দেখা গেল জাতীয় সংসদে পুরুষ-নারীর মুক্ত প্রতিযোগিতার নির্বাচনের সঙ্গে আরো ১০০ নারী কোটাকে পুরুষরাই দয়ার দান আর ঔদার্য হিসেবে কোটার বেড়াজালে আটকাচ্ছে। এটা মোটেও নারী অধিকার নয়; সাম্য, সমতা ও নারীর যথার্থ প্রতিনিধিত্ব ও সম্মানও নয়। এটা নিছক অলংকার দিয়ে দল ভারী করার বিবেচনামাত্র। জুলাইকন্যারা কেনই-বা এই কোটা প্রত্যাখ্যান করছেন না, তা বুঝি না।
জুলাই বিপ্লবের পর সংকীর্ণতার মানস অত্যন্ত লজ্জাজনক। ৩৬ দিনের উজ্জ্বলতম আন্দোলনে মেয়েরা উচ্চারণ করতে পেরেছিল—‘নারী যেখানে অনন্যা/ কোটা সেখানে অবমাননা।’ মেয়েরা সারা দেশে উচ্চারণ করতে পেরেছিল, সরকারি চাকরিসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে বৈষম্যেও বিষ তথা কোটা এবং এমনকি নারী কোটাও তারা প্রত্যাখ্যান করছে। সেখানে কীভাবে এনজিও কোটায় ঠাঁসা নারী কমিশন সব ক্ষেত্রে নারী কোটা চাপিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করতে পারল? ৩১৩ পৃষ্ঠাব্যাপী অন্য বিধ্বংসী বিষয়াদি সরিয়ে রাখলেও কীভাবে নারী কোটা, অন্যান্য লিঙ্গ কোটা, সব লিঙ্গ কোটাসহ সর্বত্র কোটাময় সুপারিশ দেওয়া সম্ভব হলো? এর একমাত্র কারণ এদের কষ্ট, ত্যাগ ও যন্ত্রণা নেই, এদের আছে এজেন্ডা। জুলাই বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, বাস্তববোধ, কল্যাণচিন্তা এবং কোটাবিহীন, বৈষম্যমুক্ত, স্বাধীন, সম-অধিকারপূর্ণ ও সাম্যের বাংলাদেশের ড্রিম-টেক্সচার এদের অদ্ভুত অনার্জিত কর্তৃত্ব ফলানোর সঙ্গে চরম বিযুক্তি ও ফারাক তৈরি করেছে।
কোথায় আজ লাল জুলাই? কোথায় আজ নতুন জীবনের দিকে অভিযাত্রা? কোটার কবর ও বৈষম্যহীন সাম্য—এই বিষয় দুটি বহুকাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদে থাকবে তো? যেটা হবে আমাদের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, ন্যাশনাল চার্টার এবং নয়া রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক বন্দোবস্তের সর্বমৌল আইনি ভিত্তি? জুলাই বিপ্লবে যারা জান দিয়ে লড়েছে, ব্যাপক ত্যাগ স্বীকার করেছে, আহত হয়েছে, মামলায় ঝুলে শেষ হয়েছে, অন্ধ হয়েছে—তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই সেই আশ্চর্য আশাভরা, সেই ভয়ংকর ত্রাসের, সেই উত্তাল অভ্যুত্থানের দিনের উচ্চারণ—‘কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘কোটামুক্ত বাংলাদেশ চাই’, ‘মেধা শহীদের বিচার চাই’, ‘কোটা আমার অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে’, ‘ছাত্রদের হারার ইতিহাস নেই’, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ প্রভৃতি। সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ ও হাজারো আহত যোদ্ধারা আমাদের ক্ষমা করো। মিথ্যা বলেছিলাম, ‘আমরাই বাংলাদেশ।’ তোমরা মনে রেখো, কোটা আমাদের মজ্জাগত অসভ্য পরকীয়া। আর এর জন্যই আমরা তোমাদের ভুলে গেছি।
লেখক : প্রফেসর (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়