ওই সাক্ষাৎকারে তাঁকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার সংস্থায় আদালতের রায় নিয়ে মেয়র পদে বসা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি মনে করি, ওই নির্বাচনগুলোকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে এবং অ্যাকনলেজ (স্বীকৃতি দেওয়া) করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর এই নির্বাচনগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা এবং অবৈধ নির্বাচন থেকে কোনো প্রাপ্তিস্বীকার না করার সততাটা থাকা উচিত।’
এর আগে জাতীয় সংসদের একাধিক নির্বাচনেও পরাজিত প্রার্থী আদালতে মামলা করে পক্ষে রায় পেয়েছেন। অনেক বিলম্বে। কখনো সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, কখনো আবেদনকারী মারা যাওয়ার পর।
চট্টগ্রামের বিএনপির দলীয় প্রার্থী শাহাদাত হোসেন মেয়াদের আগে রায় পাওয়ায় শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু ইশরাকের বেলায় দলের সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। যদি দল শপথ নেওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়, তিনি সময় পাবেন আগামী ১৫ মে পর্যন্ত।
এ ঘটনায় আরেকটি কঠিন সত্য বেরিয়ে এল। নির্বাচনী অনিয়ম ও কারচুপির বিরুদ্ধে আদালতে যেসব মামলা হয়, সেগুলো ১৮০ দিন বা ছয় মাসের মধ্যেই রায় হওয়া উচিত। বছরের পর বছর এসব মামলা ঝুলে থাকলে আদালতের ন্যায়বিচারও বিচারপ্রার্থীর কোনো কাজে লাগে না।
আদালতের এই রায় ক্ষমতাসীনদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে, আশা করি। আদালত যখন কোনো প্রার্থীর পক্ষে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের দেওয়া রায় অবৈধ ঘোষণা করলেন, তখন সেই পদের বিপরীতে তিনি যে বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, সেটাও ফেরত দেওয়া উচিত। তাহলে ভবিষ্যতে কেউ এই পথে যেতে সাহস পাবেন না।
নির্বাচন সংস্কার কমিশন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে অনেকগুলো সুপারিশ করেছে। যেসব সুপারিশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকারও কার্যকর করতে পারে।
২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী হিসেবে মেয়র ঘোষণা করা হয়। এ-সংক্রান্ত নির্বাচন কমিশনের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে ২০২০ সালের ৩ মার্চ তাপস, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ আটজনকে বিবাদী করে নির্বাচন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন। ইশরাক প্রয়াত বিএনপি নেতা ও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। ওই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে গত ২৭ মার্চ রায় দেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল।
এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে রোববার তাঁকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে নয়জনকে বিবাদী করে মামলা করেন মেয়রপ্রার্থী নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তৎকালীন সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীকে অপসারণ করে গত ১৯ আগস্ট চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলামকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার।
শাহাদাত হোসেন, ইশরাক হোসেন এবং সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম
শাহাদাত হোসেন, ইশরাক হোসেন এবং সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমছবি: সংগৃহীত
গত ১ অক্টোবর শাহাদাত হোসেনের পক্ষে রায় দেন আদালত।
প্রকৃত ঘটনা হলো, তিনি প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিমের নানা অনিয়ম ও কারচুপির তথ্য–প্রমাণ দিয়ে প্রথমে নির্বাচনটি বাতিল করার আবেদন করেন। এরপর ২০২৪ সালের আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি সম্পূরক আরজিতে তাঁকে (শাহাদাত হোসেন) নির্বাচিত ঘোষণার আবেদন জানান।
আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, ইশরাক প্রথমে নির্বাচনী রায় বাতিলের আবেদন জানিয়েছিলেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও শাহাদাতকে চট্টগ্রামের মেয়র ঘোষণার পর তিনি আদালতে সংশোধনী আরজি জানান। সেখানে তাঁকে বিজয়ী ঘোষণার আবেদন করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির সেই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল মাত্র ২৯ শতাংশ, যা ছিল অবিশ্বাস্য।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের ২০২৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল চেয়ে ২৩ এপ্রিল আদালতে মামলার আবেদন করেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মেয়রপ্রার্থী ইকবাল হোসেন (তাপস)। সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।
সম্প্রতি আদালতে মামলার পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন তাদের প্রার্থঅ মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিজয়ী ঘোষণা করার দাবিতে আদালত প্রাঙ্গনে সমাবেশও করেছেন মামলার শুনানির দিন। দলের বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ফ্যাসিবাদী সরকার জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় নির্বাচনেও বারবার জালিয়াতি করেছে। এখন আবার সেই জালিয়াতির নির্বাচনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের মেয়র ঘোষণার জন্য আদালতে মামলা ও মাঠে আন্দোলন করছেন। আগামী ৫ মে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনী মামলার পরবর্তী শুনানি হওয়ার কথা।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কেন আদালতে যাচ্ছে না, জানতে চাইলে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘চট্টগ্রামের ঘটনার সময় এটা হয়েছে। তখন আমি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলাম না। এই যে রায়টা হলো, এ মামলায় কিন্তু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কোনো পক্ষ ছিল না, আমরা পক্ষভুক্ত ছিলাম না। সুতরাং অফিশিয়ালি এটার অপোজ করার সুযোগ আমাদের নেই।’
মন্ত্রণালয় পক্ষভুক্ত থাকুক বা না থাকুক সরকার যে কোনো মামলার বিষয়ে আপিল করতে পারে। আপিল না করলে ধরে নেওয়া হবে সরকার রায়ে সন্তুষ্টু। সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার বক্তব্যটি ব্যক্তিগত না সরকারের সেই প্রশ্নও উঠবে।
রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে শুক্রবার ইশরাক হোসেন বলেন, ভোটে তিনি হারেননি, তাঁকে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর আইন মেনে তিনি মামলা করেছিলেন। সেই মামলা তখন ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ পাঁচ বছর আইনি লড়াইয়ের পর তিনি এখন ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
ন্যায়বিচার পেয়েছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে নির্বাচনে আদালতের রায়ে ইশরাক মেয়র হলেন, সেটি কতটা ‘নির্বাচন’ হয়েছিল, সেই প্রশ্নও না উঠে পারে না। নির্বাচন কমিশন ২৯ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি দেখালেও প্রকৃত ভোটার উপস্থিতি ছিল অনেক কম।
এর আগে এক কলামে লিখেছিলাম, ‘ইশরাক ‘মেয়র’ হলেন, বিএনপি এখন কী করবে।’ তখনো নির্বাচন কমিশন গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তিনি বা বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই দেখার বিষয়। প্রশ্ন হলো, যেই নির্বাচনকে বিএনপি এতদিন অবৈধ ও কারচুপির নির্বাচন বলে আসছে,আদালতের রায় নিয়ে মেয়রের পদে বসে নেই নির্বাচনকেই জায়েজ করবেন কিনা।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি