হাতে প্রথম যে মুঠোফোনটি এসেছিল, সেটি ছিল একটি নকিয়া–১১০০। খুবই সাধারণ একটা ফোন। ফ্যান্সি কোনো অপশন ছিল না, না ছিল ইন্টারনেট, একটা ‘পিওর’বেসিক ফোন। কিন্তু একটি বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে, ফোনে যখন সিম কার্ড থাকত না, তখন স্ক্রিনে একটা মেসেজ দেখাত: ‘এসওএস কল অনলি।’ তখন খুব একটা বুঝতাম না, তবে সিম ছাড়া ইমার্জেন্সি কল করার একটা সুবিধা নিয়ে কিছু হবে একটা।
অনেক বছর পর, বিটিআরসিতে পোস্টিং হওয়ার পর এফসিসি মানে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনের একটা পুরোনো ডকুমেন্ট পেলাম। ১৯৯৮ সালের লেখা। এফসিসির সেই নীতিমালায় লেখা ছিল, ‘একটা দেশের নাগরিক হিসেবে আপনি যদি ব্যক্তিগত কোনো ইমার্জেন্সিতে পড়েন, রাস্তায় ছিনতাইয়ের শিকার হন, বিল্ডিংয়ের নিচে আটকে যান, বাসায় আগুন লাগে, কিংবা হঠাৎ বুকে ব্যথা শুরু হয়, তখন আপনি রাষ্ট্রের কাছে কীভাবে সাহায্য চাইবেন?’
উত্তরে বলা হয়েছিল, ‘আপনার হাতে থাকা মুঠোফোন/ফিক্সড ফোনে সিম থাকুক বা না–থাকুক, ব্যালান্স থাকুক বা না–থাকুক, ইমার্জেন্সি নম্বরে আপনি যাতে কল করতে পারেন। সর্বোপরি, এই সুযোগটা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।’
তবে শুধু ফোন করার সুযোগ দিলেই তো হবে না, অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ ভয়ে বা দুর্ঘটনায় কিছু বলতেই পারে না। সেই ভাবনা থেকে তৈরি হলো ‘অ্যাডভান্সড মোবাইল লোকেশন’ বা মুঠোফোনভিত্তিক ‘এএমএল’ সার্ভিস। বিপদে আপনি শুধু ফোনটা ঝাঁকালেন বা প্রেস করলেন পাওয়ার বাটন কয়েকবার, সঙ্গে সঙ্গে আপনার লোকেশন তথ্য চলে যাবে ইমার্জেন্সি কল সেন্টারে।
কেউ কথা না বললেও রেসপন্স টিম জানে এই লোকেশনেই কেউ বিপদে আছে। সেই পার্সপেকটিভ থেকে নকিয়া, অ্যান্ড্রয়েড/গুগল বা অ্যাপলকেও বাধ্য করা হয়েছিল প্রযুক্তি দিতে। উবার, গুগল ম্যাপ যদি আপনার প্রিসিশন লোকেশন জানে, আপনার প্রয়োজনে রাষ্ট্র কেন জানবে না?
এ ছাড়া যদি ৯৯৯–এ কল করে যদি ৫ মিনিট ধরে আমাদের বোঝাতে হয়, আমি কোন গলির কোন পানির ট্যাংকের নিচে, তাহলে তো সেটা আর ইমার্জেন্সি কল থাকল না। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের ঠিকানা এতটাই ঝামেলার, যে মুখে ঠিকানা বললেও সেখানে ইমার্জেন্সি ডেসপ্যাচ রাইডার পৌঁছাতে পৌঁছাতেই ইমার্জেন্সি বারোটা বেজে যাবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো মানুষকে নিয়ে আগে ভাবা, তারপরে প্রযুক্তি। কারণ, প্রযুক্তি কোনো ম্যাজিক নয়, ওটা একটা টুলমাত্র। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যদি মানবিক না হয়, তাহলে টুল যত শক্তিশালীই হোক, সেটা অকার্যকর হয়ে যায়।
আরেকটা উদাহরণ দিই। ধরুন, ঢাকায় ভূমিকম্প হয়েছে। পাঁচটা বড় বিল্ডিং ভেঙে পড়েছে। আপনি একজন নাগরিক হিসেবে ইমার্জেন্সি বাটন চেপে যদি শুধু জানাতে পারেন, আপনি জীবিত আছেন অথবা আটকে পড়েছেন কোন ফ্লোরে (সেটা প্রযুক্তিই বলবে), তাহলে রেসকিউ কাজ কত সহজ হয়ে যায়! আমি এটা বলছি কারণ, এগুলো নিয়েই অনেক কাজ করেছি।
এই প্রযুক্তির সংমিশ্রণের জায়গাটাতেই আসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গুরুত্ব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই যদি ঠিকভাবে ডিজাইন করা হয়, তাহলে রাষ্ট্র মানুষের কথার অপেক্ষা না করেই, তার বিপদের সংকেত বোঝে, আগেই ব্যবস্থা নিতে পারে। সেটা হতে পারে একটা সিম্পল অ্যালগরিদম, কিংবা একটা জটিল ডিসিশন-মেকিং সিস্টেম। আসল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে মানুষ নয়, মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্র।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো মানুষকে নিয়ে আগে ভাবা, তারপরে প্রযুক্তি। কারণ, প্রযুক্তি কোনো ম্যাজিক নয়, ওটা একটা টুলমাত্র। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য যদি মানবিক না হয়, তাহলে টুল যত শক্তিশালীই হোক, সেটা অকার্যকর হয়ে যায়। এই জন্যেই আমার মনে হয়, আমাদের দরকার একটা নতুন জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি—‘কীভাবে রাষ্ট্রকে আরও মানবিক করা যায় প্রযুক্তির সাহায্যে?’
রকিবুল হাসান টেলিকম, অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক এবং লিংক-থ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার
সূত্র, প্রথম আলো