ভারত ভাগের সময় ব্রিটিশ ভাইসরয় ছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত নির্ধারণের দায়িত্ব পান ব্রিটিশ আইনজীবী সিরিল জন র‌্যাডক্লিফ। তিনি মাউন্টব্যাটেনের কাছের লোক ছিলেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ৮ জুলাই ভারতবর্ষে প্রথম পদার্পণ করেন। ভারতের ভাষা, সংস্কৃতি, পথঘাট ও মানুষজন সম্পর্কে তার কোনো পূর্বধারণা ছিল না। মাউন্টব্যাটেন ভারত ও পাকিস্তানকে বিভাজনের জন্য র‌্যাডক্লিফকে যে মানচিত্র সরবরাহ করেছিলেন, তা ছিল শতবর্ষের পুরোনো এবং ভুলে ভরা আদমশুমারি। তাকে সময় দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৩৫ দিন। তাকে সাহায্য করার জন্য যাদের দেওয়া হয়েছিল, তারা পরস্পরবিরোধী তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেন। এর ফলে নতুন একটি অজানা-অচেনা দেশে এসে সঠিক তথ্য ও পর্যাপ্ত সময় না পেয়ে তিনি দুদেশের মধ্যে যে সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন, তা ছিল চরম বৈষম্যমূলক, যা উপমহাদেশের দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে অদ্যাবধি চরম উত্তেজনার মূল কারণ।

পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর দুদেশের মানুষেরা যখন আনন্দে আত্মহারা, তখনো তারা জানত না কোন দেশের মানুষ র‌্যাডক্লিফ লাইনে পড়েছে। র‌্যাডক্লিফ মানচিত্র ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট যখন জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়, তখন সবাই চিন্তিত ও মর্মাহত হয়ে পড়ে, অনেকে হয় বিস্মিত। এ অবস্থায় র‌্যাডক্লিফ লাইন অতিক্রম করে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নতুন দেশের নতুন ঠিকানার খোঁজে পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পাড়ি জমাতে শুরু করে। দেশভাগের একপর্যায়ে রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ল কোটি কোটি মানুষ। এ সময় কেউ পাকিস্তান থেকে ভারতে, আবার কেউ ভারত থেকে পাকিস্তানে অজানা উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। ধর্মীয় সহিংসতায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষ।

স্বপ্নের খাঁচায় বন্দি জুলাই বিপ্লবস্বপ্নের খাঁচায় বন্দি জুলাই বিপ্লব

ভারত বিভক্ত ও স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে একটি আইন তৈরি করা হয়েছিল, তার নাম ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স অ্যাক্ট, ১৯৪৭’। এ আইনে দেশীয় রাজ্যগুলোকে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তারা ভারতের সঙ্গে থাকতে পারে, অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, অথবা তারা স্বাধীন রাজ্য হিসেবে থাকতে পারে। ভারতবর্ষে তখন ৫৬৫ জন রাজা ছিলেন। নেহেরু ও প্যাটেল ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে কঠোর ভাষায় জানিয়ে দিলেন, যেসব রাষ্ট্র স্বাধীন হিসেবে থেকে যেতে চায়, তাদের কোনো নিজস্ব সেনাবাহিনী থাকবে না এবং ভারত তাদের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করবে। এর ফলে রাজ্য সরকারগুলো ভয় পেয়ে যায়।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। তিনিও বললেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকাটা খুবই বিপজ্জনক। এ রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করার পর তিনটি রাজ্য ব্যতিরেকে ৫৬২টি রাজ্য তাদের পছন্দমতো পাকিস্তান অথবা ভারতের সঙ্গে মিশে গেল। বাকি থাকল জুনাগড়, হায়দরাবাদ ও কাশ্মীর। প্রথম সমস্যা সৃষ্টি হলো জুনাগড় রাজ্য নিয়ে। এই রাজ্যের শাসক ছিলেন মুসলিম, যার জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ হিন্দু। শাসক পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হস্তক্ষেপে ও মধ্যস্থতায় ঠিক করা হলো জুনাগড়ের জনগণ কোন দেশের সঙ্গে থাকতে চায়, তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত হবে। এর ফলে প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ ভারতের সঙ্গে থাকার পক্ষে মত দিল। আর হায়দরাবাদ হলো মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। শাসক ছিলেন নিজামউল মুলক। তাকে অনেক ভয়ভীতি দেখিয়ে যখন ভারত সরকার বসে আনতে পারল না, তখন ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভোর ৪টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দরাবাদ আক্রমণ করে। চার দিনের যুদ্ধে ভারত জয়ী হয়ে হায়দরাবাদকে তাদের দেশের সঙ্গে যুক্ত করে নেয়।

কাশ্মীরে রাজা ছিলেন হরি সিং। ১৯৪৭ সালে ছয় দিনের সফরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে শ্রীনগরে গিয়েছিলেন। সেখানে তার সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, সেটা আজ অবধি অজানা। জুনাগড়ের মতো কাশ্মীরের জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য তিনি গণভোটের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেটা করতে তিনি সমর্থ হননি। অথচ কাশ্মীরের মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে পাঞ্জাবে দাঙ্গার প্রভাব পড়ে কাশ্মীরে। পাকিস্তানের মিলিশিয়া বাহিনী কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। ১৯৪৭ সালে অক্টোবর মাসে নেহেরুর নির্দেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। অবস্থা যখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যখন তার নাগালের বাইরে, তখন রাজা হরি সিং ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ভারত হরি সিংকে বলল, আগে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। কোনো উপায়ান্তর না দেখে রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৯ সালের পহেলা জানুয়ারি। পাকিস্তান কাশ্মীরের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে এবং ভারত দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে রাখল, যেখানে সম্পূর্ণ কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশে থাকার কথা ছিল, তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হলো। কাশ্মীর মূলত তিন ভাগে বিভক্ত। ভারতের হাতে রয়েছে জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ। পাকিস্তানের হাতে রয়েছে আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত বালতিস্থান, আর চীনের হাতে রয়েছে আকসাই চীন অঞ্চল, যা নিয়ে বহুদিন ধরে চলছে উত্তেজনা ও বিরোধ।

মাউন্টব্যাটেনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এ জনপদ ক্রমান্বয়ে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। র‌্যাডক্লিফ মাউন্টব্যাটেনের দেওয়া সম্মানী গ্রহণ না করলেও ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইট উপাধি গ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু তিনি ছিলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং খুবই ক্ষতবিক্ষত। অপর্যাপ্ত সময়, ভুলে ভরা তথ্য, শতবর্ষের পুরোনো মানচিত্র এবং দেশ বিভাজনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে জাতিগত দাঙ্গা, লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি এবং কোটি কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনা সবসময় তার বিবেককে দংশন করত। তাই তিনি বলেছিলেন, দু-তিন বছর সময় পেলে আমি গবেষণা করে কাজটা ভালোভাবে করতে পারতাম। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতবর্ষের লোকেরা তাকে সবসময় ঘৃণার চোখে দেখবে। এটা ভেবে তিনি ভারত বিভাজনের সব গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছিলেন।

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ঢাকা

সূত্র, আমার দেশ