মিয়ানমারের রেয়ার আর্থ মেটাল বা দুষ্প্রাপ্য খনিজসম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার টার্গেট নিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ জন্য দেশটির সামরিক জান্তা সরকারের মিত্র ও সহযোগীদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। ২৫ জুলাই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনরত গণতন্ত্রপন্থিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বাইডেন প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এখন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও লবিস্ট গ্রুপগুলো মিয়ানমারের বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রভাবিত করেছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প মিয়ানমারকে কার্যত চীনের হাতে তুলে দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট দেশটির জন্য আরেকটি বিজয় এনে দিলেন।
নীতিনৈতিকতার দিক থেকে দেখতে গেলে মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্ত দুঃখজনক, তবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ ট্রাম্প রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ইউক্রেনকে ইতোমধ্যেই পরিত্যাগ করেছেন। গাজায় গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূলে ইসরাইলকে সবুজসংকেত দিয়েছেন। এমনকি আমেরিকান গণতন্ত্রের সামান্য যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাও কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। কিন্তু এটাকে শুধু একটি নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখলে হবে না, বরং সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এটি একটি কৌশলগত গুরুতর ভুল পদক্ষেপ।
মিয়ানমারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে এই পরিবর্তন আনার পেছনে কী যুক্তি আছে, তা এখনো অস্পষ্ট। কারণ ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি এখনো। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সময়টি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক। মাত্র কয়েক দিন আগেই আমেরিকান কংগ্রেসে দুই দলের সমর্থনেই মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনটি বিল পাস করা হয়েছে। এসব বিলে গণতন্ত্রপন্থিদের সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন এবং জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করা হয়।
মিয়ানমার ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য আলোচনার সময় জান্তা সরকারের প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি যে ব্যক্তিগত চাটুকারিতা ও আত্মকেন্দ্রিকতার ওপর ভর করে নির্ধারিত এবং পরিচালিত হচ্ছে, তার একটি বড় উদাহরণ মিয়ানমারের এ ঘটনা।
তবে অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মিত্রদের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক হিসাবনিকাশ রয়েছে। মার্কিন ব্যবসায়ীদের লবি ট্রাম্পকে সম্ভবত এটাই বুঝিয়েছে, মিয়ানমারের দুষ্প্রাপ্য বা বিরল খনিজ ধাতু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে মিসাইল প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়। এ জন্য মিয়ানমারের বিরল খনিজ ধাতুগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কৌশলগত সম্পদ হতে পারে।
বিশ্বে এ ধরনের বিরল খনিজ ধাতু সরবরাহে প্রায় শীর্ষস্থানেই আছে মিয়ানমার। বিশেষ করে চীন তার পরিবেশগত দিক থেকে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী খনিজসম্পদ অনুসন্ধান কার্যক্রম কমিয়ে দেওয়ার পর এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব বেড়েছে মিয়ানমারের। চীনের এই ঘাটতি পূরণে মিয়ানমার বিশ্বে এখন বিরল খনিজসম্পদের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। আর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী লবিকে উৎসাহিত করেছে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করতে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিরল খনিজসম্পদের খনিগুলো জান্তা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। চীন সীমান্তের কাছে অবস্থিত এসব খনি নিয়ন্ত্রণ করে জান্তা সরকারের বিরোধী বিভিন্ন আঞ্চলিক জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ। এসব সংগঠনের একটি হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম পুরোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ)। সংগঠনটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিরল খনিজসম্পদের খনির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে গত বছর।
আর এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রেরও নজরে রয়েছে। দেশটির কয়েকটি লবিস্ট গ্রুপ মিয়ানমারের এই সম্পদ হস্তগত করতে দুটি প্রস্তাব সামনে এনেছে। একটি হচ্ছে—এই খনিজসম্পদ সংগ্রহে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কেআইওর সঙ্গে কাজ করবে। দ্বিতীয়টি প্রস্তাবটি হচ্ছে—জান্তা সরকার ও কেআইএর মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরে মধ্যস্থতা করবে যুক্তরাষ্ট্র যাতে, দুপক্ষই যৌথভাবে এই খনিজসম্পদ উত্তোলন করতে পারে।
তবে লবিস্টদের প্রথম প্রস্তাবটি লজিস্টিক দিক থেকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ ভারত ও চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তের দুর্গম এলাকার কাছে অবস্থিত কাচিন রাজ্য ভূমিবেষ্টিত এবং এর চারদিকে জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকা। এসব এলাকাতেও বিভিন্ন জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী তৎপর রয়েছে, যাদের সঙ্গে জান্তা সেনাদের লড়াই চলছে অনেক দিন ধরে।
লবিস্টদের দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আরো বেশি বিভ্রান্তিপূর্ণ। কারণ ওয়াশিংটন ডিসির এই ব্যবসায়ী লবিস্টরা কয়েক দশকের পুরোনো একটি রাজনৈতিক আন্দোলনকে নিছকই তাদের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। এর মাধ্যমে তারা এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেআইও যদি বিরল খনিজসম্পদ বিক্রি করে লাভবানই হতে চাইত, তাহলে তারা অনেক আগেই চীনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে জান্তা সরকারের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তি করত। কিন্তু তারা তা করেনি। কারণ বাণিজ্যিক স্বার্থ হাসিল তাদের লক্ষ্য নয়, তাদের লক্ষ্য পুরোপুরিই রাজনৈতিক অধিকার আদায় করা।
কাচিন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের জন্য দশকের পর দশক ধরে লড়াই করছে কেআইএ। সংগঠনটি সারা দেশে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রতিও সমর্থন দিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার ঝুঁকি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় জান্তা সরকারের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করবে না কেআইএ। বরং চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করাই তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
মিয়ানমারের আরেক শক্তিশালী গেরিলা সংগঠন ওয়া স্টেট আর্মি বার্মা (মিয়ানমার) কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। ওয়া রাজ্যে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়ও সম্প্রতি বিরল খনিজসম্পদের উত্তোলন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এই সংগঠনটির প্রতিও সমর্থন রয়েছে চীনের। সামগ্রিক এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের বিরল খনিজসম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চিন্তা শুধু অযৌক্তিক নয়, অবিবেচনাপ্রসূতও। যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ বরং মিয়ানমারকে পুরোপুরিই চীনের হাতে তুলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।
শুধু মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর নয়, বিভিন্ন বিদ্রোহী সংগঠনসহ পুরো মিয়ানমারের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে চীনের। ট্রাম্প প্রশাসন চলতি বছরের শুরুর দিকে মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের সহায়তার পরিমাণ সারা বিশ্বেই কাটছাঁট করেছে। এই তালিকায় রয়েছে মিয়ানমারও। এখন জান্তা সরকারের মিত্রদের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মিয়ানমারের রাজনীতিকে আরো বেশি চীনমুখী এবং দেশটির ওপর চীনের আধিপত্যকে আরো পাকাপোক্ত করার ঝুঁকি তৈরি করবে।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে মিয়ানমার জান্তা যে স্বাগত জানাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা এটাকে তাদের আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার একটি অজুহাত হিসেবে দেশ-বিদেশে ব্যবহার করবে। কিন্তু তারা কখনোই চীনের সঙ্গ ছাড়বে না। কারণ চীন হচ্ছে জান্তা সরকারের সমরাস্ত্র, আর্থিক সহায়তা ও কূটনৈতিক সমর্থনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
অন্যদিকে, মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর তৎপরতা এখন অনেকটাই স্তিমিত। কারণ, জো বাইডেন ক্ষমতায় থাকতে জান্তা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং সশস্ত্র গ্রুপগুলোকে সহায়তা দিতে বার্মা অ্যাক্ট নামে যে আইন পাস করা হয়েছিল, তার আওতায় তেমন কোনো সহায়তা পায়নি কোনো সংগঠন। বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সহায়তার প্রতিশ্রুতি শুধু মিয়ানমারের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্যেই সীমিত ছিল।
ফলে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো এখন আর পশ্চিমাদের বিশ্বাস করে না। উপরন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের এই বিশ্বাসঘাতকতা মিয়ানমারের প্রায় অর্ধেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে আরো বেশি চীন-ঘনিষ্ঠ করে তুলবে। ওয়া স্টেট আর্মি আগে থেকেই চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আমি ছিল অনেকটাই পশ্চিমা বিশ্বমুখী। কিন্তু এখন তারাও চীনের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হবে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত মিয়ানমারে অং সান সু চির দল এনএলডিসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কণ্ঠকে দুর্বল ও চীনের প্রভাবকে শক্তিশালী করবে।
এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর: মোতালেব জামালী