বিজ্ঞান যতই এগিয়ে যাচ্ছে, নতুন নতুন গবেষণায় প্রমাণিত হচ্ছে, রাসুল (স.)-এর জীবনাচরণের মধ্যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক গবেষণালব্ধ তথ্য নিহিত রয়েছে। এ ব্যাপারে কিছু বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করছি।
খাদ্যাভ্যাস : রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষ যেসব পাত্র ভরাট করে, সেগুলোর মধ্যে পাকস্থলীর চেয়ে খারাপ কোনো পাত্র নেই। আদম সন্তানের কয়েক লোকমা খাবারই যথেষ্ট তার শক্তি অর্জনের জন্য। তা করতে সে তিন ভাগের এক ভাগ খাবার, এক ভাগ পানি এবং এক ভাগ বাতাস দিয়ে পূর্ণ করতে পারে (তিরমিজি ২৩৮০)। এ ব্যাপারে একটি বড় গবেষণা হয়েছে। একদল ইঁদুরকে বেশ কিছুদিন কম খাবার দেওয়া হয় এবং অন্যদলকে স্বাভাবিক খাবার দেওয়া হয়। দেখা গেল, কম খাবারে অভ্যস্ত ইঁদুরদের বেশ কয়েকটি রোগ কম হয়েছে।
রাসুল (সা.)-এর হাদিস অনুযায়ী, খাবার ও পানির পরিমাণ সমান। মানুষ আমিষ, চর্বি ও শর্করা ছাড়া বেশ কিছুদিন বাঁচতে পারে, কিন্তু পানি ছাড়া কয়েক দিনও বাঁচতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে তিন বেলা আহার করা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রাসুল (সা.) সারা দিনে দুবেলা খাবার গ্রহণ করতেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিনবার খাওয়ার চেয়ে দুবার খাওয়া বেশি স্বাস্থ্যসম্মত।
রোজা : রাসুল (সা.) বলেছেন, রোজা রাখো এবং সুস্থ থাকো। রাসুল (সা.) রমজান মাসের বাইরে নিয়মিত রোজা রাখতেন। গবেষণায় দেখা গেছে, রোজা রাখার ফলে উচ্চ রক্তচাপ কমে আসে। রক্তে অতিরিক্ত চর্বি ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। রোজা রাখার কারণে কোষের ভেতরের দুর্বল, অস্বাভাবিক আমিষ ও অন্যান্য বস্তু Autophagy-এর মাধ্যমে ধ্বংস হয়। এ আবিষ্কারের জন্য জাপানি একজন বিজ্ঞানী ২০১৬ সালে নোবেল প্রাইজ পান।
ঘুম : রাসুল (সা.) সাধারণত মাগরিবের নামাজের আগে বা পরে রাতের খাবার খেতেন এবং এশার নামাজের পর ঘুমিয়ে যেতেন। মাঝরাতে তাহাজ্জুতের নামাজের জন্য উঠতেন, আবার ঘুম এলে ঘুমাতেন। অপরাহ্ণে হালকা ঘুমাতেন (কায়লুল্লাহ)। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন একজন মানুষের পাঁচ-সাত ঘণ্টা ঘুমের প্রয়োজন এবং ভালো নিদ্রার (quality sleep) জন্য ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খাওয়া উচিত, যা রাসুল (সা.)-এর জীবনাচারে দেখতে পাওয়া যায়। সুইজারল্যান্ডের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের কায়লুল্লাহর অভ্যাস আছে, তাদের হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে যায়।
ঘুমের অভাবে নানারকম রোগ হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অনিদ্রাজনিত কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা : একসময় খ্রিষ্টান জগতে গোসল না করে ময়লা কাপড় পরে অপরিষ্কার থাকাকে এবং ঘরবাড়ি অপরিষ্কার রাখাকে আধ্যাত্মিকতার মাপকাঠি মনে করা হতো। যেমন ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই জীবনে কখনো গোসল করেননি। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল আধ্যাত্মিকতার এ ভ্রান্ত ধারণা বদলে দিলেন।
‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নামাযের জন্য উঠবে, তখন তোমরা নিজেদের মুখমণ্ডল এবং কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত করবে, মাথার ওপর হাত ঘোরাবে এবং পা গোড়ালি পর্যন্ত ধৌত করবে। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তাহলে ভালোভাবে পবিত্র হও (গোসল করো)। (আল কোরআন ৫৪৬)
রাসুল (সা.) সাধারণত প্রত্যেক নামাজের আগে অজু করতেন। তিনি নানা উপলক্ষে অজু ও গোসলের নির্দেশ দিয়েছেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে উৎসাহিত করেছেন। এভাবে বিভিন্ন রকমে রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। মধ্যযুগে ইউরোপে ঘরে-বাইরে আবর্জনার স্তূপ জমে যেত। তাতে ইঁদুরের উপদ্রব বেড়ে যেত এবং প্লেগ রোগে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করত।
স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা : মধ্যযুগে খ্রিষ্টান জগতে চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। জনসাধারণ অসুস্থ হলে চার্চের পাদ্রি তাদের জন্য শুধু প্রার্থনা করতেন, অথবা মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকতেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার চিকিৎসার ব্যবস্থা তিনি করেননি। (বুখারি ৫৬৭৮)
এই হাদিসটি ডাক্তার ও রোগীর মনে অনেক আশা সঞ্চার করে। একজন বেদুইন রাসুল (সা.)-এর কাছে জানতে চাইল, অসুস্থ হলে সে চিকিৎসা নেবে নাকি তকদিরের ওপর ভরসা করে বসে থাকবে। তিনি তাকে চিকিৎসা নিতে বললেন। একবার দুজন ডাক্তার এলেন চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য। রাসুল (সা.) জানতে চাইলেন, তাদের মধ্যে ভালো কে? (মুয়াত্তা মালিক ১৭৫৬) রাসুল (সা.)-এর এসব দিকনির্দেশনার কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞান পরবর্তী সময়ে দ্রুত বিকাশ লাভ করে।
হাস্যকৌতুক : রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমার ভাইকে হাসি উপহার দেওয়াও একটি সাদাকা (তিরমিজি ১৯৫৬)। রাসুল (সা.) মাঝে মাঝে হাস্যকৌতুক করতেন। গবেষণায় দেখা গেছে, হাসির কারণে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করে, ফলে স্ট্রেস হরমোন কমে যায়, মানসিক চাপ কমে যায়, এমনকি শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নরওয়েতে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাসি-খুশিতে থাকা রোগীরা বিষাদাচ্ছন্ন রোগীদের চেয়ে দীর্ঘজীবন লাভ করে থাকে।
মানসিক সুস্থতা : স্বাস্থ্যের অন্যতম উপাদান মানসিক সুস্থতা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোনো ভালো সমাধান নেই। রাসুল (সা.) এ ব্যাপারে সুন্দর সমাধান দিয়েছেন। ঈমান, আখিরাত ও ভাগ্যের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস, ধৈর্য ধারণ, মহান আল্লাহর ওপর ভরসা, রোগের কারণে পুরস্কার, পরকালকে সাফল্যের মাপকাঠি ধরা প্রভৃতির মাধ্যমে রাসুল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন কীভাবে মানসিক প্রশান্তি অর্জন করতে হয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, মুমিনের ব্যাপারটি বড় অদ্ভুত। আল্লাহ তার জন্য যে ফয়সালাই করুন না কেন, তা সর্বাবস্থায় তার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। বিপদে-আপদে সে ধৈর্য অবলম্বন করে। এটা তার জন্য কল্যাণকর। সুখ-শান্তি ও সচ্ছলতা এলে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এটাও তার জন্য কল্যাণকর। মুমিন ছাড়া আর কারো ভাগ্যেই এমন হয় না। (বুখারি ২৯৯৯)
রাগ : রাসুল (সা.) বলেছেন, কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে জয়লাভ করাতে কোনো কৃতিত্ব নেই। ক্রোধ আর গোস্বার মুহূর্তে নিজেকে সংবরণ করতে পারাই প্রকৃত বীরত্বের পরিচয়। (বুখারি ৬১১৪)। ক্রোধের কারণে হৃৎস্পন্দন ও রক্তের চাপ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্রোধের পরবর্তী দুই ঘণ্টায় হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা পাঁচগুণ বেড়ে যায় এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা তিনগুণ বেড়ে যায়।
সামাজিক কল্যাণ : স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার একটি অংশ হচ্ছে সামাজিক কল্যাণ। গবেষণায় দেখা গেছে, সমাজে বিত্তবানদের চেয়ে দরিদ্রদের মধ্যে মৃত্যুর হার বেশি। কারণ হচ্ছে, চিকিৎসার ব্যয় বহনে অপারগতা। রাসুল (সা.) কল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে দারিদ্র্য বিমোচনের নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা উন্নত রাষ্ট্রগুলো গ্রহণ করেছে। ICDDRB-এর গবেষণায় দেখা গেছে, চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে আমাদের দেশে প্রতিবছর ৩০-৪০ লাখ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ মুসলিম দেশে তাদের নাগরিকদের চিকিৎসা ব্যয়ভার ১০০ শতাংশ সরকার বহন করে থাকে। রাসুল (সা.) বলেছেন, বিধবা ও গরিব-মিসকিনদের সাহায্যকারী আল্লাহর পথে জিহাদকারীর সমতুল্য। (বুখারি ৫৩৫৩, মুসলিম ২৯৮২)
খাদ্যে ভেজাল ও ধোঁকা দেওয়া : রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমাদের ওপর অস্ত্র উত্তোলন করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যে আমাদের ধোঁকা দেয় সেও আমাদের লোক নয়। (মুসলিম ১০১)
তিনি আরো বলেছেন, সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে থাকবে। (তিরমিজি ১২০৯)
বিভিন্ন সময় পরীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে ৭০ শতাংশ খাবারে বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশানো হয়। যেমন জিলাপিতে পোড়া মবিল, চাল এবং মুড়িতে ইউরিয়া সার, মাছ ও খেজুরে ফরমালিন ইত্যাদি। এতে পেপটিক আলসার, ক্যানসার, লিভার ও কিডনি রোগ, স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা, রক্তে সমস্যা ইত্যাদি বেড়ে যাচ্ছে। আমরা মুসলিম হয়ে রাসুল (সা.)-কে অনুসরণ করছি না। অথচ অমুসলিমরা উন্নত দেশগুলোয় জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে রাসুল (সা.)-এর খাদ্যনীতি কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করে থাকে।