১. অর্থের ঐতিহাসিক বিবর্তন অর্থ মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর একটি অথচ এর পূর্ণ ইতিহাস আমরা খুব কমই জানি। সাধারণ ধারণা হলোÑঅর্থ বার্টার ব্যবস্থার পরবর্তী ধাপ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে উদ্ভূত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বার্টার খুব কম এবং অদক্ষ ছিল। নৃ-তত্ত্ববিদ ডেভিড গ্র্যাবারের বই ‘Debt : The First 5000 Years’ অনুযায়ী, প্রাচীন সমাজগুলো মূলত ঋণ ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে চলত। গ্রামের মানুষজন, কে কাকে কী দিল, তা অনানুষ্ঠানিকভাবে মনে রাখত। অনেক সময় কোনো প্রত্যক্ষ পুনঃপ্রদানের আশাও থাকত না। প্রথম দিককার আর্থিক ব্যবস্থা ছিল টালি স্টিক, মাটির ফলক বা চিহ্নিত ঋণলিপি, কয়েন বা কাগজের টাকা নয়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়ার মন্দিরগুলো শস্য ও পশুর দেনা-পাওনার হিসাব রাখত। রাষ্ট্র কর্তৃক প্রচলিত মুদ্রা (কয়েন) প্রথম দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে লিডিয়ায় (বর্তমান তুরস্ক), যা ছিল মান ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে প্রচলিত প্রথম অর্থ। তবে সেই কয়েনগুলো ধাতব মূল্যবাহী ছিল। পরে চীনের তাং ও সং রাজবংশে এবং ইউরোপে প্রোমিসরি নোট ও ব্যাংক বিলের মাধ্যমে কাগজের মুদ্রা চালু হয়। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন স্বর্ণ মানদণ্ড (gold standard) ত্যাগ করে, তখন থেকেই আধুনিক সব মুদ্রা হয়ে ওঠে ‘ফিয়াট মানি’—সরকারি আদেশে চালু, কিন্তু কোনো বাস্তব সম্পদের ওপর নির্ভরশীল নয়। ২. অর্থ কী? মূলত অর্থ হলো বিনিময়ের মাধ্যম, পরিমাপের একক, বিলম্বিত পরিশোধের মানদণ্ড এবং মূল্য সংরক্ষণের উপায়। কিন্তু আধুনিক দুনিয়ায় অর্থ শুধু বস্তু নয়, এটি একটি সম্পর্ক—একটি প্রতিশ্রুতি—একটি ব্যবস্থা। এটি শুধু কয়েন বা নোট নয়, বরং ডিজিটাল স্ক্রিনে লেখা সংখ্যা, ব্যাংক ব্যালান্স, ঋণ লাইন এবং সরকারি বন্ড। আজকের অর্থের পেছনে নেই কোনো বাস্তব সম্পদ। এর মূল্য নির্ভর করে বিশ্বাসের ওপর—বিশ্বাস যে অন্যরা এটা গ্রহণ করবে পণ্য ও সেবার বিনিময়ে। এই বিশ্বাস গড়ে দেয় রাষ্ট্র এবং তা আইন দ্বারা সুরক্ষিত থাকে, যার ফলে অর্থ হয় ‘আইনানুগ টেন্ডার’। ৩. অর্থ একটি সরকারি ঋণ আজকের অর্থনীতি চলমান থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের মাধ্যমে। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক (যেমন : ফেডারেল রিজার্ভ বা ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক) অর্থ তৈরি করে, তখন সেটি মূলত সরকারি বন্ড কিনে বা ব্যাংককে ঋণ দিয়ে অর্থ প্রবাহিত করে। এই অর্থ তাদের হিসাবের খাতায় একটি দায় হিসেবে লেখা হয়—এটি মূলত একটি সরকারি ঋণ। অর্থাৎ, আধুনিক অর্থ তৈরি হয় রাষ্ট্রের দ্বারা এবং এটি একটি জনমাধ্যমিক দায়িত্বের প্রতীক। যেমন : যখন মার্কিন সরকার ট্রেজারি বন্ড ইস্যু করে এবং ফেডারেল রিজার্ভ তা কেনে, তখন অর্থনীতিতে অর্থ প্রবেশ করে। সেই অর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়, যা গ্রহণযোগ্য কর পরিশোধ বা দেনা মেটানোর প্রতিশ্রুতিতে সমর্থিত। এই ব্যবস্থায় অর্থ হয়ে ওঠে একটি সরকারি উপকরণ, যা রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এটি একটি সম্মিলিত সম্পদ, যা জনবিশ্বাস ও আইনত কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (Federal Reserve System) একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এর মালিকানা হাতে গোনা কয়েকটি বড় বেসরকারি ব্যাংকের হাতে সীমাবদ্ধ। এই সুবাদে কাঁচা ডলার (High powered money or monetary base) সরবরাহ করে তারা বছরে ৬-৭ বিলিয়ন ডলার ফাও মুনাফা করে। ৪. বেসরকারি ব্যাংক এবং একটি জনসম্পদ থেকে মুনাফা এখান থেকেই শুরু হয় বৈষম্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার ওপর ভিত্তি করে অর্থ তৈরি হয়, তার তুলনায় অধিকাংশ মুদ্রা (৯০ শতাংশেরও বেশি) তৈরি করে বেসরকারি ব্যাংক। যখন কোনো ব্যাংক ঋণ দেয়, তখন তারা আগে থেকে থাকা অর্থ ধার দেয় না; তারা নতুন অর্থ তৈরি করে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা করে। এটাই ফ্র্যাকশনাল রিজার্ভ ব্যাংকিং পদ্ধতি, যেখানে ব্যাংক অর্থ তৈরি করে ‘হাওয়া থেকে’। এই সুবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোট-বড় বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিবছর ফাও ২৫০ থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার নিট মুনাফা অর্জন করে। তারা এই ক্ষমতা পায়, কারণ তারা সরকার দ্বারা লাইসেন্সপ্রাপ্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের একটি ক্ষুদ্র অংশ ধরে রেখে বহুগুণ ঋণ দেয়। এই ঋণের ওপর সুদ হলো তাদের ব্যবসা, তাদের লাভ। ফলে, তারা প্রকৃত কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদন না করেও অর্থ তৈরি করে এবং তাতে সুদ লাভ করে। অথচ এই ক্ষমতা এসেছে রাষ্ট্র-প্রদত্ত অনুমোদন ও জনবিশ্বাসের মাধ্যমে। কিন্তু এর লাভ মূলত বেসরকারি হাতে, জনসাধারণ তার সুবিধা খুব কমই পায়। ৫. আধুনিক অর্থব্যবস্থা কেন শোষণমূলক এটি পরিষ্কারভাবে বোঝা জরুরি। রাষ্ট্র অর্থ তৈরি করে জনস্বার্থে। বেসরকারি ব্যাংক, সেই অর্থকে ভিত্তি করে ঋণ দিয়ে বহু গুণ অর্থ তৈরি করে। এই অর্থ প্রবেশ করে ব্যক্তিগত, করপোরেট বা সরকারি ঋণ হিসেবে। অর্থাৎ, আমাদের অর্থব্যবস্থা ঋণনির্ভর এবং সেই ঋণের ওপর সুদ যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। এই কাঠামো বেসরকারি ব্যাংককে সুযোগ দেয়— বাস্তব পণ্য বা সেবা তৈরি না করেও অর্থ তৈরির; জনসম্পদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে সুদ আয়; ক্ষতির সময় রাষ্ট্রীয় সাহায্য (বেইল আউট), কিন্তু লাভ একান্তই নিজেদের। অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে সরকার ব্যাংকগুলো উদ্ধার করে, কারণ তাদের পতন পুরো ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে সেই মুনাফা চলে যায় প্রাইভেট শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। এই অসমতা অর্থব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে শোষণমূলক করে তোলে। আরো ভয়াবহ হলো, যারা ঋণ পেতে পারে না, তারা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। ধনীরা সহজে ঋণ নিয়ে লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে আর গরিবরা উচ্চ সুদে ঋণ নেয় বা একেবারেই পায় না। ফলে বৈষম্য বাড়ে শ্রমের মাধ্যমে নয়, বরং অর্থকাঠামোর মধ্যেই নিহিত অসাম্য থেকে। ৬. যুক্তি ও তার সীমাবদ্ধতা সমর্থকরা বলে বেসরকারি ব্যাংকিং বেশি দক্ষ। যুক্তিটি সহজ : প্রতিযোগিতা ব্যাংকগুলোর মধ্যে ভালো সেবা, উদ্ভাবন এবং সতর্ক ঋণনীতিকে উৎসাহিত করে। আর ব্যাংক ঝুঁকি নেয়, তাই তাদের লাভ প্রাপ্য। কিন্তু এই যুক্তি তখনই ভেঙে পড়ে, যখন ব্যাংক জানে তারা ‘Too Big to Fail’। সংকটে সরকার তাদের বাঁচায়; নিয়মনীতি অনেক সময় তাদের পক্ষেই লেখা হয়; কথিত দক্ষতা অনেক সময় জুয়া খেলা ও ফটকাবাজিতেই চলে যায়। আর একটি নৈতিক যুক্তি দেওয়া হয়—ঝুঁকি নিলে লাভ প্রাপ্য। কিন্তু যে অর্থকাঠামো সেই ঝুঁকির সুযোগ দেয়, তা তো জনসম্পদ! জনবিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমর্থন, আইনগত কাঠামো—সবই রাষ্ট্র বা জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অথচ লাভ যাচ্ছে বেসরকারি মালিকদের হাতে। ৭. ন্যায্য ব্যবস্থার দিকে যেহেতু অর্থ একটি জনসম্পদ, তার লাভও জনসাধারণের কাছেই ফিরতে হবে। কিছু বিকল্প ব্যবস্থাÑ ক. সরকারি ব্যাংকিং : সরকার নিজেই ব্যাংক স্থাপন করে অবকাঠামো, শিক্ষা ও পরিবেশবান্ধব খাতে ঋণ দিতে পারে। এসব ব্যাংকের লাভ জনগণের জন্য পুনর্বিনিয়োগ হয়। খ. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা (CBDC) : নাগরিকরা যদি সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রাখতে পারেন, তাহলে ব্যাংক ছাড়াই নিরাপদ অর্থব্যবস্থার সুযোগ পাবে। গ. সম্পূর্ণ রিজার্ভ ব্যাংকিং : এই ব্যবস্থায়, ব্যাংক শুধু সেই অর্থ ঋণ দিতে পারবে, যা তাদের হাতে আসলেই আছে। এতে ঋণনির্ভর অর্থ সৃষ্টির পথ বন্ধ হবে। ঘ. সার্বভৌম অর্থ প্রস্তাবনা : ২০১৮ সালে সুইজারল্যান্ডের Vollgeld উদ্যোগ প্রস্তাব করেছিল, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকই অর্থ তৈরি করবে, বেসরকারি ব্যাংক নয়। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থ সৃষ্টির ক্ষমতা বিলুপ্ত হতো এবং অর্থ পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকত। কিন্তু গণভোটে এই প্রস্তাব মাঠে মারা যায়। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা, রাজনৈতিক চাপ, জনসাধারণের অস্পষ্ট ধারণা এবং পরিবর্তনের প্রতি ভয়ের সম্মিলিত প্রভাবে এ রকম একটি সুবর্ণ সুযোগ সুইস জনগণের ছাতছাড়া হয়ে যায়। আধুনিক অর্থব্যবস্থা নিরপেক্ষ নয়। এটি জনবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এর মূল লাভ যাচ্ছে বেসরকারি মালিকদের হাতে। অর্থের কাঠামো, যা জটিল ভাষা ও অর্থনৈতিক মতবাদের আড়ালে থাকে, আসলে এক ধীর ও নীরব সম্পদ স্থানান্তর ব্যবস্থাপনা। অর্থ যে মৌলিকভাবে অন্যায্য, তা বোঝা আমাদের জন্য জরুরি—কারণ এখান থেকেই শুরু হতে পারে একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন। এখন সময় এসেছে অর্থকে ফিরে পাওয়ার, যেমনটি এটি হওয়া উচিত—একটি জনসম্পদ, সবার কল্যাণে ব্যবহারের জন্য, কিছু সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মুনাফার জন্য নয়। লেখক : অর্থনীতির অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও ম্যানেজিং এডিটর জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ
Email: [email protected]