একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সফল অংশীদার হতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। আর এই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মূল ভিত্তি হলো গবেষণা ও উদ্ভাবন। যে জাতি গবেষণায় যত উন্নত, সে জাতি বিশ্বের বুকে ততটাই প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ। অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নানা সূচকে আমাদের অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই মৌলিক জায়গায় আমরা কেন পিছিয়ে, তার কারণ অনুসন্ধান এবং উত্তরণের পথ খুঁজে বের করা অত্যন্ত জরুরি।

গবেষণার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো অর্থ। উন্নত বিশ্ব তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ পর্যন্ত গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করলেও, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে এই খাতে আমাদের ব্যয় জিডিপির মাত্র ০.৩০ শতাংশ। আবার যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার সিংহভাগই অবকাঠামো নির্মাণ এবং বেতন-ভাতায় খরচ হয়ে যায়। গবেষণার মূল সরঞ্জাম কেনা বা গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য অর্থায়নের সুযোগ খুবই সীমিত।

ধর্মগুরুর মুখোশ ও বুটে পিষ্ট মানবতাধর্মগুরুর মুখোশ ও বুটে পিষ্ট মানবতা

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও মুখস্থনির্ভর। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং প্রশ্ন করার মানসিকতা তৈরি করার সুযোগ সীমিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের ওপর অতিরিক্ত ক্লাসের চাপ, প্রশাসনিক দায়িত্ব এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে গবেষণায় মনোনিবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়, গবেষণা খাতকে মুনাফা অর্জনের পথে একটি অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হিসেবে দেখা হয়। ফলে, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণার অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব না দিয়ে অনেক সময় শুধু ক্লাস নেওয়ার সক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর ফলে সৃষ্টি হচ্ছে এক গবেষণাবিমুখ সংস্কৃতি, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিসিএস বা চাকরির বাজারকেই একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে, জ্ঞান সৃষ্টি বা গবেষণার মতো দীর্ঘমেয়াদি ও অনিশ্চিত পথে তারা হাঁটতে আগ্রহী হয় না।

একটি মানসম্মত গবেষণার জন্য প্রয়োজন আধুনিক ল্যাবরেটরি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, দ্রুতগতির ইন্টারনেট এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সহজলভ্য। বাংলাদেশের অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠানেই এই মৌলিক সুবিধাগুলোর অভাব রয়েছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে অনেক গবেষক তাদের কাজ সময়মতো শেষ করতে পারেন না বা আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হন। এর পাশাপাশি, গবেষণার জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ, যেমন—মেন্টরশিপ, কোলাবোরেশন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার সুযোগেরও অভাব রয়েছে।

নীতিমালার খসড়া পর্যালোচনায় আমলানির্ভর কমিটিনীতিমালার খসড়া পর্যালোচনায় আমলানির্ভর কমিটি

উন্নত দেশগুলোয় শিল্প খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করা হয়। শিল্পের প্রয়োজন অনুযায়ী গবেষণার বিষয় নির্ধারিত হয় এবং গবেষণার ফলাফলকে শিল্পে প্রয়োগ করা হয়। বাংলাদেশে শিল্প ও শিক্ষা খাতের মধ্যে এই সেতুবন্ধ অত্যন্ত দুর্বল। ফলে, দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সমস্যার সমাধানের জন্য বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকে এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে না।

গবেষণার জন্য অপর্যাপ্ত সুযোগ, কম সম্মানী এবং সামাজিক স্বীকৃতির অভাবে আমাদের দেশের বহু মেধাবী গবেষক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। বিদেশে উন্নত গবেষণার পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত অর্থায়ন পাওয়ায় তারা সেখানেই স্থায়ী হচ্ছেন। এর ফলে দেশ তার সেরা মস্তিষ্কগুলোকে হারাচ্ছে, যা গবেষণা খাতে এক অপূরণীয় শূন্যতা সৃষ্টি করছে।

এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক।

প্রথমত, গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে জিডিপির কমপক্ষে ১ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং পর্যায়ক্রমে তা উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এই বরাদ্দের সঠিক ও স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য একটি শক্তিশালী তত্ত্বাবধান ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা তৈরির ওপর জোর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের গবেষণার জন্য বাধ্যতামূলক সময় ও সুযোগ তৈরি করতে হবে এবং শিক্ষক নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে গবেষণার মানকে প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সব আধুনিক অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। একটি কেন্দ্রীয় গবেষণা তহবিল গঠন করে সেখান থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি আধুনিকায়নের প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিয়মিত আলোচনা, সেমিনার এবং যৌথ গবেষণা প্রকল্প চালুর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে গবেষকদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো, সামাজিক মর্যাদা এবং উন্নতকাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে থাকা বাংলাদেশি গবেষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর জন্য বিশেষ ফেলোশিপ বা স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। তরুণ গবেষকদের জন্য বিশেষ পুরস্কার ও বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে।

গবেষণায় বিনিয়োগ শুধু অর্থ ব্যয় নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। তাই, গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি শক্তিশালী জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে এখনই মনোযোগী হওয়া জরুরি। সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি খাত এবং দেশের মেধাবী সন্তানদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে গবেষণার এই বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করতে।

লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ