রাসপুটিন, জার, নিকোলাস-শব্দগুলো শুধু ইতিহাসের পাতার স্মৃতি নয়, আজও আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মর্মান্তিকভাবে প্রাসঙ্গিক এক সতর্কবার্তা বহন করে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে, যখন কোনো শাসক বা নেতা এমন একজনের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, যার চরিত্র, যোগ্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে জনগণের মধ্যে গভীর সংশয় এবং নেতিবাচক ধারণা বিরাজ করে, যাকে সাধারণ মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত, অযোগ্য ও হীনস্বার্থপর বলে চিনে, তখন সেই নেতার পতন শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়ার শেষ জার নিকোলাস দ্বিতীয়ের করুণ পরিণতি এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবকে জারের পতনের জন্য দায়ী করা হয়। লেনিন ও তার দল নিঃসন্দেহে সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলেন। কিন্তু জারের পতনের আসল বীজ বপন হয়েছিল তার বহু আগে, শাসনযন্ত্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা দুর্বলতাগুলোর মধ্যেই। জারের নিজস্ব কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। জনগণ তার নেতৃত্বের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিল। শাসনের মূল ভিত্তি, অভিজাত শ্রেণিও তার প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। এই অভ্যন্তরীণ ক্ষয়িষ্ণুতা, এই আস্থাহীনতার ফাটলই ছিল বলশেভিকদের জন্য উন্মুক্ত দরজা। আর এসব কিছুর কেন্দ্রে ছিল এক রহস্যময়, কুৎসিত ও বিপজ্জনক চরিত্রÑগ্রিগোরি রাসপুটিন।

রাসপুটিন কোনো অভিজাত বা রাষ্ট্রীয় অমাত্য ছিল না। সে ছিল এক নিম্নবর্গীয় কৃষক, যার দাবি ছিল তান্ত্রিক ও সম্মোহনবিদ হওয়ার। সাধুর বেশ ধারণ করলেও তার অন্তরালে লুকিয়ে ছিল এক মদ্যপ, লম্পট ও কামুক চরিত্র। সে রাজপ্রাসাদে ঢুকেছিল এক ট্র্যাজিক দুর্বলতার সুযোগেÑ জার নিকোলাস ও জারিনা আলেকজান্দ্রার একমাত্র পুত্র ও ভাবী উত্তরাধিকারী প্রিন্স আলেক্সির দুরারোগ্য হিমোফিলিয়া রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞান ব্যর্থ হয়েছিল শিশু রাজকুমারের যন্ত্রণাদায়ক রক্তক্ষরণ ও জ্বর নিরাময়ে। রাসপুটিন, তার সম্মোহন ক্ষমতা দিয়ে, অদ্ভুতভাবে আলেক্সির উপসর্গ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এই ‘অলৌকিক’ সাফল্য জারিনা আলেকজান্দ্রাকে রাসপুটিনের প্রতি একান্তভাবে দুর্বল ও নির্ভরশীল করে তোলে।

ধূর্ত রাসপুটিন জারিনা আলেকজান্দ্রার এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে ধীরে ধীরে রাজপ্রাসাদের এক অদৃশ্য ক্ষমতাধরে পরিণত হয়। তার প্রভাব শুধু প্রাসাদের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সে প্রশাসনিক নিয়োগ ও বরখাস্তে হস্তক্ষেপ শুরু করে। সরকারি পদ ও সুযোগ-সুবিধা ঘুসের বিনিময়ে বিলি করতে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তেও তার অদৃশ্য হাত পড়তে শুরু করে। তার এই উৎকট ক্ষমতার অপব্যবহার, জারিনার সঙ্গে তার কেলেঙ্কারিপূর্ণ সম্পর্কের গুঞ্জন এবং বিশাল আকারের দুর্নীতির কথা ক্রমেই জনগণের কানে পৌঁছায়।

রাসপুটিনের এই উত্থান এবং জার-জারিনার তার প্রতি অন্ধ বিশ্বাসের ফলাফল ছিল ভয়াবহÑ

১. অভিজাতদের বিদ্বেষ : রাশিয়ার অভিজাত শ্রেণি ও অভিজাত কর্মকর্তারা জারের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষে ফেটে পড়েন। তারা দেখতে পান, এক নিচুস্তরের কুচরিত্র ব্যক্তি তাদের চেয়ে রাজসভায় বেশি প্রভাবশালী।

২. প্রশাসনের বিশৃঙ্খলা : রাসপুটিনের হস্তক্ষেপে প্রশাসনিক ব্যবস্থা দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যা মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

৩. জন-আস্থার পতন : সাধারণ মানুষ জার নিকোলাসকে একজন দুর্বল, অযোগ্য ও প্রভাবাধীন নেতা হিসেবে দেখতে শুরু করে। রাষ্ট্রনেতা হিসেবে জারের প্রতি জনগণের আস্থা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে।

৪. শেষ চেষ্টা ও উল্টো ফল : পরিস্থিতির চরম অবনতিতে রাসপুটিনকে ১৯১৬ সালে গোপনে হত্যা করা হয়। কিন্তু ফল হয় উল্টো। এই হত্যাকাণ্ড জনরোষকে প্রশমিত করার বদলে আরো তীব্রতর করে তোলে। এ পরিস্থিতি জার পরিবারের দুর্বলতা ও হতাশাজনক অবস্থাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, বিশৃঙ্খলা ও সর্বব্যাপী জন-অসন্তোষই ছিল সেই উর্বর ভূমি, যেখানে বলশেভিক বিপ্লবের বীজ অঙ্কুরিত হয়। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) জার নিকোলাস দ্বিতীয়কে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। অক্টোবরে বলশেভিকরা পুরোপুরিভাবে ক্ষমতা দখল করে নেয়। রাসপুটিনের প্রভাবই ছিল সেই অন্তর্ঘাতমূলক বিষ, যা রাশিয়ার রোমানভ রাজবংশের ভিতকে পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছিল এবং শেষে চিরতরে উৎখাত করে দিয়েছিল।

ইতিহাসের সাদৃশ্যপূর্ণ আরো নজির

এই ট্র্যাজেডি শুধু রাশিয়াতেই নয়, বিশ্ব ইতিহাসের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায়। রাশিয়ার ঘটনা বিগত শতাব্দীর একটি বড় অনুবৃত্তি মাত্র। ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান বিন আফফান (রা.)-এর করুণ পরিণতিও একই প্যাটার্নের ইঙ্গিত দেয়। অতি কোমলমনা ও সরলপ্রকৃতির খলিফার ওপর মারওয়ান বিন আল-হাকামের গভীর প্রভাব এবং তার প্রতি খলিফার আস্থা, অনুরাগ এবং মারওয়ানের কিছু কর্মকাণ্ড জনমনে অসন্তোষ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এ অসন্তোষই পরিণতিতে এক ভয়াবহ জনবিদ্রোহে রূপ নেয়, যার পরিণতিতে খলিফা ওসমান (রা.) শাহাদাতবরণ করেন। এ ঘটনা ইসলামি ইতিহাসের গতিপথই বদলে দেয়। এটি আরেকটি মর্মান্তিক প্রমাণ, নেতার ব্যক্তিগত দুর্বলতা বা আস্থা যদি জনবিদ্বেষভাজন, স্বার্থান্বেষী ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি তুলে দেয়, তবে তার পরিণাম সর্বনাশা হতে বাধ্য।

আজকের প্রেক্ষাপট

রাসপুটিন আর মারওয়ানের ঘটনা শতাব্দী বা সহস্রাব্দ পেরিয়েও আমাদের জন্য এক জরুরি প্রশ্ন রেখে যায় : ব্যক্তিগত ভৃত্য বা অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ আত্মীয় বা প্রিয়ভাজন কোনো ব্যক্তি কি নেতার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নিয়ন্তা হয়ে উঠছে? নেতার ব্যক্তিগত দুর্বলতা কি তাকে এমন ব্যক্তিদের কবজায় ফেলছে, যারা রাষ্ট্রের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখে? কে নেতার কাছে প্রবেশের অনুমতি পাবে, কার কথা শোনা হবেÑসেই সিদ্ধান্ত কি নেতার ‘অদৃশ্য পরামর্শদাতা’দের হাতে? জনগণ যখন নেতার ঘনিষ্ঠজনের দুর্নীতি, উদ্ধতপনা ও অপকর্ম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়, তখন নেতার প্রতি তাদের আস্থা টিকে থাকে কীভাবে?

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এমন পরিস্থিতিতে নেতার পতন অনিবার্য নয় শুধু, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও জনগণের ভাগ্যেও নেমে আসে অন্ধকার। রাসপুটিনের কুপ্রভাব রাশিয়াকে এক ভয়াবহ বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। মারওয়ানের প্রভাব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে গভীর ফাটল সৃষ্টি করেছিল।

আমাদের রাজনীতির জন্য এই ইতিহাসের শিক্ষা নেওয়ার যোগ্যতা কি রাজনীতিকরা রাখেন? নেতৃত্বের দায়িত্ব শুধু ক্ষমতাচর্চা নয়; তা হলো জনগণের আস্থা রক্ষার এক মহান আমানত এবং একাধারে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জও। সেই আমানত রক্ষায় নেতাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে কাদের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হচ্ছেন, কাদের হাতে তিনি অন্ধভাবে ক্ষমতা অর্পণ করছেন। কারা তাকে বেষ্টনী বা বলয় বৃত্তে আবদ্ধ করে রাখছেন এবং বাইরে তারা কী করছেন। জনগণের বিরাগভাজন, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য ব্যক্তিদের প্রতি নির্ভরশীলতা শুধু কোনো নেতার পতন ডেকে আনে না, পুরো জাতির ভবিষ্যৎকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। রাসপুটিন ও জার নিকোলাসের ট্র্যাজেডি, ওসমান (রা.) ও মারওয়ানের করুণ ইতিহাস আমাদের বারবার এই সত্যটিই স্মরণ করিয়ে দেয়Ñক্ষমতার ছায়াসঙ্গীদের নির্বাচনে ভুলের মূল্য কখনোই শুধু নেতার ভাগ্যেই লেখা থাকে না, পুরো জাতি তা ভোগ করে। ব্রিটিশ রাজনীতির প্রবাদপুরুষ দার্শনিক রাজনীতিক এডমান্ড বার্ক বলেছেন, History teaches prudence not principlesÑইতিহাস প্রজ্ঞা শিক্ষা দেয়, নীতি নয়। কিন্তু ইতিহাসের পাঠ নেওয়া সহজ নয়, ইতিহাসের পাঠ নিতে নেতারা কী যোগ্যতা রাখেন!

লেখক : শিক্ষাবিদ, সিটিজেন অ্যাকটিভিস্ট, লন্ডন

বিষয়: প্রশাসন, ইতিহাস

সূত্র, আমার দেশ