ফিলিস্তিনের গাজায় টানা দুই বছরের ইসরাইলি আগ্রাসনের পর অবশেষে শান্তির আলো দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরাইল একটি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সম্মত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে থাকা অবরুদ্ধ গাজাবাসীর জন্য এটি এক স্বস্তির খবর। বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ ঘোষণার পর গাজায় যে আনন্দের ঢেউ নেমে এসেছে, তা যুদ্ধের ভয়াবহতা আর স্বজন হারানোর যন্ত্রণার গভীরতাকেই প্রকাশ করে। তবে আমরা আশা করব, এই চুক্তি কেবল জিম্মি ও বন্দিবিনিময়ের প্রথম ধাপ নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সূচনা করবে।
জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী ১,৯৫০ ফিলিস্তিনি বন্দির বিনিময়ে ২০ জন ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং একইসঙ্গে গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার শুরু হবে। বলা যেতে পারে, ইসরাইলি মন্ত্রিসভা চুক্তিটি অনুমোদন দেওয়ায় এর কার্যকারিতায় আর কোনো বড় বাধা রইল না। এটি একটি ইতিবাচক অগ্রগতি, যা উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থা স্থাপনে প্রাথমিক ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, বিশ্বনেতারাও এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তবে এই স্বস্তির মাঝেও রয়েছে কিছু উদ্বেগের কারণ, যা বেশ গভীর। কারণ, যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সত্ত্বেও গাজা সিটি ও খান ইউনিসে ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত হামলার কথা জানিয়েছে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। হামলায় নিরীহ ফিলিস্তিনিদের হতাহতের খবর স্বাভাবিকভাবেই চুক্তিটির বাস্তবায়ন এবং ইসরাইলের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যুদ্ধবিরতির মতো সংবেদনশীল মুহূর্তেও হামলা চালানো হলে তা শান্তি প্রক্রিয়াকে শুরুতেই যে ঝুঁকিতে ফেলে দেবে, তা বলাই বাহুল্য। চুক্তির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বন্দিবিনিময় তালিকা। হামাস যে বন্দিদের মুক্তির দাবি করেছে, এর মধ্যে ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় নেতা মারওয়ান বারগুতিও রয়েছেন, যাকে অনেকে ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখেন। ইসরাইল প্রাথমিকভাবে তার মুক্তির বিষয়ে অসম্মতি জানিয়েছে। কাজেই এ ধরনের বিতর্কিত বিষয়গুলো চুক্তির ভবিষ্যৎ ধাপগুলোতে সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
তবুও এই যুদ্ধবিরতিকে কেবল একটি বন্দিবিনিময় চুক্তি হিসাবে দেখলে হবে না; এটি বৃহত্তর শান্তি প্রক্রিয়ার একটি অংশ অবশ্যই। বিশ্বনেতারা যে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন, এই চুক্তি সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রথম ধাপ হতে পারে। যেমন তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো এই চুক্তির আওতায় গাজার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়ন। অতীতের মতো এ যুদ্ধবিরতি যেন কেবল একটি সাময়িক বিরতি না হয়, সে জন্য মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন। ইসরাইলকে অবশ্যই তার হামলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে এবং গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশে সব ধরনের বাধা দূর করতে হবে। অন্যদিকে, হামাসকেও জিম্মিদের মুক্তির প্রক্রিয়া আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। গাজাবাসীর জন্য স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার জন্য উভয় পক্ষকেই সংঘাতের পথ পরিহার করে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের দিকে এগোতে হবে। এই শান্তিচুক্তি যেন কেবল বারুদদগ্ধ বাতাসে স্বস্তির ঘ্রাণ হয়ে মিলিয়ে না যায়, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে বিশ্বকেই।