আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়া বিশ্বের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। তার বর্তমান শাসনামলে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন পথে যাবে, তা নিয়েও বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনার কমতি নেই। তবে ট্রাম্পের বাস্তবভিত্তিক চিন্তা, স্বার্থভিত্তিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের ওপর গুরুত্বারোপ করার নীতি আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ককে এরই মধ্যে একটি আকার দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো আদর্শকে অত্যধিক গুরুত্ব না দিয়ে বরং কৌশলগত দরকষাকষি এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের প্রশাসনও যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বাস্তবতাভিত্তিক নীতিই প্রত্যাশা করে।
এরদোয়ানের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই চমৎকার এবং তারা পরস্পরকে যথেষ্টই সম্মান করেন। এমনকি কোনো চুক্তি স্বাক্ষরের ক্ষেত্রেও তারা পরস্পরের স্বার্থের দিকে খেয়াল রাখেন। তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও দুজনেই তুরস্কের ব্যাপারে কিছুটা সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। কিন্তু ট্রাম্প ও এরদোয়ানের ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন তুরস্ক-মার্কিন সম্পর্কে ইতিবাচক ও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
শাহবাগি রাজনীতির বিপজ্জনক ছায়াশাহবাগি রাজনীতির বিপজ্জনক ছায়া
তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর একটি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চলে তুরস্কের সক্রিয় কূটনীতি বিশেষ করে ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর ধরেই তুরস্ক হামাসকে গাজা উপত্যকার ফিলিস্তিনিদের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের কঠোর সমালোচনা করে এটাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করছেন।
পশ্চিমা বিভিন্ন সূত্র অনুসারে, সর্বশেষ ন্যাটো সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ কথা জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের মিত্র ট্রাম্প ইরান-ইসরাইল যুদ্ধবিরতি নিয়ে যে আহ্বান জানিয়েছেন তার প্রতি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই ইতিবাচক মনোভাব দেখানো উচিত।’ ট্রাম্প হামাস ও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা নিয়ে ইসরাইলের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করেছেন, তা ফিলিস্তিনি ইস্যুতে তুরস্কের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালনের সুযোগ তৈরি করেছে।
তুরস্ক ন্যাটোর একমাত্র সদস্য দেশ, যার সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়েরই সুসম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক তুরস্ককে বিশেষ কূটনৈতিক সুবিধা প্রদান করেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করা, যুদ্ধবন্দি বিনিময় এবং কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য রপ্তানিতে রাশিয়াকে রাজি করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
এরদোয়ানের এই সক্ষমতা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কূটনীতির কৌশলগত হিসাব-নিকাশে তুরস্ককে বিশেষ স্থান দিয়েছে। একাধিক সূত্রমতে, তুরস্কে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নেতাদের সাম্প্রতিক একটি বৈঠকে ট্রাম্পকেও যোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এরদোয়ান। যদিও পরে সেই বৈঠকটি হয়নি, কিন্তু ট্রাম্প এরদোয়ানের এই পরামর্শকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। গাজা ও ইউক্রেন সংকট নিরসনে আঙ্কারা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সমন্বয়ের আহ্বানও জানিয়েছেন এরদোয়ান। এ থেকে এটা স্পষ্ট, ইউক্রেন ও গাজার সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্কের ভূমিকা ট্রাম্পের বাস্তবভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
বাশার আল আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় শাসনব্যবস্থায় রূপান্তর প্রক্রিয়া চলাকালে এই অঞ্চলে তুরস্কের প্রভাব যথেষ্ট বেড়েছে। বাশার সরকারের পতন ঘটাতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামকে (এইচটিএস) সহযোগিতা দিয়েছে তুরস্ক। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর বাশার আল আসাদ দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর এইচটিএস নেতা আহমেদ আল সারা দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট হন। এরপর গত মে মাসে তিনি তুরস্ক সফরে গিয়ে এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠকে সিরিয়ার পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করেন।
ট্রাম্প প্রশাসনে এরদোয়ানের সিরিয়া কূটনীতি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। গত মে মাসে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ সফরের পরই ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং দেশটির অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আল শারার সরকারকে সহযোগিতার ঘোষণা দেন। তিনি আল শারাকে ‘একজন সত্যিকারের নেতা’ আখ্যায়িত করে সিরিয়াকে ঐক্যবদ্ধ ও দেশটির অর্থনীতিকে চাঙা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এরদোয়ানের ভূমিকার কারণেই সিরিয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের দিক থেকে এ ধরনের ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় ট্রাম্প ও আল শারার ভার্চুয়াল সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এরদোয়ানও। এই ভার্চুয়াল সম্মেলনের সময়ই ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণাটি দেন। বাশার আল আসাদের শাসনকালে আরোপ করা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরিয়ার অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়। এখন এরদোয়ানের মধ্যস্থতায় ট্রাম্প সিরিয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করেছেন, যা গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত দেশটির অর্থনীতির পুনর্গঠনে সহায়ক হবে।
ট্রাম্প-এরদোয়ান-আল শারার ভার্চুয়াল সম্মেলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে একটি নতুন জোট গড়ে ওঠার আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। এর মাধ্যমে গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ার ভবিষ্যৎ গন্তব্যও নির্ধারিত হবে। সিরিয়াকে একটি স্থিতিশীল দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে এরদোয়ান যে ভূমিকা পালন করছেন, সেজন্য তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব বৃদ্ধির পাশাপাশি এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবেও গুরুত্ব পাবে আঙ্কারা।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্প ও এরদোয়ানের মধ্যে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের রসায়ন ন্যাটো জোটের এই দুই শক্তিশালী সদস্য দেশের সম্পর্ককে আরো জোরদার করবে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে এরদোয়ান তার সঙ্গে যেকোনো সময় সরাসরি কথা বলার অধিকার লাভ করেছিলেন। এমনকি ট্রাম্প অবসর সময় কাটানোর মুহূর্তেও এরদোয়ান তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারতেন। ট্রাম্প তাকে সেই অধিকার দিয়েছিলেন বলে মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে। দুই নেতার সেই সম্পর্ক এখন আরো গভীর হয়েছে। চার বছরের মধ্যে তারা ৯ বার সাক্ষাৎ করেছেন।
পারস্পরিক এই আস্থার কারণেই তারা যেকোনো কূটনৈতিক সংকটকে মোকাবিলা করে নিজেদের সম্পর্ককে রক্ষা করতে পারেন। অবশ্য দুই দেশের মধ্যে কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন।
ওয়াইপিজি হচ্ছে তুরস্কের বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সিরিয়ান শাখা। তুরস্ক পিকেকে এবং ওয়াইপিজিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করে। এরদোয়ান সরকারের বক্তব্য হচ্ছে—এই দুটি সংগঠনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে তুরস্কের সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ওয়াইপিজি ইস্যু ছাড়া আরেক সংগঠন দ্য গুলেনিস্ট টেরর গ্রুপ (ফেটো) নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। ট্রাম্প ২০১৮ সালে তার প্রথম মেয়াদে ফেটো নেতা ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী তুর্কি ভিন্নমতাবলম্বী ফেতুল্লা গুলেনকে তুরস্কের কাছে প্রত্যর্পণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এরপর গুলেন মারা যাওয়ায় এ-সংক্রান্ত ইস্যুগুলো কিছুটা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ফেটোর নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তি রয়েই গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তুরস্কের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার ইস্যু নিয়েও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন আছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে তুরস্ককে এই যুদ্ধবিমান দিতে রাজি হলেও আঙ্কারা রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনায় ক্ষুব্ধ হয় ওয়াশিংটন। তারা তুরস্কের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির প্রাথমিক সমঝোতা বাতিল করে দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন তুরস্কের সঙ্গে এ বিরোধকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও এর কোনো সমাধান এখনো হয়নি।
তবে এসব বিষয়কে পাশ কাটিয়ে দুই দেশই এখন নতুন ক্ষেত্রগুলোয় কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করছে। ট্রাম্প ও এরদোয়ানের বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে। অতীতে আফগানিস্তান ও ইউক্রেনে তুরস্কের সহযোগিতার কথা মনে রেখে সিরিয়া, গাজা, ইউক্রেনসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে ট্রাম্প ও এরদোয়ান তুরস্ক-মার্কিন কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন।
বিষয়: ট্রাম্প, এরদোয়ান