একটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সংস্থা হিসেবে ২১ নভেম্বর ২০০৪ সালে দুদক গঠিত হয়। কিন্তু শুরু থেকেই নেতৃত্বে ছিল সমন্বয়হীনতা। ২০০৭ সালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে তিন কমিশনারই পদত্যাগ করেন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে তারা মানবসম্পদের ঘাটতি, আইনি জটিলতা ও অসম্পূর্ণ আইনের কথা উল্লেখ করেন, যা কমিশনের স্বাধীনতাকে কার্যত খর্ব করেছিল। নিজেদের বিধিমালা বা কাঠামো প্রণয়নেও কমিশনের ছিল না পূর্ণ কর্তৃত্ব। গণমাধ্যমে প্রফেসর মনিরুজ্জামান বলেন, ‘শুধু ঘুসখোর নয়, যারা ঘুস দেয় তারাও অপরাধী।’ চেয়ারম্যান সুলতান হোসেন খান দুর্নীতির কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাস্টমস, বন্দর ও পুলিশ বিভাগের কথা বলেন, যেখানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বড় বাধা।
এ অধ্যায়টি স্পষ্ট করে দেয় যে আইন থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় গঠিত, কাঠামোগতভাবে দুর্বল এবং নেতৃত্বহীন কোনো প্রতিষ্ঠান কখনোই দুর্নীতির মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাধির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।
২০০৯ সালের পর থেকে দুদক কার্যত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য সরকারের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়, যা সংস্থাটিকে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করে। এরপর থেকেই দুদক হয়ে ওঠে একটি পক্ষপাতদুষ্ট, প্রভাবাধীন ও প্রহসনের প্রতিষ্ঠান। বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত ও হয়রানি চললেও শাসক দলের দুর্নীতির মহাব্যাধি চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বহু দুর্নীতির মামলা গোপনে প্রত্যাহার হয় বা ধামাচাপা পড়ে যায়, অভিযুক্তদের ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেওয়ার নজিরও বারবার দেখা গেছে।
এ সময় দুর্নীতি হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রধান চালিকাশক্তি। অধিকাংশ সাধারণ মানুষও ক্ষুদ্র লাভের আশায় জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি। দুদককে ব্যবহার করা হয় এমনভাবে, যেন কেউ দুর্নীতির অভিযোগে আওতাভুক্ত থাকলে তাকে ব্ল্যাকমেইল করে ‘নির্বাক’ রাখা যায়। ফলে যারা পেশাগতভাবে অযোগ্য বা মাঝারি মানের ছিলেন, তারা দ্রুত শাসক দলের আনুগত্যের বিনিময়ে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন, দেশপ্রেমিক, সাহসী ও মেধাবীরা পিছিয়ে পড়েন। শীর্ষপর্যায়ে এমন কাউকেই রাখা হয়নি, যিনি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিতে পারেন, কারণ প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির দাগে কলুষিত ছিলেন।
এই প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় আত্মঘাতী এক চক্র, যেখানে সবাই দুর্নীতিতে জড়িত, ফলে কেউ আর সরকারের দুর্নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার নৈতিক শক্তি বা অবস্থানে ছিলেন না। দুর্নীতির ব্যাপকতা এতটাই ছিল, এমনকি একজন ‘পিয়ন’-এর কাছেও ৪০০ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য উঠে আসে, তবু কোনো শাস্তি হয়নি। এটি দেখায় দুর্নীতি কীভাবে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
এই দুর্বলতার উদ্দেশ্য ছিল আরো গভীর। অনেক বিশ্লেষকের মতে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ‘ভঙ্গুর রাষ্ট্রে’ পরিণত করে প্রতিবেশী শক্তির নিয়ন্ত্রণে আনার অপচেষ্টা চলেছে। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের সময়, চীনা বাহিনী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষত আসাম ও নেফা (বর্তমান অরুণাচল) এলাকায় অগ্রসর হয়। ভারতীয় বাহিনী দ্রুত পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’ ছিল এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, সরু শিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) হয়ে সামরিক রসদ ও সৈন্য পাঠানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে ভারতের কূটনীতিকরা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে বিকল্প করিডোর ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহযোগিতা চান। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গ্যালব্রেথের মাধ্যমে বিষয়টি পাকিস্তানের কাছে পৌঁছায়। ১৯৬২ সালের ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সরাসরি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে বার্তা পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানান। (তথ্যসূত্র : মডার্ন ডিপ্লোম্যাসি : ১৬ মার্চ ২০২৩) কিন্তু আইয়ুব খান তা প্রত্যাখ্যান করেন, যুক্তি দেন, পাকিস্তানের নিজস্ব নিরাপত্তা ইস্যু রয়েছে, তাই ভারতকে সহায়তা করা সম্ভব নয়। খালিউর রহমান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে তার অভিজ্ঞতায় জানান, পাকিস্তান শুধু আকাশপথে সীমিত ওভারফ্লাইটের কথা বিবেচনায় রেখেছিল, যা বাস্তবে কোনো কার্যকর সমাধানে পরিণত হয়নি।
ভারত ওই যুদ্ধে চীনের কাছে পরাজিত হয় এবং নেহরু শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন, যার জেরে ১৯৬৪ সালে হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়। এই ঐতিহাসিক পরাজয় ভারতের কৌশলগত চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে এবং সেই থেকে বাংলাদেশকে ‘করিডোরনির্ভর’ একটি ভৌগোলিক উপাদান হিসেবে নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি ভারতের নিরাপত্তা পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
এই সুযোগ আসে ২০০৯-২৪ সময়কালে, যখন ভারতের ঘনিষ্ঠ একটি সরকার বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় ছিল। একে কেন্দ্র করেই নিরাপত্তা উপদেষ্টাসহ দেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের র-এর বেতনভুক্ত এজেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যারা শপথভঙ্গ করে তাদের দেওয়া প্রতিটি আদেশ পালনে এতটাই অনুগত ছিল যে, প্রয়োজন পড়লে মায়ের সম্মানও বিকিয়ে দিত পদোন্নতি, অর্থ বা সুবিধার বিনিময়ে। একই সঙ্গে, দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশে পরিণত করে, দুদককে নিষ্ক্রিয় রেখে দেশের প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক সক্ষমতা পঙ্গু করে ফেলা হয়। এমন একপর্যায়ে, দেশের তিন বাহিনীই যেন ‘শাড়ির আঁচলের নিচে’ চলে আসছিল, যার অর্থ ছিল জাতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিক আনুগত্যের অন্তর্গত করে ফেলা। এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি ‘ভ্যাসাল স্টেট’-এ পরিণত করা, যাতে ভারতের সামরিক ও কৌশলগত স্বার্থে দেশটিকে ব্যবহার করা যায়।
বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন ড. মইনুদ্দিন আবদুল্লাহ মোমেন, যিনি একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রশাসক হিসেবে সুপরিচিত। তার সামনে একটি ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি হয়েছে দুদককে শুধু দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা হিসেবে নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার একটি গৌণ রক্ষাকবচে পরিণত করার।
যদিও সামরিক বা গোয়েন্দা সংস্থার ওপর দুদকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই, তবে সাংবিধানিকভাবে দুদকের রয়েছে সম্পদের উৎস, জীবনযাত্রার মান এবং বিদেশে অর্থ স্থানান্তরের মতো বিষয়ে তদন্ত করার পূর্ণ অধিকার। এই প্রেক্ষাপটে, সম্প্রতি দুদক সাবেক সাবেক ছয় জেনারেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অনুসন্ধান শুরু করেছে এমনটি নিশ্চিত করেছে দৈনিক আমার দেশ। অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন সাবেক সেনাপ্রধান, বিমানবাহিনী প্রধান, এনএসআই ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধানসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা শাখার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা।
দুদক ইতোমধ্যেই তাদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ করেছে, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং বিদেশে অর্থ পাঠানো ও প্রক্সি বিনিয়োগের উৎস অনুসন্ধানে নেমেছে। দীর্ঘদিন পর এমন উচ্চপর্যায়ের ও ‘অন্তরালের ক্ষমতাধর’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী তদন্ত শুরু হওয়া নিঃসন্দেহে একটি সাহসী পদক্ষেপ, যা প্রমাণ করে দুর্নীতি শুধু বেসামরিক প্রশাসন নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোর গভীর অংশেও প্রবেশ করেছে।
যদি ড. মোমেন সত্যিকার অর্থে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারেন এবং এনএসআই, ডিজিএফআই ও বিএফআইইউয়ের সঙ্গে সংস্কারপূর্বক সমন্বয় করে একটি শক্তিশালী আর্থিক গোয়েন্দা কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হন, তবে দুর্নীতির জাল ছিন্ন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কৌশলগত সমন্বয় এবং নিরপেক্ষতা।
সার্বিকভাবে, দুর্নীতিকে এখন আর শুধু অর্থনৈতিক অপরাধ হিসেবে দেখা যাবে না, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি এবং একটি ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশও হতে পারে। রাষ্ট্র যেন দুর্নীতিবাজদের হাতে আর জিম্মি না হয়। এখন প্রয়োজন এমন একটি জবাবদিহিমূলক কাঠামো যেখানে কোনো ‘মায়ের বিক্রেতা’ আর রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে না পারে এবং দুদক শুধু ফাইল চালনা নয়, বরং সাহসী সিদ্ধান্ত ও রাষ্ট্রীয় আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রতীক হয়ে উঠতে পারে।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কখনো শুধু আইনি লড়াই নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। গত দুই দশকে দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি, বরং ধীরে ধীরে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র, সশস্ত্র বাহিনী ও জাতীয় নিরাপত্তাকে দুর্বল করেছে। যদি এখনো আমরা চোখ না খুলি, তবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ শুধুই অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগতভাবে পরনির্ভর ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আজ প্রয়োজন এক দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব, কার্যকর দুদক এবং সেই সঙ্গে একটি জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামো যেখানে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করা কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দুর্নীতি প্রতিরোধ এখন আর শুধু সুশাসনের শর্ত নয় ‘এটি জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রাথমিক শর্ত।’
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনীর প্রধান ও উপ-উপাচার্য বিইউপি