বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, বিদ্যায়তনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দেখতে গেলে বিগত সপ্তাহটি বেশ ঘটনাবহুল। নানা অনভিপ্রেত কাকতাল মিলেমিশে একই সুতোয় গাঁথার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ কথামালা তৈরি করেছে। নানা বালখিল্য যুক্তির প্রেক্ষাপটে ঘটেছে তাত্ত্বিক অনুরণন, স্মৃতি তর্পণের নামান্তে হয়েছে নির্লজ্জ সাংস্কৃতিক দাসত্বের নতুন বয়ান উৎপাদন আর মনোজাগতিক দুর্বৃত্তায়নের পথে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে নিত্যনতুন নানা কুশীলব। সেখানে ১৫ আগস্টের শোকবার্তার বিপরীতে কালচারাল ফ্যাসিস্টের লটকানো আলোকচিত্রে জুতা নিক্ষেপের ঘটনা হয়ে উঠেছে প্রধান আলোচ্য। ইতিহাসবিদ ই এইচ কার ঘটনার পেছনের ঘটনায় সংযুক্ত যে বিধিবদ্ধ বর্ণনা ইতিহাস রচনায় মুখ্য করে তুলেছিলেন, তা হঠাৎ এভাবে ফিরে আসবে ভাবিনি।

তত্ত্বকথার বিবেচনায় দার্শনিক ও ইতিহাস লেখক হান্না অ্যারেন্ডটের চিন্তাভাবনাগুলো একটা সময় সমাজ, রাজনীতি, মানবাধিকার ও ক্ষমতার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমরা তার মূল তত্ত্বগুলোর মধ্যে ‘অথোরিটেরিয়ানিজম’, ‘রাজনৈতিক কর্ম’ ও ‘বিচ্ছিন্নতা’-সম্পর্কিত আলাপগুলোকে এই এইচ কারের এই ধারণাকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আলোচনার জন্য সামনে রাখতে পারি। অ্যারেন্ডট মনে করতেন, মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং জনসাধারণের মধ্যে সম্পর্কই সমাজের অগ্রগতি ও পরিবর্তনের ভিত্তি।

তার হিসেবে আধুনিক সমাজে মানুষের বিচ্ছিন্নতা বেড়ে গেছে, যা তাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে। এর ফলে একধরনের ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে, যা স্বৈরাচারী শাসনের দিকে নিয়ে গেছে। তার ‘অথোরিটেরিয়ানিজম’ তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা এবং মানুষের স্বাধীনতা হরণের ওপর বিশ্লেষণ করেন। বর্তমানে খেয়াল করলে দেখা যাচ্ছে, জুলাই গণহত্যার বছর পেরিয়ে গেলেও খুনিদের বিচার না হওয়া, গণকবরে শুয়ে থাকা শহীদদের লাশ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্থ্যতা, বাকসর্বস্ব উপদেষ্টাদের অপ্রয়োজনীয় হম্বিতম্বির বিপরীতে পলাতক খুনিদের নতুন করে সাংস্কৃতিক আশ্রয়ে ফেরার প্রচেষ্টা সবাইকে বিব্রত করেছে।

আমরা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় ‘পলিটিকাল অ্যাকশন’ বা রাজনৈতিক কর্মের ওপর সবাইকে বিশেষ জোর দিতে দেখছি। এই প্রবণতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদার একটি মূল অংশকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একজন নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব যেখানে রাজনীতি ও সমাজের পরিবর্তনের জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করা, সেখানে মানুষ অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে। আর সে হিসেবে অ্যারেন্ডটের সেই ‘ব্যানালিটি অব ইভিল’ তত্ত্বের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এর মধ্য দিয়েই মূলত নাজি জার্মানির নিষ্ঠুরতার ধারাবাহিকতায় সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকতার বিপরীতে অত্যাচারের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

ঠিক এভাবেই বাংলাদেশের জুলাই-পরবর্তী বাস্তবতায় ১৫ আগস্টের শোক প্রকাশ করার বিপরীতে উত্তেজিত জনতা গিয়ে ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ ট্যাগে চিহ্নিত ব্যক্তিদের ছবিতে জুতা নিক্ষেপ করছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা ‘রাজাকার ট্যাগে চিহ্নিত’ ব্যক্তিদের কফিনে থুতু দেওয়া, কবরে জুতা নিক্ষেপ এবং জানাজার আগে গলায় দড়ি নিয়ে শাহবাগে শুয়োর হাজির করার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা। শাহবাগ-উত্তরকালের সেই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ‘রূপান্তরিত চিন্তাধারা’ হিসেবে এখনো আমাদের রাজনীতি, সমাজ ও মানবাধিকার নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে অনুপ্রাণিত করছে না।

তাই রাজনৈতিক তত্ত্বের বিচারে ফ্যাসিজমের অর্থ কী? সেটা যে কেবল বিরোধী মত নিশ্চিহ্ন করার কোনো বিস্তৃত প্রকল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সেটা আমাদের মাথাতেই থাকছে না। বরঞ্চ সেই রজার গ্রিফিনের সেই পালিনজেনেটিক আলট্রান্যাশনালিজমের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, যার হিসেবে ‘সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ’ কাজে লাগিয়ে আওয়ামী লীগ তার হাতের রক্তের দাগ মুছে রাজনীতিতে ফিরতে চায়। অন্যদিকে তাদের সেই রাজনৈতিক মতাদর্শকে নির্দেশ করে যে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার ‘পুনর্জন্ম’ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে, আরেকপক্ষ তার বর্তমান অবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে।

জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে একটি মৌলিক জাতীয় পরিচিতি পুনঃসংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টা বিভাজনের বিষবৃক্ষকে আরো শক্তিশালী করেছে। এর ডালপালা ছড়িয়ে পড়ছে একটি কাল্পনিক ও আদর্শিত অতীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছার ওপর ভর করে। একটি দল এখনো এটি বিশ্বাস করছে, বাংলাদেশ যে সাংস্কৃতিক পুনর্জন্মের সম্ভাবনা, সেখানে শুধু বিদেশি প্রভাব, সংখ্যালঘু বা ধারণাকৃত হুমকির বিরুদ্ধে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ করেই অর্জিত হতে পারে। এটি প্রায়ই ফ্যাসিবাদী বা স্বৈরাচারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে—কেউ সেটা মানতে চাইছে না। তাই আওয়ামী শিবিরের সেই কারেক্টিভ কনফার্মিটি তথা ‘চাপিয়ে দেওয়া একমাত্র সত্য’ ধীরে ধীরে একাত্তর আর চব্বিশের বিপরীতমুখী ব্যাখ্যার নামান্তে নতুন বাইনারি তৈরি করছে। সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদীরা এর মধ্য দিয়ে জনগণের ওপর একটি সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। বিপরীতে যারা এই নীতি মানতে গেলে আবার মরতে হবে, গুম হতে হবে, কিংবা নানাভাবে রাষ্ট্রীয় দমন-নীতির শিকার হবে ভাবছে, তারা এই নীতির প্রচারকদের পিণ্ডি চটকে ছবি টানিয়ে জুতা মারছে, থুতু নিক্ষেপ করছে।

আমাদের অস্বীকারের সুযোগ নেই যে, ফ্যাসিজম কোনো সংগতিপূর্ণ বা রুচিশীল রাজনৈতিক চর্চা নয়, বরং এটি একটি অপমানজনক ও বিপজ্জনক চর্চা, যেখানে সহিষ্ণুতা এবং বিরোধিতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এটি মানবিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদাকে ধ্বংস করে এবং জনগণের মনোভাবকে একরোখা ও একঘেয়ে করে তোলে। অন্যদিকে ‘ফ্যাসিজম’ শব্দটির সুলভ ব্যবহারের বিপদ অনেক। আর বিশেষ করে কাউন্টার-হেজেমনি বনাম সাংকেতিক সহিংসতাকে বিশ্লেষণ করতে গেলে এটা আরো জরুরি হয়ে ওঠে।

‘থুতু নিক্ষেপ ও জুতা মারা’ কোন দিক থেকে অনিবার্য আর কী কী মানদণ্ড থেকে বিপজ্জনক, সেটা নিহিত রয়েছে হেজেমনি ভাঙার ক্ষেত্রে বহু বছর আগে রেখে যাওয়া গ্রামশির বক্তব্যে। রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের বিপরীতে সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব অর্জনের লড়াই, যা যুক্তি, আর্কাইভ এবং আর্টের মাধ্যমে অনিবার্য হতে পারে, সেখানে জুতো ছোড়া কিংবা গালি দেওয়া কোনো কার্যকর কাউন্টার-হেজেমনি হতে পারে না। উল্টো এটাকে সাংকেতিক সহিংসতা তথা সিম্বোলিক ভায়োলেন্সের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা যায়। চীনের কালচারাল রেভোলুশনের উন্মেষ পর্ব, আমেরিকার ম্যাককারথিজম, কিংবা নাৎসিদের শিল্প প্রোপাগান্ডার শুরুটা অবশ্য হয়েছিল ‘অন্যকে অপমানের’ মাধ্যমে এবং শেষ হয়েছিল ‘সংস্কৃতির অপমৃত্যু’ দিয়ে।

তবে ফ্যাসিবাদের মেমরি পলিটিক্স ও পার্টি মনোপলি মানুষকে বিপথগামী করার অন্যতম কারণ হতে পারে। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয় স্মৃতির পরিবর্তে দলীয় স্মৃতিতে পরিণত করেছে এবং এটি যথার্থ সমালোচনার দাবি রাখে। তবে সেই সমালোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিল্পী ও কর্মীদের গায়ে ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ ট্যাগ লাগানো এবং জুতো ছোড়ার মতো অশোভন আচরণ করা, একে মিরর স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করে। যেখানে ‘ফ্যাসিজম-বিরোধিতা’ আসলে নিজেই ফ্যাসিজমের রূপ নেবে, তা কখনো মুক্তি হতে পারে না। ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে এটি কখনোই প্রতিস্থাপন কিংবা নকল হতে পারে না, বরং বাস্তবের মাপকাঠিতে তা দাঁড়াতে হবে।

‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’দের জুতো ছোড়ার কারণে চলমান রাজনৈতিক বিতর্কে সবচেয়ে বড় বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে শেখ মুজিবকে একপেশে গৌরবিত বা অপমানিত করার যুক্তিগুলো। এখানে যেই যুক্তিতর্কে হেরে যাচ্ছে, সেই শেখ মুজিবের শাসন (১৯৭২–১৯৭৫) নিয়ে যে সমালোচনা কিংবা আরোপিত গৌরবগাথা রয়েছে, সেগুলোকে নিজের মতো তুলে ধরে ‘দেবত্ব’ কিংবা ‘ইবলিশি’ আরোপ করা হচ্ছে। ফলে ঐতিহাসিকভাবেই ন্যায়সংগত—দুর্ভিক্ষ, রক্ষীবাহিনী, দমননীতি এর সবই প্রতিষ্ঠিত সত্য ও তথ্যনির্ভর আলোচনা হলেও তা তর্কের টেবিল থেকে ছিটকে যাচ্ছে।

ইতিহাসতত্ত্বের ন্যূনতম ধারণা থাকলে যেকোনো ঐতিহাসিক চরিত্রকে একপেশেভাবে গৌরবিত বা অপমানিত করার পরিণতি কীভাবে অতি বিপজ্জনক, তা বোঝা সম্ভব হবে। কোনো রাষ্ট্রনেতাকে অবমূল্যায়ন বা অতিরঞ্জিত গৌরব দেওয়া থেকে মুক্ত হতে হলে, তার অবদান ও ব্যর্থতা উভয়ই বৈধভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। কিন্তু নৈতিক দেউলিয়াত্ব বনাম রাজনৈতিক পরিপক্বতার দ্বৈরথ আমাদের সেই আলোচনার টেবিল থেকে বারংবার লাথি মেরে নিচে ফেলে দেয়। কারণ উদ্দিষ্ট ব্যক্তির শাসনকালের দুর্ভিক্ষ, রক্ষীবাহিনী ও রাজনৈতিক দমননীতি নিয়ে যারা আলোচনা করছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যেমন স্পষ্ট।

তার ওপর দেবত্ব আরোপ করে যারা আরাধনায় লিপ্ত হয়েছে, তাদের অতীত অপকর্ম জাতির সামনে প্রকাশিত। তাদের অনেকে হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগে ইতোমধ্যে আত্মগোপনে। এর বাইরে সুশীল কিংবা সেলিব্রিটি ভাব নিয়ে যারা এই দেবত্ব আরোপের সাংস্কৃতিক ভিত্তি রচনায় শ্রম দিচ্ছেন, বাস্তবে তাদেরও একটি রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে, যা অতীতে তাদের অধিপতিশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। তাই মনোদৈহিক আধিপত্যবাদ এবং সাংস্কৃতিক হীনম্মন্যতা থেকে যে বিভাজন আজ থেকে এক যুগ আগে শাহবাগে সূচনালাভ করেছিল, তার ‘সাংস্কৃতিক ক্ষত’ সারতে আরো সময় লাগবে।

তাই রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার সমালোচনাকে সরিয়ে দিয়ে ‘পরিবারের সদস্যদের হত্যা নিয়ে জঘন্য কৌতুক তথা ব্যঙ্গ করা’, এটাকে ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিকৃতি ও জিঘাংসার অনিবার্য উত্তরাধিকার। সংস্কৃতির প্রতি এই অসহিষ্ণুতা, মানবিক মর্যাদার এই অবমাননা এবং বৈচিত্র্যময় চিন্তাভাবনার অনুপস্থিতি সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে মুখোমুখি নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। সাংস্কৃতিক নৈতিকতা ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পরিপক্বতা অর্জন ব্যতিরেকে এর থেকে সহসা মুক্তি মিলছে না।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ