৫ আগস্ট, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল স্বৈরাচারী হাসিনা ও তার দোসরদের পলায়নের মধ্য দিয়ে। প্রায় ২০০০ শহীদ, ৩০০০০ আহতের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত সেই স্বাধীনতা এক নতুন দিগন্তের আশা জাগিয়েছিল। সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল এমন এক বাংলাদেশের, যেখানে ধর্ম, জাতি বা শ্রেণি নয়; মর্যাদা, অধিকার ও ন্যায়ের ভিত্তিতে হবে রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি।
কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, সেই আশার দেয়ালে একের পর এক ধাক্কা লেগেছে। যে চেতনাকে কেন্দ্র করে এই গণজাগরণ শুরু হয়েছিল, সেই চেতনার অন্যতম স্তম্ভ—বৈষম্য দূর করা, সমতা প্রতিষ্ঠা করা। তবে করুণ বাস্তবতা হলো, যে শহীদরা এই পরিবর্তনের জন্য রক্ত দিয়েছেন, তাদের মধ্যেও রাষ্ট্র বৈষম্যের প্রাচীর তুলে দিয়েছে। লজ্জাজনক হলেও সত্য, আজ প্রশ্ন উঠছে, যে আদর্শের জন্য তরুণরা প্রাণ দিল, সেই আদর্শকেই কি রাষ্ট্র অস্বীকার করছে? শহীদের আত্মত্যাগের চেয়েও কি তার জাতিগত পরিচয় বড় হয়ে উঠছে?
এই বেদনাদায়ক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে তাকাতে হয় মোহাম্মদপুরের ১৯ বছর বয়সি শহীদ রনির দিকে। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন রনি প্রতিদিন অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন; তার জীবন ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন না, ছিলেন একজন সাধারণ নাগরিকÑযিনি শুধু আর দশজনের মতো একটি নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ চেয়েছিলেন। দেশের ডাকে, ন্যায়ের সংগ্রামে যোগ দিতে তাই তিনি দ্বিধা করেননি। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই, যখন ঢাকার রাজপথ ছাত্র-জনতার উত্তাল মিছিলে মুখরিত, রনিও সেই ঐতিহাসিক গণজাগরণের অংশ হতে ছুটে এসেছিলেন।
মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে যখন পুলিশ ও ছাত্রলীগের সম্মিলিত আক্রমণে চারদিক প্রকম্পিত, তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তৎক্ষণাৎ তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। যে তরুণ পরিবারের হাল ধরেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি উন্নত জীবনের, সেই তরুণ দেশের জন্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ‘বিহারি’ পরিচয়টি যেন তার আত্মত্যাগের চেয়েও বড় হয়ে উঠল। শহীদের তালিকায় তার নাম তোলা হয়নি, শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি মেলেনি। তার আত্মত্যাগ যেন এক অদৃশ্য দেয়ালের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে, যেখানে তার নাগরিকত্ব নিয়ে রাষ্ট্রের প্রশ্ন তার বীরত্বকে ম্লান করে দিয়েছে।
একইভাবে নতুন স্বাধীনতা লেখা হয়েছিল কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ের তরুণ নূর মোস্তফার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। এই মাটিতেই যার জন্ম, যার বেড়ে ওঠা—তিনিও দাঁড়িয়েছিলেন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। তার স্বপ্নগুলো ছিল এই বাংলাদেশকে ঘিরেই। ২০২৪ সালের ২০ জুলাই, কক্সবাজারের ঈদগাঁওতে একটি মিছিল চলাকালে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন নূর মোস্তফা।
ভয়াবহতা দেখে কাঁদতেন নারী কর্মকর্তারাওভয়াবহতা দেখে কাঁদতেন নারী কর্মকর্তারাও
সহযোদ্ধারা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলেও, সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার আত্মত্যাগের পর রাষ্ট্র তার জন্ম বা আত্মত্যাগকে বিবেচনায় না নিয়ে খুঁজল তার রোহিঙ্গা অভিবাসী মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র। সেই কাগজের অভাবে শহীদের মর্যাদা পেলেন না নূর মোস্তফা। যে তরুণ একটি পরিচয়হীনতার ভবিষ্যৎ থেকে মুক্তি পেতে দেশের মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিলেন, রাষ্ট্র তাকেই পরিচয়হীনতার অন্ধকারে ঠেলে দিল। তার পরিবার আজ একাধারে তাদের সন্তান হারানোর বেদনা এবং রাষ্ট্রীয় অবহেলার দ্বিগুণ যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছে।
নূর মোস্তফার বাবা মো. শফি আলম তার ছেলের স্বীকৃতির জন্য আকুল আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আর দশজন যেভাবে শহীদ হইছে দেশের জন্য, সবাইকে যেই মর্যাদা দেওয়া হইছে, আমার ছেলেকেও যেন সেই মর্যাদাটা দেওয়া হয়—আমার আর কোনো চাওয়া নাই। টাকাপয়সা দিয়ে আমি কী করবো?...’ আন্দোলন-সংগ্রাম করেও নূর মোস্তফাকে শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি!
এই দুটি ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন অবহেলা নয়, বরং রাষ্ট্রের গভীরে প্রোথিত এক ভয়ংকর মানসিকতার প্রতিফলন। একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম কর্তব্য হলো তার ভূখণ্ডে বসবাসকারী সবার মর্যাদা নিশ্চিত করা। শহীদদের স্বীকৃতি অস্বীকার করার মাধ্যমে রাষ্ট্র শুধু তার দায়িত্বকেই অস্বীকার করছে না, বরং ঐতিহাসিক অবিচারগুলোকে (যেমন বিহারি সম্প্রদায়ের নাগরিকত্বের সংকট) জিইয়ে রাখছে। এটি একাধারে অগণতান্ত্রিক এবং অমানবিক।
একজন শহীদের আত্মত্যাগ কি তার জাতি, ধর্ম বা আইনি পরিচয়ের নিরিখে বিচার্য? নাকি অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার অকুতোভয় অবস্থানই তার সবচেয়ে বড় পরিচয়? যে ‘জুলাই চেতনা’র কথা বলে আমরা স্বৈরশাসনের পতন ঘটালাম, সেই চেতনার ভিত্তিই তো ছিল সব ধরনের বৈষম্যের বিলোপ। আজ যদি শহীদদের মধ্যেই ‘আমাদের’ ও ‘ওদের’ বিভাজন তৈরি করা হয়, তবে সেই চেতনার নৈতিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এটি শুধু কিছু মানুষের প্রতি অবিচার নয়, এটি সেই বিপ্লবের মূল ভিত্তিকেই নাড়িয়ে দেয়।
এই দায় শুধু সরকারের নয়। যে ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ বা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে বিপ্লবের কথা বলছে, তাদেরও এই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রতিটি শহীদের আত্মত্যাগের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতি নিশ্চিত করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাদের এই নীরবতা কি রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ, নাকি স্রেফ উদাসীনতা? প্রতিটি শহীদের মর্যাদাকে সমানভাবে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে এই আন্দোলন তার মহত্ত্ব হারাবে এবং এর অর্জনগুলো ভবিষ্যতে ম্লান হয়ে যাবে।
রনি বা নূর মোস্তফার পরিবার আজ নীরবে অশ্রু ঝরাচ্ছে। অবিলম্বে এই অবহেলিত শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়া হোক। এটি শুধু কয়েকটি পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া নয়, এটি নতুন বাংলাদেশের আত্মপরিচয় এবং নৈতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার প্রথম পরীক্ষা। এই দায় স্বীকারে ব্যর্থ হলে দুই হাজার শহীদের আত্মত্যাগ এক অসমাপ্ত বিপ্লবের দীর্ঘশ্বাস হয়েই থাকবে, যা আগামী দিনে আমাদের তাড়া করে ফিরবে।
লেখক : সাবেক ডাকসু নেতা ও প্রধান সমন্বয়কারী, ঢাকা মহানগর উত্তর, জাতীয় নাগরিক পার্টি
বিষয়: শহীদ