প্রতিবছরের মতো এবারও বাড়ছে ডেঙ্গু। আষাঢ়ের প্রথম বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে শহরের ধুলো, কিন্তু ধুয়ে যায়নি ডেঙ্গু আতঙ্ক। বরং সেই ভেজা আবহে আবার জন্ম নিচ্ছে প্রাণঘাতী এডিস মশা। ঢাকার অলিগলি থেকে শুরু করে জেলা শহর—প্রতিটি ড্রেন, জমে থাকা পানি, ছাদে রাখা ফুলের টব কিংবা পরিত্যক্ত নির্মাণ স্থল যেন হয়ে উঠেছে এক-একটি মশা উৎপাদনের কারখানা।
গত দুই বছর বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল নজিরবিহীন। ২০২২ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ৬২ হাজার, মৃত্যু হয়েছিল ২৮১ জনের। আর ২০২৩ সালে সেই ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল আগের সব রেকর্ড—আক্রান্ত হয়েছিলেন তিন লক্ষাধিক মানুষ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়ায় ১ হাজার ৭০৫ জন, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুজনিত সর্বোচ্চ প্রাণহানির রেকর্ড। আর ২০২৪-এর শেষভাগে স্বস্তি দিলেও, ২০২৫ সালের জুন মাসের মধ্যেই ফের সেই আতঙ্ক ফিরে এসেছে। কয়েক দিন ধরেই রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় হুহু করে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। প্রতিদিন হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হচ্ছে শত শত রোগী।
চলতি বছরে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর আসছে। মশার ওষুধ ছিটানো হলেও সুফল মিলছে না। ফগার মেশিনের শব্দ যতটা প্রচার সৃষ্টি করছে, ততটা প্রতিকার দিচ্ছে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের মূল ব্যর্থতা হলো মশা নিধনে দুর্বল ও প্রায় অকার্যকর কার্যক্রম। প্রতিবারই সিটি করপোরেশন থেকে শুরু হয় ‘মশা মারার অভিযান’, কিন্তু তা হয় প্রচারণাধর্মী, বাস্তবিক প্রতিকারমূলক নয়। কীটনাশক কতটা কার্যকর, তা যাচাইয়ের মতো তেমন গবেষণা নেই। ওষুধে মশা মরছে না—এই অভিযোগ বহুবার গণমাধ্যমে এসেছে, তবু পরিবর্তনের উদ্যোগ দেখা যায়নি।
জনসচেতনতার অভাবও এই ব্যর্থতায় বড় ভূমিকা রাখে। সাধারণ মানুষ এখনো জানে না কোথায় কোথায় এডিস মশা বংশবিস্তার করে। অনেকেই ভাবেন ডেঙ্গু শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক সমস্যা অথচ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই এখন এর বিস্তার। মানুষ নিজের ঘরের চারপাশ পরিষ্কার রাখার গুরুত্ব বোঝে না। কেউ বোঝায়ও না।
আরো বড় দুর্বলতা হলো সমন্বিত উদ্যোগের অভাব। স্থানীয় সরকার, সিটি করপোরেশন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে নেই কোনো সুষ্ঠু সমন্বয়। একপক্ষ দায়িত্ব আরোপ করে আরেক পক্ষের ওপর, ফলে কার্যকর কোনো পদক্ষেপে পৌঁছানো যায় না।
ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা বহু বছর ধরে অপরিকল্পিত। প্লাস্টিকে ভরা ড্রেন, বন্ধ নালা, ময়লায় আটকে থাকা পানি—সব মিলে তৈরি হচ্ছে মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে স্যানিটেশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা।
আরো গভীর সমস্যা হলো গবেষণার অভাব। টাকার অভাবে ডেঙ্গুর মৃত্যু পর্যালোচনা বন্ধ রয়েছে। দেশে এখনো কীটতত্ত্ববিদের সংখ্যা অপ্রতুল। ডেঙ্গু ভাইরাসের বর্তমান ধরন, এর রূপান্তর ক্ষমতা এবং সংক্রমণের সময়কাল সম্পর্কে সময়োপযোগী গবেষণা হয়নি বললেই চলে। প্রতিবারই নতুন ধরনের ডেঙ্গু এসে ফেলে সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে।
ঢাকার বাইরে এখনো ডেঙ্গু পরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। ফলে প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষ রোগ নির্ণয়ের আগেই প্রাণ হারাচ্ছে। সরকারের উচিত কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা, ব্লাড স্যাম্পল সংগ্রহের জন্য নগরীর বিভিন্ন জায়গায় সহজলভ্য বুথ করাসহ আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া এবং প্রশাসনিক সমন্বয় জোরদার করা। ডেঙ্গু একটি মৌসুমি সমস্যা—এই মনোভাব থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এটি এখন বছরের পর বছর চলা এক সামাজিক-স্বাস্থ্যগত সংকট। একে প্রতিরোধে অবহেলা মানেই নতুন করে মৃত্যু মেনে নেওয়া। সচেতনতা ও ব্যবস্থাপনা—এই দুই শক্তির সমন্বয়েই শুধু সম্ভব এক সুস্থ ও ডেঙ্গুমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক
কনসালট্যান্ট, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা
বিষয়: ডেঙ্গু