রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের‘মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান’কবিতাটি তার প্রথম দিকের রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি সম্ভবত ১৮৮০-এর দশকে লেখা হয়েছিল। এই গানে মৃত্যু এবং ঈশ্বরের প্রতি শান্ত অভিব্যক্তি রয়েছে। কারণ কবি মৃত্যুকে শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণ-এর মতোই সুন্দর হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই কবিতাটি রচনা করার বহুকাল পরে কবি সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে আরেকটি কবিতা লেখেন
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।...’
প্রকৃত অর্থে আমরা বাঁচতে চাই আমার আপনজনের সঙ্গে। কিন্তু মৃত্যুর মতো অনিবার্য ও নিষ্ঠুর সত্য আর নেই।
আজ ৬ জুলাই মহিমান্বিত ও পবিত্র আশুরার দিনে অর্থাৎ ১০ মহররম প্রিয়ভাজন আবদাল আহমদের একটি ছোট পোস্ট থেকে জানতে পারলাম আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মমতাময়ী মা এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে, তার একমাত্র প্রিয় পুত্রের ভালোবাসার বন্ধন চিরদিনের জন্য ছিন্ন করে বিদায় নিয়েছেন।
মানুষের মন কত দ্রুত বিচরণশীল। মুহূর্তে আমার মনের জগতে কত স্মৃতি ভেসে উঠল। আমি তখন ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষক। বয়সে তরুণ। বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে ১৯৮৭ সালে এই কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একজন প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৯ এই ১২ বছর সেখানে শিক্ষকতা পেশায় রত ছিলাম। আমার সৌভাগ্য, এ সময় আমি অসংখ্য সিনিয়র সহকর্মী পাই যারা নানা সংকটে আমার পাশে দাঁড়িয়ে কখনো বড় বোনের মতো, কখনো মায়ের মতো স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি এ রকম একসময় মাহমুদা বেগমকে এই কলেজে সহকর্মী হিসেবে পাই।
শিক্ষকতার পাশাপাশি কলেজ কর্তৃপক্ষ আমার ওপর আরো তিনটি অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। কলেজের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আমাকে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিনের দায়িত্বও ছিল আমার ওপর। এই দুটি দায়িত্ব আমি আনন্দের সঙ্গে সম্পন্ন করতাম। আরেকটি দায়িত্ব ছিল আমার ওপর তা হলো, শৃঙ্খলা কমিটির অন্যতম সদস্য। এটি সত্যি একটি চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব ছিল।
তখন সম্ভবত জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। স্বাভাবিকভাবে কলেজের ছাত্রদলের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি। ওর ডাকনাম ছিল হারু। সম্ভবত ছাত্রদলের কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক। শিক্ষকদের মুখে ওর কথা শুনে আমার ধারণা হলো ও ডানপিটে, স্বভাবে দুর্দমনীয় ও দুর্বিনীত। বিপরীত দিকে ছাত্রলীগ কলেজ শাখার সভাপতি, সম্ভবত তার ডাক নাম ছিল আঁখি। আমি শুনতে পেতামÑকলেজ প্রাঙ্গণের বাইরে এই দুই ছাত্রনেতার নেতৃত্বে মারামারি হয়Ñএমনকি সেটি রক্তাক্ত পর্যায়ে পৌঁছে। এসব খবর আমাকে চিন্তিত করত। শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য হিসেবে আমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল কলেজ প্রাঙ্গণে যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, তা প্রতিহত করা। কিন্তু কীভাবে করব বুঝতে পারছিলাম না।
একদিন কলেজের দোতলা ভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে বেশ চিন্তিত হয়ে বসে আছি। একজন প্রবীণ শিক্ষয়িত্রী আমার অদূরে বসা। সম্ভবত সবুজপাড়ের সাদা শাড়ি পরিহিতা। শ্যামবর্ণ। আমার পাশে এসে বসলেন। স্নেহভরা কণ্ঠ। বললেন, ‘সিরাজ সাহেব চিন্তিত মনে হচ্ছে আপনাকে।’ আমি আমার উদ্বেগের কারণ তাকে বললাম। মুখে তার স্মিত হাসি। বললেন, ‘এটি তো চিন্তিত হওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়। আপনি একজন শিক্ষক। ছাত্রদের মূল্যবোধ এখনো মাটিতে মিশে যায়নি। আপনি ওদের কাছে যান, সরাসরি কথা বলুন। আমার মনে হয় না আপনি নিরাশ হবেন।’ তার কথায় যুগপৎ স্নেহ ও সুদৃঢ় বিশ্বাস। তিনি দীর্ঘকাল এই পথে হেঁটেছেন। এ ক্ষেত্রে তার ভুল হওয়ার কথা নয়।
আমি পরের দিন প্রথমেই ছাত্রলীগের কলেজ শাখার সভাপতি আঁখির সঙ্গে কথা বললাম। আমার এখন আরেক ছাত্রনেতার কথা মনে পড়ছে। ছাত্রদলের সম্ভবত সভাপতি, নাম তার আনোয়ার। সত্যিকার অর্থে আমি এই তিন নেতার সঙ্গে পৃথকভাবে কথা বলার পর ওই প্রবীণ শিক্ষয়িত্রীর আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মর্ম খুঁজে পেলাম। এরা কেউই আমাকে নিরাশ করেনি এবং যতদিন আমি এই দায়িত্বে ছিলাম, তাদের কাছ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়েছি।
কে ছিলেন এই শিক্ষয়িত্রী। নাম তার মাহমুদা বেগম। এরপর থেকে পেশাবৃত্তির বাইরে এই শিক্ষয়িত্রীর সঙ্গে আমার এক সখ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখিÑতিনি স্নেহের। এ এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
একদিনের কথা। মাহমুদা আপার মুখচ্ছবি দেখে মনে হলো তিনি মনের দিক থেকে খুব বিচলিত। উদ্বিগ্ন। এগিয়ে গিয়ে চেয়ারসংলগ্ন হয়ে একটা চেয়ার টেনে নিলাম। ‘আপা কী হয়েছে? মনে হচ্ছে আপনি মানসিকভাবে বিচলিত’। কোনো ভূমিকা বা রাখঢাক না করেই বললেন, ‘আমার ছেলে অসুস্থ। ও আমার একমাত্র সন্তান। আমার গোটা পৃথিবী...।’ স্বামীহারা এই মায়ের দুই চোখ আর্দ্র হয়ে এলো। আমি নিঃশব্দে কিছুক্ষণ এই মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খুব দ্রুত আমার নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। আমি রোগশয্যায় শায়িত হলে তিনি রাব্বুল আলামিনের দরবারে দুহাত তুলে বলতেন, ‘হে রাহমানুর রাহিম ও আমার নাড়িছেঁড়া ধন। আমার কাছ থেকে ওকে আপনি কেড়ে নেবেন না...।’ আপার দুচোখ টলটল করছে। আমার নিজের চোখ আর কণ্ঠ অজান্তে ভিজে গেল। বললাম, ‘তাহলে কলেজে এসেছেন কেন। ছুটি নিতে পারতেন। ছেলের পাশে থাকলে এত খারাপ লাগত না।’ তিনি আমার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ‘আজ ডিগ্রিতে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস রয়েছে। ওরাও তো আমার সন্তান।’
মাহমুদা আপার একমাত্র পুত্রসন্তান কে, কী করেন তিনি না কোনো প্রশ্নই আমি তাকে করিনি। কারণ সব মায়ের কাছে পুত্রের পরিচয় একটাই আর তা হচ্ছে সন্তান। নিজের গর্ভে ধারণ করা সন্তান।
অনেক দিন পরের কথা। জীবন-জীবিকার যুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে তখন কলেজের শিক্ষকতার পাশাপাশি মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদিত প্রথমে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা এবং পরে দৈনিক মানবজমিনে খণ্ডকালীন পেশায় নিয়োজিত। জনাব চৌধুরী একদিন আমাকে নিয়ে গেলেন মতিঝিলে জীবন বীমা ভবনে। বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগ বোর্ডের অফিস। সেখানে পরিচয় হলো বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে। লাল কার্পেট বিছানো বিশাল কক্ষ। ভদ্রলোক সপ্রাণ। চটপটে। সপ্রতিভ। কথাবার্তায় মনে হলো অসম্ভব মেধাবী, যা বিশ্বাস করেন সরাসরি বলেন। চৌধুরী সাহেব আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমাদের অর্থনীতিবিষয়ক রিপোর্টার। একই সঙ্গে অর্থনীতি পাতারও দায়িত্বে।’ একসময় আমরা তার কক্ষ ছেড়ে চলে এলাম। সেই হলো সম্পর্কের সূত্রপাত। এরপর সেই সম্পর্ক দিনে দিনে অটুট হয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন করতে গিয়ে তার উদ্ধৃতি ব্যবহার না করলেই নয়। এমন রশ্মিকেন্দ্রীভূত উদ্ধৃতি আমি আর কার কাছে পাব! আমার অর্থনীতি ও জ্বালানিবিষয়ক প্রতিবেদনের জন্য যে মুষ্টিমেয় তথ্যের উৎস রয়েছে তিনি তাদের অন্যতম।
একদিন আমাকে তার বাসভবনে যেতে হলো সম্ভবত রয়টার্সের কোনো রিপোর্টের জন্য অথবা সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। তার বাসার অবস্থান আমার ঠিকভাবে মনে নেইÑসম্ভবত গুলশান অথবা বনানী। যা হোক, আমি বসার ঘরে মাহমুদ ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। তিনি বাইরেÑতবে ঘরে খবর পাঠিয়েছেন আতিথেয়তায় যেন কোনো ত্রুটি না হয়। চা-নাশতা এলো। আর পেছনে এলেন এক ভদ্রমহিলা। মুখে স্মিত হাসি। কোনো ভূমিকা নেই। ‘সিরাজ সাহেব কেমন আছেন?’ আমি মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত। একঝাঁক প্রশ্ন আমার মনে। ‘আপনি এখানে?’ তিনি স্বভাবসুলভ মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনাদের মাহমুদ ভাই আমার পুত্র, একমাত্র সন্তান। আপনি আসবেন ও আমাকে ফোনে জানিয়েছে। আমি তখনই চিনতে পেরেছি। মাহমুদের কাছে অনেকেই আসেন তবে আমি তাদের সামনে আসি না।’
সেদিন আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু আজ ঠিক বুঝতে পারলাম এ রকম মেধাবী, সত্য উচ্চারণে সাহসী সন্তান মায়ের কাছে তো ‘আমার গোটা পৃথিবী’-ই হবে।
একদিন আমি আমার মাকে গ্রামের বাড়িতে কবরে শায়িত করে এসেছিলাম। কি বৃষ্টি সেদিন। গোটা পৃথিবী যেন আমার সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তারপরও আমরা তাকে মাটির বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলেছিলাম ‘মিনহা খালাকনাকুম ওয়া ফি হা নুয়িদুকুম, ওয়া মিনহা নুখরিজুকুম তারাতান উখরা।’ ‘আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি এবং এতেই তোমাদের ফিরিয়ে দেব। আর পুনরায় এ থেকেই তোমাদের উত্থিত করব।’
আল্লাহ মাহমুদা আপাকে, সকল মাকে বেহেশত নসিব করুন।
লেখক : রয়টার্সের সাবেক ব্যুরোপ্রধান