সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি এর কিছু নেতিবাচক দিকও প্রকট হয়ে উঠছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে এই মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় কাটানোর প্রবণতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেকেই দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুক, টিকটক, ইনস্টাগ্রামে স্ক্রল করতে করতে বা ভার্চুয়াল জগতে বিচরণ করতে ব্যয় করে। কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য খোঁজার জন্য ফোন হাতে নিলেও স্ক্রল করতে করতে ভুলে যাচ্ছে সে কী জন্য অনলাইনে এসেছিল। ফলে পড়াশোনা, কর্মজীবন, ব্যক্তিগত সম্পর্কসহ বাস্তব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটালে মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। অতিরিক্ত ব্যবহার একদিকে মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে, অন্যদিকে সৃষ্টিশীলতা ও উৎপাদনশীলতাও কমিয়ে দেয়। কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ফোমো (Fear of Missing Out) বা ‘কিছু মিস হয়ে যাচ্ছে’ এমন এক অবিরাম উদ্বেগ জন্ম নেয়, যা মানসিক চাপ এবং বিষণ্ণতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ভার্চুয়াল জগতে অন্যের জীবন দেখে নিজের জীবনকে তুলনা করা এবং নিজের প্রতি অপ্রাপ্তির অনুভূতি তৈরি হওয়াও আজকের তরুণদের মধ্যে প্রচলিত একটি সমস্যা। ফলে বহু তরুণ ও কিশোর অনিচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করে, যা কখনো কখনো চরম হতাশা বা আত্মহননের প্রবণতার দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয় ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু মানসিক স্বাস্থ্য নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আসক্তি ব্যক্তিগত সম্পর্কেও ফাটল ধরাচ্ছে। একসঙ্গে বসে থেকেও পরিবারের সদস্য বা বন্ধুরা মোবাইল স্ক্রিনে মুখ গুঁজে থাকছে। বাস্তবিক যোগাযোগ কমে গিয়ে তৈরি হচ্ছে দূরত্ব, ভুল বোঝাবুঝি ও সম্পর্কের ভাঙন। মানবিক অনুভূতি, সহমর্মিতা এবং আন্তরিকতা হারাতে বসেছে এই ভার্চুয়ালনির্ভর প্রজন্ম।

সাইবার বুলিং, অনলাইন হ্যারাসমেন্ট, গুজব ছড়িয়ে দাঙ্গা উসকে দেওয়া, ভুয়া খবরের বিস্তার—এসবও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত এবং অপরিকল্পিত ব্যবহারের নেতিবাচক ফল। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন, তথ্য চুরি এবং অনলাইন স্ক্যামের মতো অপরাধও দিন দিন বেড়ে চলেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে ‘ডিজিটাল ডিটক্স’ (Digital Detox) বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিরতি নেওয়া এখন অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে প্রয়োজন প্রযুক্তির সচেতন ব্যবহার—নিজের ব্যবহারের সময়সীমা নির্ধারণ করা, প্রয়োজনের বাইরে স্ক্রল বন্ধ করা এবং বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ও কাজের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আমাদের জীবনে প্রযুক্তির সম্ভাবনার পাশাপাশি এক ধরনের ‘ডিজিটাল বন্দিত্ব’ও এনে দিয়েছে। প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে, নাকি আমরা প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করব সেই সিদ্ধান্ত আমাদের নিজেদেরই নিতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহারে দায়িত্ববোধ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণই পারে আমাদের এই আসক্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে বাস্তব জীবনের সৌন্দর্য ও সাফল্যের স্বাদ উপভোগ করতে। মনে রাখতে হবে, বাস্তব জীবনই আসল জীবন—ভার্চুয়াল নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র, আমার দেশ