বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ পরিকল্পনায় সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে অসংখ্য ফিলিস্তিনির মৃত্যুর খবরের দিকে নিবদ্ধ। আর এই সুযোগে ইসরাইল নীরবেই অধিকৃত পশ্চিম তীরকেও গ্রাস করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে এনেছে। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানিয়েছে, গত ২৩ জুলাই বুধবার ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেট অধিকৃত পশ্চিম তীরকে নিজেদের অংশ হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রতীকী প্রস্তাব পাস করেছে। যদিও এর কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই, তবে এটি পশ্চিম তীরে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ফিলিস্তিনি নেতারা। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সহযোগী হুসেইন আল-শেখ বলেছেন, ইসরাইলের এই প্রস্তাব ফিলিস্তিনিদের অধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত। এই পদক্ষেপ শান্তি, স্থিতিশীলতা ও দুই-রাষ্ট্র সমাধানের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করবে। ইসরাইলের একতরফা এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক আইন ও ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের স্বীকৃত মর্যাদার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইসরাইলের এ ধরনের উদ্যোগ দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক শান্তিপূর্ণ সমাধানকে ধ্বংস করছে এবং বসতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিদিনই দখল করে চলেছে নতুন নতুন এলাকা।
পশ্চিম তীরকে গ্রাস করার লক্ষ্যে আনা এই প্রস্তাবটি ৭১-১৩ ভোটে পাস হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইসরাইল ‘ইয়েহুদি, সামারিয়া ও জর্ডান উপত্যকায়’ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। মূলত এই অঞ্চলগুলোই ফিলিস্তিন ভূখণ্ড হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, যার মধ্যে অধিকৃত পশ্চিম তীর অন্যতম। প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়িয়ে পার্লামেন্টে ইহুদি নেতারা বলেছেন, পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সঙ্গে যুক্ত করা হলে তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা আরো সুদৃঢ় করবে এবং ‘ইহুদি জনগণ তাদের নিজ ভূখণ্ডে শান্তিপূর্ণ বসবাসের মৌলিক অধিকার’ লাভ করবে। তখন আর কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না।
অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৬১ শতাংশ এলাকাই ইসরাইলের সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের দখলে রয়েছে। এই এলাকায় বসবাসরত ইহুদির সংখ্যা প্রায় সাত লাখ। বাকি ৩৯ শতাংশ এলাকা মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করলেও এর অনেক জায়গাই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ইসরাইলের অব্যাহত দখলদারত্বের কারণে। ক্রমাগত সংকুচিত এই এলাকার মধ্যেই বসবাস করছে প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি। কিন্তু এই এলাকাও ইসরাইল দখল করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে আনছে। ইসরাইলের পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবটি তারই প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি করছে।
গাজায় চলমান ভয়াবহ হামলার পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও সাম্প্রতিক সময়ে হামলা ও দখলের মাত্রা বাড়িয়েছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলোয় ইসরাইলি সেনাদের অব্যাহত অভিযান, গণগ্রেপ্তার, বাড়িঘর ধ্বংস এবং হতাহত করার ঘটনা বেড়েছে। সেনাদের সহায়তায় ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের সম্পত্তিতে হামলা ও দখল জোরদার করেছে সাম্প্রতিক সময়ে।
তুর্কি সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে এক প্রতিবেদনে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের কৃষিজমি দখল ও বাড়িঘর ধ্বংস করে ইহুদি বসতি স্থাপনের খবর দিয়েছে । এতে বলা হয়েছে, অবৈধ বসতি স্থাপনের মাধ্যমে গত কয়েক দশকে অধিকৃত পশ্চিম তীরের বিরাট অংশই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ইসরাইল। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর আমলে গত প্রায় তিন বছরে এই দখল প্রক্রিয়া কয়েক গুণ বেড়েছে। তিনি ২০২২ সালের শেষ দিকে ক্ষমতায় আসার পর থেকে পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি বা আবাসিক ভবনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১২ সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পার্লামেন্ট নেসেটের স্পিকার আমির ওহানা ও ১৪ মন্ত্রী পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখলকৃত এলাকা আরো বাড়ানোর দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কাছে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছেন। তারা সবাই নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টির সদস্য। চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, নেতানিয়াহুর সরকার গত আড়াই বছরে ৪১ হাজার ৭০৯টি নতুন অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে, যা তার আগের ছয় বছরে পশ্চিম তীরে অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের অনুমতি প্রদানের রেকর্ড ভেঙেছে। পশ্চিম তীরে শত শত নতুন বসতি স্থাপনের ঘোষণা, দ্রুত গতিতে অবৈধ স্থাপনা ও কৌশলগত সড়ক নির্মাণ এবং একের পর এক ফিলিস্তিনি ভবন ধ্বংস করার লক্ষ্য হলো পশ্চিম তীরে ইহুদিদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের প্রস্তাবকে নস্যাৎ করে দেওয়া।
তবে ইসরাইলি নেতারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যেকোনো উদ্যোগ প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এজন্যই তারা গাজা উপত্যকা ধ্বংস এবং এখান থেকে ২২ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে চাচ্ছেন। গাজার পাশাপাশি এখন অধিকৃত পশ্চিম তীরকেও এখন ইসরাইল তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। পশ্চিম তীরের সার্বভৌমত্ব ঘোষণার পরিকল্পনা তারই অংশ।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেছেন, কখনোই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হবে না। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় এ মন্তব্য করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে কাটজ লেখেন, ‘আমরা এমন একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরি করতে দেব না, যা আমাদের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে ফেলে এবং ইসরাইলি ভূমিতে আমাদের ঐতিহাসিক অধিকার লঙ্ঘন করে। এই গুরুতর হুমকি প্রতিরোধে আমরা ঐক্যবদ্ধ।’
ইসরাইল কাটজ ম্যাক্রোঁর এই সিদ্ধান্তকে ‘সন্ত্রাসবাদের কাছে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণ এবং হামাসকে সমর্থন ও পুরস্কৃত করা’ বলে অভিহিত করেন। এর আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ম্যাক্রোঁর সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি এই সিদ্ধান্তকে ‘এমন একটি পদক্ষেপ, যা সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত এবং আরেকটি ইরানি প্রক্সি তৈরির ঝুঁকি’ বলে অভিহত করেন।
সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজা উপকূলের গ্যাসক্ষেত্র ‘গাজা মেরিন’-এর মালিকানা এবং গ্যাস উত্তোলনের পূর্ণ অধিকার পাবে বলে জানিয়েছেন খনিজসম্পদ বিশেষজ্ঞ মাইকেল ব্যারন।
ব্যারনের মতে, বর্তমান বাজারদরে গাজা মেরিন থেকে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। তিনি জানান, ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর এই গ্যাস ফিল্ড থেকে গড়ে ১০ কোটি ডলার রাজস্ব পেতে পারে। রাজস্ব আয়ের এই ধারা ১৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তিনি বলেন, ‘এই আয়ে ফিলিস্তিন কাতার বা সিঙ্গাপুরে পরিণত না হলেও এটা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করবে। তারা বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।’
প্রায় তিন দশক ধরে গাজা উপকূলবর্তী এই গ্যাসক্ষেত্রটির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছে। আইনি জটিলতায় অনুসন্ধান কার্যক্রম বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনপন্থি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষে একটি আইনজীবী প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ইতালির রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ইএনআই’কে একটি সতর্কীকরণ চিঠি পাঠায়। সেখানে বলা হয়েছে, ইসরাইলের জ্বালানি মন্ত্রণালয় যে ‘জোন জি’ অঞ্চল নির্ধারণ করেছে, তার ৬২ শতাংশই ফিলিস্তিনের দাবি করা জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। অথচ ইসরাইল সেখানে ছয়টি গ্যাস অনুসন্ধান লাইসেন্স দিয়েছে বিদেশি কোম্পানিকে। ইসরাইল গায়ের জোরে ফিলিস্তিনি সম্পদ দখলে রেখেছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ র্যাপোটিয়ার ফ্রানচেসকা আলবানিজ সম্প্রতি বলেছেন, আন্তর্জাতিক আদালতের মতে, ইসরাইলের দখল অবৈধ। তাই যেকোনো বেসরকারি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এই দখলকৃত অঞ্চলে ব্যবসা বা বিনিয়োগ করলে তা বৈশ্বিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা যেন ইসরাইলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে সহায়ক পদক্ষেপে অংশ নেয়। তবে ইসরাইল এ দাবি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে।