মহান আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি (খলিফা) হিসেবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬৫, সূরা ফাতির, আয়াত-৯৩, সূরা হিজর, আয়াত : ৩২-৪৪) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারার ৩০ থেকে ৩৭নং আয়াতে মানুষ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন এবং পৃথিবীতে তাদের শয়তানের শত্রুতা মোকাবেলা করে কিছুকালের জন্য জীবনযাপন করার নির্দেশনা দান করেন।

৩০. স্মরণ করো! যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে যাচ্ছি। তখন তারা বলল, আপনি কি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও খুনখারাবি করবে? আমরা তো সর্বদাই আপনার প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণায় নিমগ্ন। আল্লাহ জবাবে বললেন, আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না।

৩৫. আমি বললাম, হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস করো। সব কিছু ইচ্ছামতো খাও। শুধু ওই গাছের কাছে যেও না। যদি যাও, তবে তোমরা জালেমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।

৩৬. কিন্তু শয়তান তাদের উভয়কেই প্রলুব্ধ করল। পরিণামে জান্নাত থেকে তারা বহিষ্কৃত হলো। আমি বললাম, (ইবলিশও) তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে দুনিয়ায় যাও। কিছুকালের জন্য তোমরা সেখানেই জীবনযাপন করবে।

৩৭. এরপর আদম তার প্রতিপালকের কাছ থেকে কিছু (দিকনির্দেশনামূলক) বাণী পেল। (গভীর অনুশোচনায়) সে তওবা করল। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। যদিও আমি বলেছিলাম, তোমরা সবাই এখান থেকে দুনিয়ায় যাও। তারপরও তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি অবশ্যই (যুগে যুগে) সত্যপথের দিকনির্দেশনা প্রেরণ করব। তখন যারা এই দিকনির্দেশনা অর্থাৎ নৈতিক বিধিবিধান অনুসরণ করবে, তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না। আর যারা এই সত্যপথের নৈতিক বিধিবিধান প্রত্যাখ্যান করবে, তারাই জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। সেখানেই থাকবে চিরকাল।

সূরা হিজরের ৩৯ থেকে ৪৪ আয়াতে আরো স্পষ্ট করা হয়- ৩৯. এরপর ইবলিশ বলল, হে আমার প্রতিপালক! তুমি যেহেতু আমার সব অর্জন (ফেরেশতাদের নেতা হিসেবে প্রাপ্ত সম্মান) ধূলিসাৎ করে দিয়েছ, আমিও পৃথিবীতে (সব ধরনের পাপাচারকে) মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তাদের পথভ্রষ্ট করব (স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে তাদের মর্যাদা ধূলিসাৎ করে দেবো)।

৪০. আমার কবল থেকে শুধু তারাই রক্ষা পাবে, যারা তোমার সত্যিকারের বান্দা।

৪১. আল্লাহ বললেন, আমার কাছে পৌঁছানোর এটাই সরল পথ।

৪২. আমার সত্যিকারের বান্দাদের ওপর তোমার কোনো প্রভাবই কার্যকরী হবে না।

৪৩. তোমার প্রভাব তাদের ওপরই থাকবে, যারা পথভ্রষ্ট হয়ে (স্বেচ্ছায়) তোমাকে অনুসরণ করবে...’

মানুষকে জ্ঞান বা শিক্ষাদানের মাধ্যমে ফেরেশতাদের ওপর তাদের শ্রেষ্ঠত্ব দান করা এবং ফেরেশতাদের মানুষ আদমকে সিজদা করার নির্দেশদানের তাৎপর্য মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে। ইবলিশ আদমকে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে বহিষ্কার করা এবং পৃথিবীতে মানুষের প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করে প্রেরণ করার মধ্যেও সবার জন্য রয়েছে উপলব্ধির যৌক্তিকতা। কেননা, শয়তানের প্ররোচনায় আদম আ: ও বিবি হাওয়া আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার প্রথম যে অন্যায় করেছিলেন তার পরিণতিতে মানুষকে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। মানুষকে বেহেশতচ্যুত করা হচ্ছে শয়তানের প্রথম এবং বড় বিজয়। এরপর আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবীতে তোমরা (শয়তান ও মানুষ) পরস্পরের শত্রু হিসেবে অবস্থান করবে। শয়তান আল্লাহর কাছ থেকে মানুষকে প্রতারিত করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং আল্লাহ বলেছেন, তিনি যুগে যুগে সত্যপথের দিকনির্দেশনা প্রেরণ করবেন। যারা সে মতো অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় বা দুঃখ থাকবে না। আর যারা শয়তানের প্ররোচনায় সত্য পথের নৈতিক বিধিবিধান প্রত্যাখ্যান করবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বা জাহান্নামের আগুনে পুড়বে। অর্থাৎ শয়তান যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছিল তাতে সে জয়লাভ করতে থাকলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত তো হবে এবং সবার ওপর আল্লাহ যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন শয়তানের প্রতি তাও বাস্তবায়িত হবে। এ ব্যাপারে সবসময় তাই সবার সচেতন থাকা উচিত। দৈনন্দিন জীবনে যখনই অন্যায় অনিয়ম বা আল্লাহর হুকুমের অমান্য বা বিরুদ্ধাচার করা হবে তখনই শয়তানের বিজয় হবে। সুতরাং শয়তান যেন বারবার জিতে না যায় সেদিকে সজাগ ও সক্রিয় থাকা প্রকারান্তরে আল্লার রহমত পাওয়ার বা সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম উপায়।

শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, সুফি সাধক খানবাহাদুর আহছানউল্লা (রহ.) তার ‘আমার জীবনধারা’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে কিছু কূট প্রশ্নের সমাধান’-শীর্ষক অধ্যায়ে ‘শয়তান বলিতে কী বুঝি’ পরিচ্ছেদে যা লিখেছেন তার উদ্ধৃতি এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক প্রতীয়মান হয়-

‘মানুষ সৃষ্টির সেরা, রবি-শশী, জিন ফেরেশতা মানুষের খেদমত করে। মানব-সৃষ্টির পূর্বে জিন ছিল, ফেরেশতাও ছিল, তবুও করুণামায় খোদা মানুষকে তাহার খলিফা বানাইতে ইচ্ছা করিলেন সৃষ্টির আদর্শস্বরূপ। তিনি স্বীয় আত্মা ফুঁকে দিলেন আদমের ভেতর, আর আদমকে সাধারণ মাটি দিয়া তৈরি করিলেন। তার খাদ্যের সহিত লোভ-মোহ প্রভৃতি প্রবৃত্তিরও সৃষ্টি করিলেন।

ফেরেশতার না আছে আহার, না আছে খাদ্যের বাসনা, না আছে নফছ। মানুষের সবই আছে; সে মাটি হইতে উৎপন্ন, যে মাটি সবারই পদদলিত। শক্তিশালী খোদার ইচ্ছা হইল, এই মাটির মানুষকে আগুনের ফেরেশতা হইতে উন্নততর করিবেন। তাই তিনি দয়া পরবশ হইয়া স্বীয় ছেফাতের কিয়দংশ ফুঁকিলেন মাটির আদমের মধ্যে। ফেরেশতারা নতশির হইল, আদমকে সেজদা দ্বারা ভক্তি জ্ঞাপন করিল। কিন্তু শয়তান সেজদা করিল না এবং সে যে করিবে না, খোদা তাহাও নিশ্চয়ই জ্ঞাত ছিলেন।

খোদা আদমের মধ্যে প্রবৃত্তির সৃষ্টি করিয়াছিলেন এই উদ্দেশ্যে যে, আদমজাত অহরহ প্রবৃত্তির সম্মুখীন হইয়াও, শয়তানের ধোঁকা খাইয়াও ফেরেশতার ঊর্ধ্বতন স্থান অধিকার করিবে। আর জ্ঞানময় খোদা আদমকে ঐ জ্ঞান দিলেন, যে জ্ঞান দ্বারা আদম সৃষ্টির মধ্যে খোদার যে সকল রহস্য প্রচ্ছন্ন আছে, তাহা উদঘাটন করিতে পারে ও খোদার মাহাত্ম্য উপলব্ধি করিতে পারে।

আমি রিপুকে শত্রু মনে করি না; মানুষের মধ্যে রিপু না থাকিলে, কুপ্রবৃত্তি না থাকিলে তাহার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হইত না। যিনি যত পরিমাণে কুপ্রবৃত্তি দমন করিতে পারেন, নফছকে বশীভূত করিতে পারেন, তিনি ততই খোদার নৈকট্য লাভ করিতে পারেন। এই রিপু না থাকিলে মানুষের মাহাত্ম্য আমরা কিরূপে উপলব্ধি করিতাম? বলিতে গেলে, শয়তান খোদার নৈকট্য লাভের সহায়-স্বরূপ। খোদা শয়তানকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন, আমাদেরই মঙ্গল হেতু। মঙ্গলময় খোদা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নষ্ট করিতে শয়তানকে সৃষ্টি করেন নাই। অন্ধকার না হইলে আলোকের বাহার কোথায়? কদাকার না হইলে সুন্দরের প্রশংসা কোথায়? বদি না হইলে নেকির বাহাদুরি কোথায়? দোজখ না হইলে বেহেশতের শান্তি কে বুঝিত? খোদার অসীম শক্তি, অফুরন্ত দয়া; তাই মাটির মানুষের মধ্যে শয়তানকে ভরিয়া দিয়া তাহাকে উচ্চতম স্থান দান করিয়াছেন। ধন্য তাঁহার মহিমা ধন্য তাঁহার সৃষ্টি কৌশল।’

সমাজে অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে চেষ্টা তা সে নিরিখেই দেখার অবশ্যই অবকাশ রয়েছে। অশরীরী অপশক্তিকে রুখে দেয়ার নাম করে প্রকারান্তরে শারীরিক অপশক্তির উদ্ভব ঘটে এবং সে অগ্রযাত্রায় আপ্লুত বোধ করা হয়। কল্পিত অপশক্তির অর্থায়নে বাধা দেয়ার নিয়তে আসল অপশক্তির দ্বারা লাখো কোটি টাকা লোপাটের মহা উৎসব চলে। ঠাকুর ঘরে কে? সমস্বরে সুচতুরতায় উত্তর আসে ‘আমি কলা খাই না’।

শয়তানের প্ররোচনায় দৈনন্দিন জীবনযাপনে নির্ধারিত ও নিয়মিত করণীয় বিষয় (যেমন- ইবাদত, উপাসনা, শরীরচর্চা, পড়াশোনা, দাফতরিক দায়িত্ব) পরিপালনের ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং মনোযোগে শৈথিল্য লক্ষ করা গেলে প্রাত্যহিক কর্মভাবনা ও সম্পাদনে শ্লথ হওয়ার লক্ষণ দেখা গেলে, হাতে প্রচুর কাজ থাকা সত্তে¡ও যেন কাজগুলোতে যথা মনোযোগ সমর্পিত হয়নি বলে মনে হলে এক ধরনের অবসাদ, অতৃপ্তি ও উৎকণ্ঠা সেখানে উপস্থিত হয়। মহৎ চিন্তাভাবনা ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার ক্ষীণ স্রোতধারা প্রবাহিত হতে চেয়ে হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যেতে পারে। সুশৃঙ্খল কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান শিথিলতা মনকে পীড়া দিতে পারে। সে কারণে সামনের দিনগুলোকে বেশ অগোছালো মনে হতে পারে। আশঙ্কা এই থেকে যায় যে, এর জন্য পরে অনুশোচনা বাড়বে আক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। কার্যকর ও সৃজনশীল কিছু করতে না পারার অতৃপ্তির সাথে সাথে কিছু করতে না পারার বেদনাও প্রায়শ মনকে পীড়া দেবে। আর এসবের ওপর যুক্ত হচ্ছে অপরিকল্পিত অবয়বের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

ভেবে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে যে, বর্তমানে দেশ সমাজ ও অর্থনীতির যে ক্রান্তিকাল বিরাজ করছে এ অবস্থার কী কী কারণ হতে পারে। হয়তো দেখা যাবে কর্মপরিবেশে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা, কারো কারো অসমর্থনযোগ্য আচরণ দ্বারা আহত হওয়া, সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ ব্যতিরেকে কিছুই করতে না পারা ইত্যাদি। নিজের ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা সমুন্নত রেখে, সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজেকে অপমানিত হতে না দিয়ে, আশপাশে ঘটে যাওয়া অন্যায় ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেয়া দেখে হতাশ না হয়ে বরং নিজের কাজে, পড়াশোনায়, চিন্তাভাবনায় একাগ্র হওয়াই উত্তম। জীবন সংগ্রামে যথাযথভাবে টিকে থাকতে হলে চাই সুস্থ ও সবল মনোবলের।

এর জন্য সাধনা ত্যাগ ও সহিষ্ণুতা সহকারে অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। আপনা আপনি আত্মশক্তির বিকাশ হয় না। ছেলের হাতের মোয়ার মতো সহজপ্রাপ্য নয় সব সমস্যার সমাধান। জীবনের কৈশোর তারুণ্য ও যৌবনের কর্মচাঞ্চল্য বয়ঃক্রমকালে লোপ পেতে পারে বৈকি কিন্তু অর্জিত অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর সুযোগ কেন হবে লাপাত্তা। এ জন্য চাই সময় ও সুযোগের সক্রিয় ও সুচিন্তিত সদ্ব্যবহার। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তুলে নিতে হবে কাজ এবং একে একে সম্পাদন হবে লক্ষ্য; মন হবে তারুণ্যে টগবগ। বিশ্রাম যতটুকু প্রাপ্য ও প্রয়োজন সেটুকু থাকবে। শয়তানের ইন্ধনে খোড়া যুক্তিতে সমর্পিত হলে চলবে না, সমর্পিত হলে চলবে না শৃঙ্খলাবিহীনতায়। আনন্দ সর্বনাশ, ভালো-মন্দ উত্থান-পতনের সময় ও কর্মপ্রবাহে উজ্জ্বল সূর্যের ও চেতনার আকাক্সক্ষা থাকতে হয় সদাজাগ্রত। ব্যর্থতার গ্লানিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে নয় ব্যর্থতাকে জয় করে এগোতে হবে।

নিজের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুৎ না হতে হয়, কোনো অবস্থাতে ছিন্ন না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে। একে মজবুত করতে হবে। ভারসাম্য থাকতে হবে, আনতে হবে চিন্তায় চৈতন্যে আবেগ উৎকণ্ঠায় কর্ম প্রণোদনায়। সময়ের ও সুযোগের সদ্ব্যবহারে হতে হবে সুগ্রথিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। আত্মবিশ্বাসে হতে হবে উচ্চশির। সবসময় খেয়াল রাখতে হবে শয়তান যেন জিতে না যায়।

লেখক : সাবেক সচিব

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

সূত্র, নয়া দিগন্ত