দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারত্বে সহযোগী ছিল ভারত। যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনি সরকারের অধীনে ভারত সেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল বিভিন্ন প্রকল্পে। দীর্ঘ সশস্ত্র যুদ্ধে ২০২১ সালে তালেবানের বিজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতও আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়। চার বছর হলো তালেবান আফগানিস্তান শাসন করছে, কিন্তু এখনো দিল্লিতে আফগান দূতাবাসে উড়ছে আশরাফ গনি সরকারের পতাকা। তালেবান আজও পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত। অতীতে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আল-কায়েদার। ওসামা বিন লাদেনসহ আল-কায়েদার অনেক শীর্ষ নেতাকে তারা আশ্রয় দিয়েছিল। একমাত্র রাশিয়া ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশ বর্তমান তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। এবার সেই তালেবানের সঙ্গে রীতিমতো দোস্তি পাতিয়েছে ভারত।
১৯৯৬ সালে তালেবান যখন প্রথম ক্ষমতায় আসে, তখন ভারত কাবুল দূতাবাস বন্ধ করে দিয়েছিল। ভারত তখন তালেবানবিরোধী আহমেদ শাহ মাসুদ ও আব্দুর রশিদ দোস্তমের নেতৃত্বাধীন উত্তর আঞ্চলিক জোটকে সমর্থন দেয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে উৎখাত করে আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার পর ভারত আবার আফগানিস্তানে ফিরে আসে। তবে পরিস্থিতির কারণে ২০১১ সাল থেকে বিদ্রোহী তালেবানের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ স্থাপন করেন ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ২০২০ সালে তালেবানের বিজয় যখন দ্বারপ্রান্তে, তখন ভারত পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব কীভাবে খর্ব করা যায় সে বিষয়ে। এ লক্ষ্যে ভারত তখন যোগাযোগ করে তালেবানের মধ্যকার পাকিস্তান ও ইরানবিরোধী অংশের সঙ্গে। তালেবানের সঙ্গে ভারতের এ গোপন যোগাযোগ তখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ২০২১ সালে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতির মাধ্যমে স্বীকার করে এর সত্যতা। এরপর তালেবান ক্ষমতা দখলের পর ভারত নতুন করে ব্যাকডোরে বা গোপনে তালেবান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সে খবরও সামনে আসার পর ভারত আর রাখঢাক না করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাকে কাবুলে পাঠায়। তারা বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে। বর্তমানে আমির খান মুত্তাকির ছয় দিনের ভারত সফরের মধ্য দিয়ে দিল্লি-তালেবান গোপন সম্পর্ক এখন প্রকাশ্য দোস্তিতে রূপ নিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ভারত-তালেবান বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিকভাবে সামনে এসেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের জঙ্গি প্রচারণার বিষয়।
তালেবান একটি কট্টর ধর্মীয় ও শরিয়াহভিত্তিক সরকার। তারা এমনই কট্টরপন্থি যে, ২০২২ সাল থেকে নারীশিক্ষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ দেশটিতে। পরিবারের সদস্য ছাড়া নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়াও নিষিদ্ধ। আরো নানা কারণে আন্তর্জাতিকভাবে তালেবান সরকার একঘরে হয়ে পড়েছে। এ রকম একটি সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্য দহরম-মহরম ভারতের। অপর দিকে ভারতেও ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। অথচ সেই ভারতই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে, এখানে ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে পর্যন্ত ভারতের কেউ কেউ আখ্যায়িত করছে তালেবান হিসেবে। আর বাংলাদেশে যাতে ইসলামপন্থিরা কোনো অবস্থায়ই ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেজন্য গোপনে ও প্রকাশ্যে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত সরকার।
মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা দেড় দশকের শাসনামলে দেশে অসংখ্য জঙ্গি নাটক সাজিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করা হয়েছে। এসব জঙ্গি নাটকের মাধ্যমে হাসিনা পশ্চিমা বিশ্বের সামনে নিজেকে একজন বিশিষ্ট জঙ্গিদমনকারী হিসেবে হাজির করেছেন। আর ভারত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝিয়েছে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থি আর জঙ্গিবাদের উত্থান ঠেকাতে হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসবে ইসলামপন্থি জঙ্গিরা, যা পশ্চিমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে। ভারতের এ বয়ান গ্রহণ করে পশ্চিমা বিশ্ব নীরবে মেনে নেয় হাসিনাকে। আর এ সুযোগে শেখ হাসিনা ভারতের সহায়তায় বিরোধী ও ইসলামপন্থিদের দমনে চালিয়েছে গুম, খুন, হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। সাজানো বিচারে ফাঁসির ব্যবস্থা করেছে ইসলামপন্থি নেতাদের।
তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি জঙ্গিদের উত্থান ঘটেছে—ভারতের এ অপপ্রচার এবার গ্রহণ করেনি পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু তারপরও ভারত নানা ইস্যুতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে একটি ইসলামি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের জন্য।
চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপন করছে বাংলাদেশে ইসলামপন্থি জঙ্গিবাদের উত্থান হিসেবে। অথচ ভারতে টানা দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় রয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী হিন্দু ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি। বিজেপির দর্শন হলো ভারত হিন্দুদের দেশ এবং ভারতকে তারা একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠা ও পরিচিত করাতে চায় বিশ্বে। ভারতের মুসলমানদের তারা বহিরাগত হিসেবে উগ্র প্রচারণা চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
বিজেপির দর্শন হিন্দুত্ববাদ এবং অনেকে হিন্দুত্ববাদকে ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখতে চান। ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্য হিন্দুত্ববাদকে তারা দায়ী করতে রাজি নন। তবে অন্য অনেকে হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্ববাদের মধ্যে পার্থক্য না করার পক্ষে।
হিন্দুত্ববাদ, হিন্দু ধর্ম আর বিজেপিকে কে কী হিসেবে বর্তমানে ব্যাখ্যা করছে, তার চেয়ে বড় কথা হলো বিজেপি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। আরএসএসের অন্যতম লক্ষ্য হলো ভারতকে একটি হিন্দু জাতি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। বিজেপি একটি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল। নির্বাচনি ময়দানে জয়লাভের ক্ষেত্রে তাদের অন্যতম অস্ত্র হলো উগ্র হিন্দু ও হিন্দুধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানো। আরএসএস ও বিজেপি মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণু হিসেবে পরিচিত। নরেন্দ্র মোদি গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০০২ সালে গুজরাটে দাঙ্গা ঘটে এবং দাঙ্গা বন্ধে তার প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। গুজরাটে দাঙ্গার পর মোদি গোটা ভারতে পরিচিতি লাভ করেন একজন হিন্দুত্ববাদী মুসলিমবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। ১৯৭১ সালে ২৫ বছর বয়সে তিনি আরএসএস গুজরাট সংগঠনের পূর্ণকালীন কর্মী হন। ১৯৮৫ সালে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক শাখা বিজেপিতে নিযুক্ত করে মোদিকে। দলের সাংগঠনিক কাঠামোর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে যান মোদি। ১৯৯৮ সালে তিনি বিজেপির সাধারণ সম্পাদক হন। আরএসএস এবং দলের পক্ষ থেকে ২০০১ সালে মোদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয় দলের পক্ষ থেকে। এ নির্বাচনে গোটা ভারতের হিন্দুদের বিজেপির পক্ষে এক কাতারে আনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় হিন্দু ধর্ম, হিন্দুত্ববাদ-নির্ভর বাড়াবাড়ি ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা। বিজেপি নিজেদের হাজির করে হিন্দু ধর্ম, হিন্দুত্ববাদ ও হিন্দু জাতির রক্ষাকবচ হিসেবে। এ লক্ষ্যে হিন্দু কার্ডকে তারা সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় মোদির মতো হিন্দুত্বের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন আরএসএস নেতাকে সামনে রেখে। মোদির নেতৃত্বে ২৮২টি আসন নিয়ে বিজেপি ভারতের লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
আরএসএস ও বিজেপির মতো কট্টর উগ্র হিন্দুত্ববাদী দলের নিবেদিতপ্রাণ নরেন্দ্র মোদির ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং হিন্দু ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করার পরও বিশ্বে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় কোনো সংকটে পড়ে না। ধর্ম ও জাতিগত কারণে অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরও তারা আখ্যায়িত হয় না সাম্প্রদায়িক ও উগ্র ধর্মীয় জঙ্গিবাদী দেশ হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশে যখনই ইসলামপন্থি রাজনীতির পথ সুগম হয়, তখনই ভারতসহ অনেকে বাংলাদেশকে চিত্রিত করতে থাকে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান ও ইসলামি জঙ্গিদের দেশ হিসেবে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতকে ভুয়া খবর প্রচারে বিশেষভাবে পারদর্শী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে পরিকল্পিত মিথ্যাচার চলছে, তা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে যে সংঘবদ্ধ উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা নেওয়া হয়নি কখনোই। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের বর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক চিত্র এবং মুসলমানসহ অন্য ধর্ম ও জাতির প্রতি তাদের তীব্র বৈষম্য বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল, তাও করা হয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, সেনা সর্বাধিনায়ক অনিল চৌহানসহ আরো অনেকের বক্তব্যে এটি পরিষ্কার—বাংলাদেশের অস্তিত্বকে ভারত তার নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে মনে করে। সে কারণে ভারত কখনোই চায় না বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে আচরণ, তার মাধ্যমে ভারত নিজেই নিজেকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের দুশমন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রধান হুমকি ভারত। এ হুমকি মোকাবিলায় সামরিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেমন সক্ষমতা অর্জন প্রয়োজন, তেমনি অপরিহার্য ভারতের সব অপপ্রচার মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব হবে, ভারতসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সব মিথ্যা ও অপপ্রচারের বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উপযুক্ত জবাব দেওয়া—বিশ্ববাসীর সামনে ভারতের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরার ব্যবস্থা করা।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ